২০২১ সালে ভারতে আত্মঘাতী হয়েছেন ১৬৪০৩৩ জন। প্রতীকী ছবি।
অনিলের এখন আঠারো বছর। গত বছর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে নিট-এ বসেছিল ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন নিয়ে। হয়নি। গত বছরই কোভিডে মারা গিয়েছেন অনিলের বাবা। পরিবারের একমাত্র রোজগেরে মানুষটিকে হারিয়ে অনিলের মা খাওয়াদাওয়া করতেন না, ঘর অগোছালো, সামান্য পরিচ্ছন্নতার দিকেও নজর ছিল না। এক দিন সকালে উঠে মাকে ঝুলন্ত অবস্থায় পায় অনিল। মামা-কাকারা কয়েক দিন পাশে থাকলেও কিছু দিন পরে যে যার জায়গায় ফিরলেন। মাকে দোষারোপ করে আত্মীয়দের বলা কথাগুলো মনে পড়তে লাগল একা বাড়িতে। অনিলেরও মনে হল, এত কষ্ট নিয়ে বেঁচে লাভ কী? মায়ের পথে কিছু ক্ষণের যন্ত্রণা, শেষে মুক্তি।
এ ধরনের অস্থিরতার কারণেই গত ৫০ বছরের মধ্যে ২০২১ সালে ভারতে আত্মহত্যার সংখ্যা সর্বাধিক। আত্মঘাতী হয়েছেন ১৬৪০৩৩ জন। সদ্য প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো’র (এনসিআরবি) পরিসংখ্যান বলছে এই তথ্য। আরও একটি তথ্য হল, সারা পৃথিবীতে আত্মহত্যার শিকার হওয়া মানুষের মধ্যে সবচেেয় বেশি লোক ভারতের। বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রথম পাঁচে জায়গা করলেও আত্মহত্যায় প্রথম স্থান অবশ্যই লজ্জাজনক। তবে ১৮-২৯ বছর বয়সিদের মধ্যে আত্মঘাতী হওয়ার হার বেশি বলে জানাচ্ছে এনসিআরবি-র তথ্য। যুবশক্তির এই অপচয় দেশের অর্থনীতির পক্ষেও ক্ষতিকর। নেশায় আসক্তি এবং সম্পর্কের টানাপড়েন এই বয়সিদের আত্মহত্যার অন্যতম কারণ।
এ বার আসি মহিলাদের কথায়। ভারতে মহিলাদের আত্মহত্যার হার বাকি বিশ্বের দ্বিগুণ। আগের থেকে সেই হার কিছুটা কমলেও এখনও আমরা পিছিয়ে। কম বয়সে বিয়ে এবং শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্যাতিতা হওয়ার কারণে গৃহবধূদের আত্মঘাতী হওয়ার সংখ্যা বেশি। পেশার নিরিখে মজুরদের মধ্যে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি, প্রায় ২৬ শতাংশ। ভারতে প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষের আয় বছরে এক লক্ষের কম। এই সব তথ্য স্পষ্ট করে, আত্মহত্যার প্রবণতা জড়িয়ে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গেও।
পশ্চিমী দেশগুলিতে আত্মঘাতী হওয়ার ৯০ শতাংশ ঘটনাই ঘটে মানসিক অবসাদের কারণে। অথচ আমাদের দেশে সেই সংখ্যাটা ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ, ভারতে আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিতে আত্মহত্যার পাল্লা অনেক ভারী। অতএব এই পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে বড় উন্নতির আশা করা ঠিক নয়।
এ সবের পাশাপাশি কোভিড পরিস্থিতি ও তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা না করলে ছবিটা স্পষ্ট হবে না। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে আত্মহত্যা ১০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে এসেছে। ২০২১ সালে সেই বৃদ্ধি ৭.২ শতাংশ। এর জন্য দায়ী কোভিডের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব। দীর্ঘ সময় ধরে সামাজিক দূরত্ব, আতঙ্ক, স্বজন হারানোর যন্ত্রণা, বেকারত্ব এবং প্রবল অর্থাভাবের মিলিত প্রভাবে এত ভয়াবহ পরিস্থিতি হয়েছে।
এই সব পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। বিশ্ব জুড়ে কিছু পদ্ধতি আত্মহত্যা প্রতিরোধে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের উচিত দ্রুত সেগুলি চালু করা। কীটনাশক নিয়ন্ত্রণ তারই একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। অতি বিষাক্ত কিছু কীটনাশক বর্জনে সুফল পেয়েছে কেরল। এখানেও ওই পদ্ধতি অনুসরণ করলে গ্রামাঞ্চলে আত্মহত্যার ঘটনা কমবে। তা নয়তো হাতের সামনে পাওয়া কীটনাশক খেয়ে নেন অনেকেই। কাছে হাসপাতাল না থাকায় তাঁদের বাঁচানো যায় না। মদের নেশাও আত্মহত্যার একটি কারণ। এর প্রভাবে অনেক সময়েই ব্যক্তি তাঁর আবেগের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসেন। হঠাৎ করেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। ফলে নেশার দ্রব্য, বিশেষ করে মদের বিক্রি ও দামের উপরে কড়া সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রয়েছে সংবাদমাধ্যমেরও। মনে রাখতে হবে, এমন খবর বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে লিপিবদ্ধ করা উচিত। যথাসম্ভব কম জায়গা জুড়ে লেখা, শিরোনামে আত্মহত্যা শব্দের উল্লেখ না-করা, ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ না দেওয়া-সহ কয়েকটি সতর্কতা মেনে চললে বহু ক্ষেত্রে এক জন আত্মহত্যা-প্রবণ মানুষকে ‘খবরের প্রভাব’ থেকে বাঁচানো সম্ভব।
আত্মহত্যা করার ইচ্ছা মানুষ অচেনা লোকের কাছে সহজে প্রকাশ করতে চান না। তবে কাছের লোককে তাঁরা আকারে ইঙ্গিতে সেই আভাস দিয়ে থাকেন। ওই আভাস বোঝার জন্য জরুরি ‘গেটকিপার ট্রেনিং’। ফলে মানসিক অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তির থেকে আত্মহত্যার আভাস পেলেই যথাযথ পদক্ষেপ করা যায়। কাছের ব্যক্তিকেও বলতে দ্বিধা হলে ‘সুইসাইড প্রিভেনশন হেল্পলাইন’-এর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
সেই সঙ্গে মনের রোগের যথাযথ চিকিৎসা হলে ৫০ শতাংশ আত্মহত্যার ক্ষেত্রে প্রতিরোধের উপায় বার করা সম্ভব। অবসাদ লুকিয়ে রাখা বা নিজেই সেরে যাবে, এমন ভাবলে অনিলদের মতোই মানসিক অস্থিরতা জন্ম নেবে।
শুরুর সেই চরিত্র অনিল কি শেষ পর্যন্ত বাঁচল? প্রতিবেশী, বন্ধুরা পাশে দাঁড়িয়ে তাকে অবসাদ থেকে বার করে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে, সত্বর পদক্ষেপ না করলে অনিলদের বাঁচানো যাবে না।
মনোরোগ চিকিৎসক, ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি