যখন শরীরের অন্য কোনও অঙ্গ-প্রত্য়ঙ্গে ক্যানসার হয়, তখন সেটি ছড়িয়ে পড়তে পারে যকৃতেও। প্রতীকী ছবি।
মস্তিষ্ক হল ব্রহ্মা। হৃদযন্ত্র বিষ্ণু, আর যকৃৎ অর্থাৎ লিভার হল মহেশ্বর!— শাস্ত্রে উল্লেখিত ত্রিদেবের সঙ্গে এ ভাবেই মানবদেহের তিনটি অঙ্গকে তুলনা করা হত এক সময় গ্রাম-বাংলায়। বস্তুত, যকৃতের গুরুত্ব সাংস্কৃতিক ইতিহাসে অপরিসীম। প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় যকৃৎকে তুলনা করা হয়েছে আত্মার সঙ্গে। হিন্দি বা উর্দুতে যকৃৎকে বলাই হয় ‘জিগর’।
যে কোনও রোগ হলে সেটির চাপ পড়ে যকৃতের উপরে। গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরীর কথায়, লিভার আমাদের শরীরের প্রহরী। এই প্রহরী মাঝেমধ্যেই বিপর্যস্ত হতে পারে, কর্কটের ছোবলে। বর্তমানে মহিলাদের ক্ষেত্রে যেমন জরায়ু মুখের ক্যানসার আর ব্রেস্ট ক্যানসার ভীষণ ভাবে দেখা যাচ্ছে, তেমনই পুরুষদের ক্ষেত্রে লিভার ক্যানসার। একটি সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের এই রোগে মৃত্যুর সম্ভাবনা তিন গুণ বেশি।
কত ধরনের
চিকিৎসক অভিজিৎ জানাচ্ছেন, যকৃতের ক্যানসার মূলত দু’ধরনের:
নানা ধরনের অসুখ থেকে শরীরকে ও নিজের কোষগুলিকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যকৃৎ। সেটা করতে গিয়ে অনেক সময়ে ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারে। একে বলে ‘প্রাইমারি লিভার ক্যানসার’ বা ‘হেপাটোসেলুলার (এইচসিসি) ক্যানসার’।
যখন শরীরের অন্য কোনও অঙ্গ-প্রত্য়ঙ্গে ক্যানসার হয়, তখন সেটি ছড়িয়ে পড়তে পারে যকৃতেও। এ ক্ষেত্রে সেটিকে ‘সেকেন্ডারি লিভার ক্যানসার’ বা ‘মেটাস্ট্যাটিক লিভার ক্যানসার’ বলা যেতে পারে। প্রাইমারি লিভার ক্যানসার খুব একটা দেখা যায় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেকেন্ডারি লিভার ক্যানসার দেখা যায়।
ক্যানসার বিশেষজ্ঞ শঙ্করকুমার নাথ জানাচ্ছেন,
আমাদের জীবনধারা কিংবা জিনগত কারণে যকৃতের ক্যানসার হতে পারে।
ওজন বেশি হলে ও তা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা না করলে বাড়তে পারে এই রোগের সম্ভাবনা।
মদ্যপানও ক্ষতি করে যকৃতের।
হেপাটাইটিস বি বা সি-এর জন্য যকৃতে সংক্রমণ ঘটে। জন্ডিসে আক্রান্ত হলেও বাড়তে পারে এই ক্যানসারের আশঙ্কা।
অনেক সময়ে খাবারে অণুজীব, ছত্রাক বা নানা জীবাণু থেকে যায়। তা থেকেও ক্যানসারের আশঙ্কা থাকে। অনেকেরই অভ্যাস, দীর্ঘদিন ধরে আচার বা ওই ধরনের খাবার ফেলে রাখা। একটা সময় পরে তাতে ছত্রাকের জন্ম হয়। এই ছত্রাকের মধ্যে থাকে আফলাটক্সিন, যা যকৃতের ক্যানসারের জন্য দায়ী।
প্রতীকী ছবি।
উপসর্গ কী
প্রথমেই প্রকট নয়: চিকিৎসকদের মতে, যকৃতের কোনও রোগের উপসর্গ প্রথমেই প্রকট হয় না। তাই ক্যানসার হয়ে থাকলেও তা ধরা দেয় অনেক পরে। প্রাইমারি লিভার ক্যানসারের ক্ষেত্রে ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে দেখা দিতে পারে এটির উপসর্গ। কিন্তু সেকেন্ডারি লিভার ক্যানসারের উপসর্গ প্রকট হওয়ার কোনও বয়স থাকে না। যখন অন্য কোনও অঙ্গে ক্যানসার হয়, তখন সেই অনুযায়ী ছড়াতে পারে এটির উপসর্গ। সাধারণত, অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, রক্ত বমি হওয়া, পেটের উপরের দিকে কিছুটা ব্যথা হওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। খিদে কমে যাওয়াও এর একটি লক্ষণ হতে পারে।
সিরোসিস ও ক্যানসার: চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী অবশ্য জানাচ্ছেন, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, বমি কিংবা পেটব্যথার উপসর্গ যকৃতের সিরোসিসের রোগীদের মধ্যেও দেখা যায়। কিন্তু, ক্যানসার আর সিরোসিসের উপসর্গ এক হলেও এই দু’টি রোগ এক নয়। যখন কোনও দীর্ঘকালীন রোগে কেউ (যেমন, ডায়াবিটিসে) ভুগতে থাকেন কিংবা অত্যধিক মদ্যপান করেন, তখন রোগীর শরীর চেষ্টা করে ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলিকে সারিয়ে তোলার। এই সময় যকৃতের মধ্যে থাকা কিছু ‘ফাইব্রাস টিসুর’ মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া নষ্ট হয়ে যায়। এর থেকে হয় ‘স্কারিং অব লিভার’ অর্থাৎ সিরোসিস। এই দু’টি রোগের উপসর্গ প্রায় একই হওয়ার কারণে অনেক সময়েই রোগী বা তাঁর পরিবার বুঝতে দেরি করেন। এতে চিকিৎসায় দেরি হয়। ধরা হয়, হাজার জনের সিরোসিস থাকলে, তাঁদের মধ্যে এক জনের হয়তো যকৃতে ক্যানসার দেখা দিতে পারে।
চিকিৎসা কী ভাবে
‘আর্লি ডিসকভারি ইকুয়ালস টু আর্লি রিকভারি’, ক্যানসারের চিকিৎসায় এই কথাটির জুড়ি মেলা ভার। এখন উন্নত মানের প্রযুক্তির সাহায্যে লিভার ক্যানসার প্রাথমিক পর্যায়েও ধরা পড়ে। ফলে চিকিৎসাও শুরু করা যায় দ্রুত। মূলত দু’ধরনের চিকিৎসা করা সম্ভব: ‘কিয়োরেটিভ ট্রিটমেন্ট’ ও ‘প্যালেটিভ ট্রিটমেন্ট’। যদি দ্বিতীয় বা তার পরের পর্যায়ে ধরা পড়ে, তবে ‘প্যালেটিভ’ চিকিৎসা করা যেতে পারে। এতে, শরীরের যে উপসর্গটি ধরা পড়বে, সেই অনুযায়ী চিকিৎসা হবে।
যদি প্রথম দু’টি পর্যায়ে রোগ ধরা পড়ে, তবে ‘কিয়োরেটিভ’ চিকিৎসা করার পরামর্শ দিচ্ছেন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ শঙ্করকুমার নাথ। তিনি জানাচ্ছেন, প্রাইমারি লিভার ক্যানসারের ক্ষেত্রে শরীরের যে অঙ্গটিতে টিউমর ধরা পরে, সেই টিউমরটিকে অস্ত্রোপচার করে বাদ দেওয়া হতে পারে।
এখন যকৃৎ প্রতিস্থাপনও সম্ভব। আবার, কেমোথেরাপির সাহায্যে যকৃতের ক্যানসারকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ক্যানসার-রোধী ওষুধ শরীরের কোষগুলিতে প্রবেশ করিয়ে সেগুলি ধ্বংস করে দেওয়া যায়। তাতে কিছু সময়ের জন্য এই বৃদ্ধি আটকানো যেতে পারে।
ক্যানসারের চিকিৎসায় ‘টার্গেটেড থেরাপি’ জনপ্রিয়। এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে শরীরে বাসা বেধে থাকা ক্যানসার কোষ নির্দিষ্ট ভাবে নষ্ট করা সম্ভব। রেডিয়োথেরাপিও জনপ্রিয় একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। তবে, যে স্টেজেই ধরা পড়ুক আর যে ভাবেই চিকিৎসা হোক, জরুরি হল, মনোবল বজায় রাখা।
যকৃতের যত্নে
মদ্যপান ছাড়তে হবে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখতে স্বাস্থ্যসম্মত খাওয়া ও ব্যায়াম অভ্যাস করা।
হেপাটাইটিস প্রতিরোধ করতে, হেপাটাইটিসের টিকা নেওয়া আবশ্যক।