খোলামেলা, আলো-বাতাসযুক্ত ঘর হোম কোয়রান্টিনের জন্য উপযুক্ত।
করোনাভাইরাসের আক্রমণ যেমন বেড়ে চলেছে, তেমনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ‘হোম কোয়রান্টিন’-এ থাকা মানুষজনের সংখ্যাও। চিকিৎসকেরা এখন অনেককেই পরিস্থিতি অনুযায়ী হাসপাতালের পরিবর্তে হোম কোয়রান্টিন-এ থাকতে পরামর্শ দিচ্ছেন।পরিবারের দু’জন আক্রান্ত, বা পাঁচ জনেরই করোনা হয়েছে, এই ছবিটা আজ স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এক ছাদের তলায় হোম কোয়রান্টিন কতটা কার্যকরী? কী কী করবেন? কেমন করেই বা প্রস্তুত করবেন বাড়ির মানুষকে? খোঁজ নিল আনন্দবাজার ডিজিটাল।
যে অঞ্চলে রোগ ছড়িয়েছে এমন জায়গা থেকে ঘুরে এলে অথবা রোগাক্রান্ত বা সম্ভাব্য সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে বা আসার সম্ভাবনা থাকলে সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের কোয়রান্টিনে থাকা প্রয়োজন।
রোগাক্রান্ত বা সম্ভাব্য সংক্রামিত ব্যক্তির সঙ্গে একই বাড়িতে যাঁরা থেকেছেন, তাঁর মল-মূত্র-থুতু-কফ-হাঁচি-কাশি ইত্যাদির সংস্পর্শে এসেছেন বা অন্য কোনও ব্যবহৃত জিনিস যেমন থালা-বাসন, জামাকাপড়, বিছানা ব্যবহার করেছেন এমন সকলেরই কোয়রান্টিনে থাকা দরকার। তবে তা হাসপাতাল না বাড়িতে হবে, তা চিকিৎসক ঠিক করবেন।
আরও পড়ুন: করোনা ভাইরাস কি শক্তি হারাচ্ছে? জল্পনায় জল ঢাললেন চিকিৎসকরা
পালমোনোলজিস্ট তনভির রেজা যেমন বললেন, কোভিডে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে তাঁর সংস্পর্শে আসা মানুষ, সব ক্ষেত্রেই আজকের পরিস্থিতিতে হোম কোয়রান্টিনের পরামর্শই দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। হোম কোয়রান্টিনে থাকার ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট নিয়মের উপর জোর দিচ্ছেন তাঁরা।
আরও পড়ুন: ধূমপানে বাড়ছে করোনার ঝুঁকি, আশঙ্কা ক্লাস্টার সংক্রমণের, এড়াতে কী করবেন?
বাড়িতে পরস্পর আলাদা থাকুন
খোলামেলা, আলো-বাতাসযুক্ত ঘর হোম কোয়রান্টিনের জন্য উপযুক্ত। শৌচের ব্যবস্থা সঙ্গেই থাকা উচিত। একান্ত না থাকলে আলাদা শৌচালয়ের ব্যবস্থা করা দরকার, যা অন্য কেউ ব্যবহার করবেন না। পরিবারের ২-৩ জন বাড়িতে থাকলে আলাদা ঘরে থাকার ব্যবস্থা নিতে হবে। চিকিৎসক তনভির রেজা যেমন বললেন, “যদি কোনও পরিবারে দু’জনের সুগার বা ব্লাডপ্রেশার থাকে, তাঁদের দু’জনকে একসঙ্গে একটা ঘরে রেখে বাকিদের আর একটা ঘরে থাকতে হবে। পরিবারের মধ্যেই
চেষ্টা করতে হবে সদস্যদের যথাসম্ভব দূরে থাকার।”
বিছানার চাদর থেকে, বালিশ, স্নানের তোয়ালে প্রত্যেকের আলাদা থাকা বাঞ্ছনীয়। বাড়িতে বাচ্চা থাকলে সে মায়ের সঙ্গে থাকতে পারে যদি না মায়ের কোনও উপসর্গ দেখা যায়। চিকিৎসকদের মতে, করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে আজ পর্যন্ত যা পরিসংখ্যান সামনে এসেছে, তাতে বাচ্চাদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা যথেষ্টই কম। এ ক্ষেত্রে বাড়িতে বাচ্চার চেয়ে বয়স্করা থাকলে তাঁদের নিয়ে চিন্তার কারণ বেশি দেখা দিচ্ছে। কোনও অবস্থাতেই বাড়ির বাইরে বা কোনও জমায়েতে (যেমন ক্লাব, বাজার, অনুষ্ঠানবাড়ি ইত্যাদি) যাওয়া চলবে না। বাড়িতে বয়স্ক ব্যক্তি, গর্ভবতী, ছোট বাচ্চা বা অন্য কোনও অসুস্থ ব্যক্তির কাছাকাছি যাওয়া নিষেধ।
কাপড়ের থ্রি লেয়ার মাস্ক এখন সবচেয়ে নিরাপদ বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। ফাইল ছবি।
চিকিৎসক অরিজিৎ রায়চৌধুরী বললেন, “কোভিড পজিটিভ মানুষের সংস্পর্শে আসা মানুষ যাঁরা বাড়িতে কোয়রান্টিনে আছেন তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তা প্রতিরোধ করার জন্য হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন খেতে পারেন। দেখা গিয়েছে তাতে সংক্রমণের আশঙ্কা কমে।”
মাস্কের ব্যবহার
বাড়ির অন্য সদস্যদের সঙ্গে একই ঘরে থাকলে, বিশেষ করে এক মিটারের মধ্যে আসার সময় কোয়রান্টিনে থাকা ব্যক্তিকে মাস্ক পরতে হবে। অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। তবে মাস্ক পরা নিয়ে সতর্ক করেছেন চিকিৎসক তনভির রেজা। তিনি বলেন, “এখন চারিদিকেই ভাল্ভ দেওয়া মাস্কের খুব কদর। কিন্তু আমরা বেশির ভাগই জানি না কাপড়ের তিন লেয়ার মাস্কের তুলনায় এই মাস্ক বেশি ক্ষতিকারক। ভাল্ভ দেওয়া মাস্কের সাহায্যে সহজেই মুখ থেকে অক্সিজেন বাইরে বেরিয়ে যায়। কোভিডে আক্রান্ত মানুষ না জেনেই ভাল্ভ পরা মাস্কের সাহায্যে যে ভাবে নিঃশ্বাস ছড়িয়ে বেড়াবেন তাতে সংক্রমণ কমার চেয়ে বাড়বে বেশি।” কাপড়ের থ্রি লেয়ার মাস্ক এখন সবচেয়ে নিরাপদ বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা, যা দীর্ঘ দিন চলে। অন্যান্য মাস্ক ব্যবহার করলেও তা ১০-১৫ দিনের বেশি ব্যবহার করা উচিত নয়। ব্যবহৃত মাস্ক ঢাকনাযুক্ত ময়লার পাত্রে ফেলতে হবে এবং সাবান দিয়ে ভাল ভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে। কোয়রান্টিনে থাকা ব্যক্তির ঘরের মেঝে এবং বাথরুম প্রতি দিন ব্লিচিং পাউডার মেশানো জল বা ফেনলযুক্ত ‘বাথরুম ক্লিনার’ দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে কোয়রান্টিনে থাকা ব্যক্তির জামাকাপড়, বিছানাপত্র আলাদা ভাবে (বাড়ির অন্য লোকজনের জামাকাপড়ের সঙ্গে নয়) কাচাকুচি করতে হবে। সাধারণ ডিটারজেন্ট বা সাবান ব্যবহারই যথেষ্ট। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী যেমন মনে করেন, গোষ্ঠী সংক্রমণ আটকানোর জন্যই এই হোম কোয়রান্টিনের নিয়ম চালু করা হয়েছে। তাই কোয়রান্টিনের নির্দেশাবলী অক্ষরে অক্ষরে পালন করা উচিত।
