খাবারকে করে তুলতে হবে সন্তানের প্রিয় বিষয়।
সন্তানকে খাওয়াতে হবে... এ যেন একটা টাস্ক! তাকে কী ভাবে পেট পুরে খাওয়ানো যায়, এই চিন্তা যেমন মায়েদের সারা দিন মাথায় ঘোরে। ঠিক একই ভাবে মা আবার খাওয়াতে আসবে গোছের ভয় বাচ্চাটিকেও তাড়া করে বেড়ায়। কিছু বাচ্চা নিজে থেকে খায়, কেউ একেবারেই খেতে চায় না। অনেকে আবার খাওয়ার ব্যাপারে চুজ়ি। কিন্তু যেমনই হোক, তার পুষ্টিরও প্রয়োজন আছে, সে কথা এড়িয়ে গেলে চলবে না। আবার পুষ্টি মেপে বিস্বাদ খাবার বাচ্চাকে জোর করে খাওয়াতে গেলে সে খাবে না। তাই খাবারকে করে তুলতে হবে সন্তানের প্রিয় বিষয়।
সন্তানের পছন্দই প্রথম
সে কেন খায় না, সেই প্রশ্নের উত্তর আগে খুঁজতে হবে। অনেকেই খাওয়ার ব্যাপারে চুজ়ি হয়। আপনি ডিম খেতে ভালবাসেন মানেই যে আপনার সন্তানও ডিম খাবে, এমন যুক্তি নেই। তার মাছ, মাংস, ডিম পছন্দ না-ই হতে পারে। তার পছন্দ মেনে নিন। বরং তার খাবারে প্রোটিন বজায় থাকে, এমন কিছু খাবার তার পছন্দের খাবারের তালিকা থেকে বেছে নিন। সে ক্ষেত্রে নিজেই ওর সঙ্গে কথা বলে নিন। তাকে জিজ্ঞেস করুন, সে ডিম বা মাছ না খেলে, সেই জায়গায় কী খাবে? তার মত চাইলে সে-ও খুশি হবে।
সন্তানকে নিয়ে খেতে বসুন
অনেকে বাড়ির খুদে সদস্যকে আগে খাইয়ে দেন। ফলে গোড়াতেই থেকে যাচ্ছে গলদ। ওকে যখনই একা খেতে দিচ্ছেন, সে খাচ্ছে কি না, কম খাচ্ছে কেন, দেরি করছে কেন... সেই বিষয়ে আপনার নজর পড়ছে। ফলে ‘তাড়াতাড়ি খাও’, ‘আগে মাছ খাও’... এই ধরনের আদেশও দিচ্ছেন। এতে খাবারটা ওদের কাছেও একটা ‘টাস্ক’-এ পরিণত হয়। তার মনে হতে থাকে, এটাও পড়তে বসার মতো একটা কাজ। ফলে খাওয়ার আনন্দ হারিয়ে যায়। তাই সন্তানকে নিয়ে একসঙ্গে খেতে বসুন। ওকে একা খেতে দিন। দেখবেন, অন্যদের দেখাদেখি সে খাবারটা খেয়ে নিচ্ছে।
মা-বাবারা খেয়াল রাখবেন
• সন্তানকে রোজ একই খাবার খেতে দেবেন না। ব্রেকফাস্টে, সুজি, ওট্স, স্যান্ডউইচ, রুটি, চিড়ে, ইডলি, নুড্লস পাল্টে-পাল্টে দিতে পারেন।
• দুপুরে ভাতের সঙ্গে ডাল, তরকারি, মাছের পদ পাল্টে দিন। এতে বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজও পাবে সে।
• বাচ্চাকে খেতে দিলে সে যেগুলো ভালবেসে খাচ্ছে, সেগুলো মাথায় েরখে পরবর্তী সময়ে মেনু তৈরি করুন। তাই বলে রোজই আবার একই খাবার দিয়ে যাবেন না।
বাইরের খাবার বেশি পছন্দ?
অনেকেই রেস্তরাঁর বিরিয়ানি, মোমো হয়তো আনন্দে খাচ্ছে, কিন্তু বাড়ির খাবার নৈব নৈব চ। এর কারণটা ভেবে দেখুন। হয়তো আপনারাও বাইরে বেশি খান, যার জন্য সন্তানও বাইরের খাবারের সঙ্গে পরিচিত। বাচ্চাকে বাইরের খাবার খাওয়ালেও তা যেন ঘন ঘন না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখুন। স্ট্রিট ফুড বা জাঙ্ক ফুডের ক্ষতিকর দিকটা ভুলে গেলে চলবে না। বাড়িতেই কম মশলা দিয়ে বিরিয়ানি রেঁধে দিতে পারেন বা মাছ, মাংসের পুর দিয়ে মোমো। তার পরে সুন্দর করে সাজিয়ে ওর সামনে দিয়ে দেখুন তো খাচ্ছে কি না!
