Parenting Tips

মনের মুক্তো চিনুক দত্তক সন্তান

দত্তক সন্তানের সঙ্গে আস্থা ও মায়ার বাঁধন শক্ত রাখুন। তা হলেই পরিস্থিতির ঝড়ঝাপটা, সমাজের অসংবেদনশীলতা তার নরম মনে আঁচড় কাটতে পারবে না।

Advertisement

চিরশ্রী মজুমদার 

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৪:৪৮
Share:

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

দত্তক সন্তানের জন্ম হয় মা-বাবার মনের ইচ্ছে, তাঁদের আত্মা থেকে। অনেকের মতে, জৈবিক সন্তানকে কোলে পেতে মাকে আট-দশ মাস শারীরিক কষ্ট পেতে হয়, দত্তক সন্তানের ক্ষেত্রে ধারণ ও বহনের প্রক্রিয়াটি আরও কষ্টকর, দীর্ঘতর। এই পদ্ধতিতে বেশ কয়েক বছর লাগে। এমনকি, প্রক্রিয়ার ভার আজীবনও বইতে হতে পারে। তারই একটি অংশ, দত্তক সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন। তবে, এমন শিশুর আচরণগত সমস্যা, মনোজগতের আলোড়ন যে অন্যদের তুলনায় বেশি— গবেষণায় এমন কোনও প্রমাণ মেলেনি। তবে, যেহেতু এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কিছুটা আলাদা, তাই কিছু চ্যালেঞ্জ থাকতে পারে। তার জেরে সন্তানের মধ্যে হতাশা, অবসাদ, ক্ষোভ বা হীনম্মন্যতা দেখা দিতে পারে। এমনই কয়েকটি পরিচিত পরিস্থিতি বেছে নিয়ে, তা সামলানোর পথ দেখালেন মনোবিদ ও সমাজকর্মীরা।

Advertisement

বিশ্বাস করতে শেখান

ভারতে একমাত্র সরকারি শিশু ও নারী কল্যাণ দফতরের অন্তর্গত ‘সেন্ট্রাল অ্যাডপশন রিসোর্স অথরিটি’ (কারা)-র মাধ্যমে আইনত দত্তক নেওয়া যায়। ‘কারা’ পরামর্শ দেয়, বহির্জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটার আগে শিশুকালেই গল্পচ্ছলে সন্তানকে মা-বাবা দত্তকের বিষয়টি জানাবেন। মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, “আকস্মিক অন্য কারও কাছ থেকে এই তথ্য প্রকাশ পেলে অভিভাবকের প্রতি আস্থা ক্ষুণ্ণ হতে পারে। টিনএজ-এ জানলে সমস্যা বাড়বে। বিষয়টি গোপন রাখলে পারিবারিক রোগের ইতিহাস সম্পর্কেও ভ্রান্ত তথ্য থাকবে, চিকিৎসায় সমস্যা হবে।”

Advertisement

অনুত্তমার পরামর্শ, জৈবিক বাবা-মা, পালক অভিভাবক— কারও প্রতি যেন সন্তানের বিশ্বাসটা নষ্ট না হয়। তিনি বললেন, “বাচ্চার চেহারা, আচরণ বা মেধা অনেক সময়েই মা-বাবার সঙ্গে না-ই মিলতে পারে। জৈব সন্তানের ক্ষেত্রেও তো এমনটা হয়। কিন্তু পালিত সন্তানের ক্ষেত্রে এখনও প্রতিবেশী বা আত্মীয়দের অনেকেই দত্তক প্রসঙ্গটি টেনে বিষয়টিকে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেন। এমন কথা কানে এলে বাবা-মা সন্তানের সঙ্গে বারবার কথা বলে বোঝান যে বিষয়টি এ ভাবে নির্ধারিত হয় না। মা-বাবাকেও সংবেদনশীল ও সতর্ক থাকতে হবে যাতে সন্তানের আচরণগত সমস্যা হলে কখনও তার দত্তক পরিচয়টিকে সামনে এনে কোনও ইঙ্গিত যেন না করে ফেলেন। বিশেষত, টিনএজে রাগারাগি, মতের অমিল হলে সন্তান মনে করতে পারে যে এরা আমার নিজের মা-বাবা নয় বলে এ ভাবে বলছেন। তাকে বোঝান, আচরণ সংশোধনের জন্যই শাসন করা হচ্ছে। নিজেদের জৈব সন্তান থাকলে, দত্তক সন্তানকে দুষ্টুমির জন্য বকাবকির সময় তুলনামূলক কথা বলবেন না।