আরও পড়ুন: কোভিড হানা কমেনি, বর্ষায় ঘরবাড়ি পরিষ্কার করতে এ সব বাড়তি সতর্কতা নিতেই হবে
ডায়েট
ডায়েটিশিয়ান রেশমি রায়ের মতে, এই সময় পুরোপুরি বাড়ির খাবার খেতে হবে।কার্বোহাইড্রেট বাদ দিলে চলবে না। সঙ্গে হাই প্রোটিন ডায়েটের দিকে নজর রাখতে হবে। রোজের পাতে ডিম, মুর্গি, সবুজ শাকসব্জি থাকতেই হবে। “ভরপেট খাবার খাওয়া এ সময়ে সবচেয়ে জরুরি। খিচুড়ি খেতে পারেন। এতে হলুদ, জিরে, এই ধরনের মশলা পড়ে যা শরীরের ইমিউনিটি বাড়াতে সাহায্য করে”, যোগ করলেন রেশমি। খাবারের সঙ্গে মরসুমি ফল খাওয়াও জরুরি বলে তিনি মনে করছেন।
আরও পড়ুন: মানসিক চাপ কমাতে মদ্যপান? বাড়ছে কোভিডের ঝুঁকি
ওষুধ
হোম কোয়রান্টিনে থাকার সময় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য চিকিৎসকেরা কিছু ওষুধের কথা বলছেন। চিকিৎসক তনভির রেজা যেমন বললেন, “আমি মাল্টিভিটামিন, ভিটামিন সি আর ক্যালসিয়াম-সহ ভিটামিন ডি খেতে বলছি সকলকে।বলছি না, এই ওষুধ খেলে করোনা হবে না। এই ওষুধ খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধের লড়াই করার ক্ষমতা বাড়বে, এটাই ভাবা হচ্ছে। এ ছাড়াও যে যা ওষুধ এত দিন ধরে খেয়ে আসছেন সেগুলো একেবারেই বন্ধ করবেন না।”
মন আর শরীর
কোয়রান্টিনে থাকা ব্যক্তির মানসিক অবসাদ, হতাশা, রাগ, অসহায়তা, অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। কেমন করে পেরিয়ে যাবেন সেই সব দিন? মেন্টাল আক্টিভিস্ট রত্নাবলী রায় বললেন, “করোনা মানে মৃত্যু নয়। ভিতরের এই সংঘাত থেকে মানুষকে নিজেকেই বেরিয়ে আসতে হবে। উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা মানুষের সারা জীবনের সঙ্গী। দেখতে হবে তা যেন আমাদের কাবু না করে বসে। কোভিড চলে গেলেও তা থাকবে। আর উদ্বেগ থাকলেই মানুষ সেখান থেকে নতুন কিছু সৃষ্টি করবে। তাই বাড়িতে থাকলে নিজে যা করতে ইচ্ছে সেগুলো করুন।” রত্নাবলী বলেন, এই সময় মানুষ মনের চর্চা করুন, ইচ্ছেমতো ভাবুন। শরীরের ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে কিছু করে দেখানোর দায় থেকে মুক্ত রাখুন নিজেদের।
মনের চর্চা করুন ইচ্ছেমতো, বলছেন মানসিক স্বাস্থ্যবিদরা। ফাইল ছবি।
যা যা করতে পারেন কোয়রান্টিনে
পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ফোন, মোবাইল বা ইন্টারনেটে যোগাযোগ রাখতে পারেন। কোনও শিশুকে কোয়রান্টিনে রাখতে হলে তাকে আলাদা করে সময় দিতে হবে।পর্যাপ্ত খেলার সামগ্রী দিতে হবে তাকে এবং খেলনাগুলো খেলার পরে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। খুব ক্লান্ত না হলে করতে পারেন অফিসের কাজ।