অল্প পরিমাণে খাবার দিন
শিশুকে তাড়াতাড়ি খাওয়াতে গিয়ে অনেকেই একসঙ্গে বেশি ভাত মেখে ফেলেন। কিছু ক্ষণ পরই সেই ভাত থেকে জল কাটতে শুরু করে। ফলে তা বিস্বাদ হয়ে যায়। সন্তানের খেতে ভাল লাগে না। তাই একবারে বেশি খাবার না দিয়ে অল্প পরিমাণে খেতে দিন। শেষ হয়ে গেলে আবার দিন। একটাই খাবার বেশি না দিয়ে অনেক ভাগে ওর থালা সাজিয়ে দিন। ধরুন এক হাতা ভাত, ছোট একটা রুটি, একটু সালাড, অল্প ডাল, একটা সবজি, মাছ বা মাংসের পদ আর টক দই। অনেক রকম পদ দিলে খাবারের প্রতি ওর আগ্রহ জন্মাবে।
সন্তানকে নিয়ে রান্না করুন
কোন আনাজ কেমন করে কাটছেন, সেটা দিয়ে কী রান্না হচ্ছে, তার পরে সেটা কী ভাবে সাজিয়ে খেতে দেওয়া হচ্ছে... এই পুরো প্রসেসটায় সন্তানকে সঙ্গে রাখুন। এতে ও-ও খাবার সম্পর্কে আগ্রহী হবে।
খাবার হোক আকর্ষক
• স্যান্ডউইচের উপরে অলিভ দিয়ে চোখ আর গাজরের ফালি দিয়ে ঠোঁট করে দিন। কুকি কাটার দিয়ে পাউরুটি কেটে বিভিন্ন আকারের স্যান্ডউইচ তৈরি করে দিতে পারেন।
• নুড্লস তিন ভাগে ভাগ করে নিন। একটায় সামান্য হলুদ দিন, অন্যটায় টম্যাটো সস, আর বাকিটা সাদা। এ বার তা সাজিয়ে দিন।
• সুজির উপমা বানিয়ে ছোট বলের আকারে গড়ে নিন। তার উপরে কারি পাতা লাগিয়ে চুলের মতো ঢেকে দিন। চোখ তৈরি করতে ফোড়নের সরষে কাজে লাগাতে পারেন।
• রুটি, পরোটা দিলে আর একটু খাটতে হবে। রুটিতে অল্প সস লাগিয়ে উপরে তরকারি ছড়িয়ে দিন। তার উপরে চিজ় কুরে দিয়ে অল্প গরম করে দিন। চিজ় গলে গেলে সেটাই পিৎজ়ার মতো তিনকোনা আকারে কেটে দিন।
• কলা, দুধ, আটা ও মধু একসঙ্গে গুলে প্যানকেক বানিয়ে দিতে পারেন। এ, বি ইত্যাদি অ্যালফাবেটের আকারে কেটে দিন। কুকি কাটারেও শেপ দেওয়া যায়।
• গাজর, পালং শাক... পুষ্টিকর আনাজ খাওয়াতে তা সিদ্ধ করে আলুর সঙ্গে মণ্ড পাকিয়ে টিকিয়ার মতো বানিয়ে পাউরুটির মধ্যে গুঁজে বার্গার বানিয়ে দিন।
• ফল খাওয়ার ব্যাপারেও বাচ্চাদের অনীহা থাকে। হাং কার্ডে মধু দিয়ে তার মধ্যে আঙুর, আপেল, বেদানা, কলার টুকরো দিয়ে ফ্রিজে জমান। ঠান্ডা ঠান্ডা খেতে দিন। আইসক্রিমের মতোই আনন্দ করে খেয়ে নেবে।
মনে রাখবেন, বাচ্চার পুষ্টিকর আহার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তার মনের মতো করে সেই খাবারের জোগান দেওয়াও জরুরি। তাই সন্তানের খাবার তৈরিতে সময় দিন। খাওয়ার সময়টাকে উপভোগ্য করে তুলুন।
মডেল: সুস্মিতা চট্টোপাধ্যায়, স্যমন্তক মৈত্র; ছবি: অমিত দাস মেকআপ: চয়ন রায়; লোকেশন ও হসপিটালিটি: এপিসোড ওয়ান, তপসিয়া রোড।