‘গয়নার বাক্স’-এ শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়।
এক জোড়া বালা, কানপাশা আর একটি গলাভরা নেকলেস। সঙ্গে আরও নানা ধরনের কান-গলা-হাতের গয়না। সযত্নে গয়নার বাক্সে সাজিয়ে রাখে রাশমণি। মৃত্যুর পরেও সে মায়া ছাড়তে পারেনি সে। বংশ পরম্পরায় সে বাক্স সোমলতার হাতে পড়ে। সে-ও নিজের মতো গুছিয়ে রাখে সেই বাক্স। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘গয়নার বাক্স’ যিনি পড়েছেন বা সেই গল্প অবলম্বনে তৈরি ছবিটি দেখেছেন, তিনি জানেন, মেয়েদের কাছে সোনার গয়নার মাহাত্ম্য কী। তবে যাঁরা কোনওটিই করেননি, তাঁরাও ভালই জানেন মেয়েদের কাছে সোনার গয়নার কদর কত।
মেয়েদের গয়নার প্রতি যে এক আলাদা দুর্বলতা রয়েছে, তা সকলেরই জানা। বিয়ের গয়নার প্রতি তা অনেক বেশি, বিশেষ করে গয়না যদি মা-দিদিমার সূত্রে পাওয়া হয়। তবে সোনার গয়না মেয়েদের কাছে সম্পদও বটে। শেষ সম্বল হিসাবে বিয়ের গয়নাগুলি তুলে রাখেন বেশির ভাগ মেয়ে। তবে এখনকার মেয়েরা অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছেন। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছেলেদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রোজগার করছেন তাঁরা। এখন তাঁদের সোনার গয়না পাওয়ার জন্য বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। তাঁরা অনেকেই রোজগার করে নিজেই সোনার গয়না কেনেন, কোনও উপলক্ষ ছাড়া। কিন্তু এই সোনার গয়না কেনা কি তাঁদের কাছে শুধুই গয়নাপ্রীতি? না কি বিনিয়োগের কথা মাথায় রেখেই তাঁরা সোনা কেনার সিদ্ধান্ত নেন? খোঁজ নিল ‘আনন্দবাজার অনলাইন’।
প্রতীকী ছবি।
যে কর্মরত মেয়েরা রোজ বাস-ট্রাম-মেট্রো করে কাজের জায়গায় যান, তাঁদের হয়তো রোজ সোনার গয়না পরার মতো সাহস হয় না। চুরি-ছিনতাইয়ের ভয়ে অনেকেই সোনার গয়নার বদলে এখন ঝুটো গয়নাই বেছে নেন। সোনার গয়না জায়গা পায় ব্যাঙ্কের লকারে। পরিবারে কোনও নিকট আত্মীয়ের বিয়ে না হলে সেই গয়না সিন্দুকবন্দি হয়েই থেকে যায়। তাই সোনার গয়নার প্রতি তাঁদের কতটা টান তৈরি হয়, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। যে গয়না নিয়মিত পরাই যায় না, তা কি আদৌ অত প্রিয় হয়ে ওঠা সম্ভব? নাকি আর্থিক স্বাধীনতার সঙ্গে সোনার গয়নার ভূমিকাও বদলে গিয়েছে এখনকার নারীর জীবনে? হয় তাঁরা সোনা জমিয়ে রাখেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিয়ের উপহার হিসাবে, কিংবা সেগুলি তাঁদের কাছে নিছকই আর্থিক সম্পদ।
মুম্বইয়ের বাসিন্দা প্রাচী অনেক ছোট বয়স থেকেই রোজগারের পাশাপাশি নানা খাতে বিনিয়োগ করে এসেছেন। তিনি সোনার গয়নার পাশাপাশি নিয়মিত ডিজিটাল গোল্ডও কিনে থাকেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থা তেমন স্বচ্ছল ছিল না। খুব ছোট বয়স থেকেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম, উল্টোপাল্টা খরচ করার অবস্থায় নেই আমি। তাই নানা রকম বিনিয়োগ করতাম। তার মধ্যে সোনাও ছিল। সম্প্রতি গয়নার বদলে ডিজিটাল সোনা কেনা শুরু করেছি।’’
প্রতীকী ছবি।
প্রাচীর মতো রয়েছেন আরও অনেকে। কর্মসূত্রে আমেরিকার বাসিন্দা আত্রেয়ী। পেশায় ডেটা অ্যানালিস্ট। আত্রেয়ী তাঁর মায়ের গয়না বিয়েতে পেয়েছিলেন। ‘‘সোনার গয়না আর সোনায় বিনিয়োগ, দু’টি আমার জন্য সম্পূর্ণ আলাদা। মায়ের গয়না আমার কাছে তার আসল মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামি। তাই সোনায় বিনিয়োগ করতে হল আমি ডিজিটাল সোনা কেনার পথেই হাঁটব,’’ বললেন আত্রেয়ী। এক সুর কানাডার বাসিন্দা প্রিয়ঙ্কার কথাতেও, ‘‘সোনার গয়না সে ভাবে কিনি না। কোথাও পরে যাওয়ার নেই। কিন্তু বিয়েতে যে গয়নাগুলি শাশুড়ি দিয়েছেন, সেগুলি কখনওই বিক্রি করে দেওয়ার কথা ভাবব না। পুরনো দিনের গয়না আমার কাছে ফেলে আসা সময়ের প্রতিচ্ছবি। তাই সেগুলি হাত ছাড়া করার মানেই হয় না,’’ বললেন প্রিয়ঙ্কা।
মেয়েদের গয়নার প্রতি দুর্বলতার কথা আস্বীকার করার কোনওই জায়গা নেই। তবে অনেকেই এখন সোনার বদলে রুপোর গয়নায় মজেছেন। কেনার খরচ কম। অনেক সাজের সঙ্গে সোনার চেয়ে রুপো বেশি মানানসই। তাই বহু আধুনিকা এখন ঝুঁকছেন নানা ধরনের রুপোর গয়নার দিকে। সোনা তাঁদের কাছে মা-ঠাকুরমার জোর করে কেনানো কিছু গয়না। কলকাতার অলঙ্কার শিল্পী মোনালিসা মান্না রুপোর গয়না ডিজাইন করেন। নিজের ব্যবসার বাইরে গিয়ে তিনি কি সোনার গয়না কেনেন? উত্তরে বললেন, ‘‘মায়ের কোনও গয়না খুব পছন্দ হয়ে গেলে জোর করে সোনা কিনতে হয়। কিন্তু সেই গয়না কোনও বিয়েবাড়িতে পরে গেলে সাজের চেয়ে গয়না নিয়ে চিন্তা হয় বেশি। তবে আমি সোনায় বিনিয়োগ করি। সোনার বার কিংবা রিং কিনি। যাতে মজুরির টাকাও খরচ করতে হয় না। পুরো দামটাই পরে পাই।’’
ধাতু থেকে সোনা যে মুহূর্তে গয়নায় রূপান্তরিত হয়, তখন মেয়েরা গয়নার মায়ায় জড়িয়ে পড়েন। তাই বিনিয়োগ হিসাবে দেখতে গেলে তাঁরা সোনার গয়না না কিনে ডিজিটাল গোল্ড বা খাঁটি সোনার বার কেনার পথেই হাঁটছেন এই ধনতেরসে।