প্রতীকী ছবি।
ঠিক যেন তেতো দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে মিষ্টিমুখের দিকে যাওয়া।
বিয়ের কয়েক মাস গড়াতে না গড়াতেই জীবনের বহু জরুরি চাহিদা কিংবা অপ্রিয়-অপছন্দের বিষয়ও সামনে চলে আসে। স্বামীর রোজগার কত, রোজগারের টাকার পুরোটাই কি তিনি স্ত্রী-র হাতে তুলে দেবেন, না কি স্ত্রীর প্রয়োজন মতো দেবেন? আবার স্ত্রী-ও তাঁর নিজের জীবনযাপনে স্বামীর হস্তক্ষেপ আদৌ মেনে নেবেন কি?
মনোবিদেরা জানাচ্ছেন, এমন অজস্র বিষয় সুখী দাম্পত্য জীবনকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করে। যার জেরে প্রায়ই সম্পর্ক বহন করার চেয়ে বর্জন করার দিকে ঝুঁকছেন যুগলেরা। বিবাহ-বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে পড়ছে।
এ বার শহরে শুরু হয়েছে নতুন ব্যবস্থা। মনোবিদ কিংবা মনোরোগ চিকিৎসকদের মতামত, তাঁদের সাহায্য নিয়ে নিজেদের মেলামেশার ফাঁকে ফাঁকেই তরুণ-তরুণীরা নাগাল পেতে চেষ্টা করছেন একে অন্যের মানসিকতার। বিবাহ-বিচ্ছেদ ঠেকাতে ইতিমধ্যে শহরে এই ধরনের কাউন্সেলিং শুরু হয়েছে। তাঁরা মনে করেন, যুগলেরা একসঙ্গে বসে এ সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময়েই সামনে আসতে পারে তাঁদের মানসিকতা। তখন তাঁরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, সাত পাকে বাঁধা পড়বেন, না কি ওই পথে এগোবেন না।
মনোরোগ চিকিৎসক তথাগত চট্টোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে কথা বলার শুরুতেই হাসছেন। তিনি বলেন, ‘‘এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, আমরা বিয়ে ভেঙে দিচ্ছি। অনেকেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছু বিয়েই তিন-চার বছরের বেশি টিকছে না। আমরা তাঁদের পথ দেখাতে চাইছি। বিয়ের আগেই যদি আপনি আপনার সঙ্গীর মনোভাবের আঁচ পেয়ে যান, তা হলে বিয়ের পরে চলতেও তো সুবিধা হতে পারে।’’ তিনি জানান, এ সব নিয়ে এক সপ্তাহ অন্তর চারটি করে সেশনও করছেন তাঁরা।
তথাগত কিংবা তাঁর মতো কোনও কোনও মনোরোগ চিকিৎসক যুগলদের নিয়ে কথা বলার সময়ে তাই এমন অনেক অপ্রিয় প্রশ্ন দু’জনের সামনেই রাখছেন, যেগুলি পরবর্তী সময়ে সামনে এলে সম্পর্কের বাঁধন আলগা হতে পারে। এমন প্রয়াসের ইতিবাচক দিক রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘অফিস বা ব্যবসার চাপ, নিজেদের কম সময় দেওয়া, নিজেদের সম্পর্কের মধ্যে পরিবারের অন্যদের নাক গলানো-সহ নানা কারণে এমন বহু ঘটনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রক্রিয়াও এখন অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু, সবার অলক্ষ্যে এক ভাঙা-মনের শিশুর বেড়ে ওঠা কারও নজরে আসছে না।’’
প্রাক্-প্রেগন্যান্সি কাউন্সেলিংয়ের ধারণা থেকেই এই প্রাক্-বিবাহ কাউন্সেলিংয়ের প্রচলন, জানালেন মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম। ‘‘জানা-চেনাটা সময়সাপেক্ষ। ২৪ ঘণ্টা একসঙ্গে থাকতে শুরু করলে, মানুষের চরিত্রের বিভিন্ন দিক প্রতিভাত হতে শুরু করে। প্রথম দু’বছর এক রকম ভাবে চেনা যায়। পরের পাঁচ বছর সেই চেনাই বদলে যায়। তবে, কারও কারও ক্ষেত্রে এই প্রাক্-বিবাহ কাউন্সেলিং কাজে লাগতেই পারে,’’ বলছেন জয়রঞ্জন।
এই ধরনের কাউন্সেলিংয়ের সুফলের কথা স্বীকার করছেন মনোবিদ অনিন্দিতা রায়চৌধুরী। মুম্বইয়ের বাসিন্দা প্রবাসী এই মনোবিদ মনে করেন, প্রত্যেক মানুষের ভিতরে একটা নেতিবাচক দিকও থাকে। তাঁর কথায়, ‘‘আমার সঙ্গীর সম্পর্কে সেটা আমি যদি বিয়ের আগেই জেনে যেতে পারি, তা হলে বিষয়টিকে সামলাতে সুবিধা হবে। বেশ কিছু বিষয় নিয়ে বাঙালিদের মধ্যে এখনও ছুতমার্গ রয়েছে। সেটাও আগে থেকে জানলে সুবিধা হবে সঙ্গীর।’’
মনোবিদ কিংবা মনোরোগ চিকিৎসকেদের সাহায্য নিয়ে তাই দু’জনার দু’টি পথ দু’টি দিকে বেঁকে যাবে, না কি নতুন পথের বাঁকে মিশে এক হবে, সেটা সময় বলবে।