“জন্মদাতারা কেন তাকে ছেড়ে গেলেন— তা ভেবে বাচ্চা কষ্ট পেতে পারে। বর্তমান অভিভাবক অভিমান করবেন না, জৈবিক মা-বাবার সম্পর্কে কটু কথা বলবেন না। সময় এলে বুঝিয়ে বলুন তাঁরা কেন সঙ্গে থাকতে পারলেন না। এ ভাবে বলা যায়— তিনি বুঝেছিলেন তাঁর কাছে তোমার সুরক্ষা, পরিচর্যা ঠিক হবে না। তাই এমন ব্যবস্থা করেছেন যেখানে তুমি ভাল আছ।”

সান্নিধ্য উপহার দিন,বন্ধন দৃঢ় হবেই

দত্তক সন্তানের মা-বাবাদের সমস্যা আলোচনা করে সমাধান বার করতে কাজ করছে সহায়তা গোষ্ঠী আত্মজা। তাঁদের পক্ষ থেকে সীমন্তিকা নাগ জোরের সঙ্গে বললেন, “দত্তক সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের মিল থাকবে না— এ ধারণার উল্টোটা বহু বার দেখা গিয়েছে। তাই এ নিয়ে মনমরা হওয়ার কারণ নেই। সে হয়তো বাবার চোখের রং, মায়ের চুলের ঘনত্ব পায়নি। কিন্তু দেখা গেল সে বাবার মতোই চোখ কুঁচকে তাকায়, মায়ের মতো করে কথা বলে। অর্থাৎ সে তাঁদের ‘ম্যানারিজ়ম’, কোনও না কোনও বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার পেয়েছে।”অনুত্তমার মতে, গর্ভাবস্থা থেকে সে আপনার সঙ্গে নেই, স্তন্যপান করেনি বলে পারস্পরিক স্নেহবন্ধন আলগা হবে, এমন ভাববেন না। যে বয়স থেকে তাকে পেলেন, তখন থেকেই তার মধ্যে নিজেকে, নিজেদের মূল্যবোধকে মিশে যেতে দিন। মায়ের ঘুমপাড়ানি গান, আবৃত্তি শোনার মধ্য দিয়েই সে মায়ের ‘স্পর্শ’সুখ অনুভব করুক। বাবার কাছে গল্প শুনে তাঁর সঙ্গে সংযোগ গাঢ় হোক।

১৮ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেমেয়ে দত্তক নেওয়া গেলেও অবোধ শিশুকে ঘরে আনার প্রবণতাই বেশি। কারণ জ্ঞান হওয়া ইস্তক সে পালক বাবা-মাকে অবলম্বন জানবে, টান অনুভবে সমস্যা হবে না। অনেকেই দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন যে একটু বড় বাচ্চা আনলে সে হয়তো নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারবে না। আগের স্মৃতির কারণে তার মন রুক্ষ হবে। সীমন্তিকা আশ্বাস দিচ্ছেন, “বাচ্চাটি তো স্থায়িত্বই খুঁজছে। একসঙ্গে থাকতে থাকতে আদর-যত্ন পাবে, তখন নির্ভরতা, ভালবাসা, বিশ্বাসের ভিত শক্ত হতে শুরু করবে। বড় বাচ্চার ক্ষেত্রে আগের কষ্ট ভোলাতে, হোমে থাকার অভ্যাসগুলি বদলাতে সময় লাগে। মা-বাবাকে একটু বেশি ধৈর্যশীল, সহমর্মী হতে হবে।”

বাবা-মায়ের ঢাল

দত্তক নেওয়ার আগে ও পরে কারা আয়োজিত কাউন্সেলিং সেশনে সম্ভাব্য পরিস্থিতির জন্য মা-বাবাকে প্রস্তত করা হয়। যে কোনও সাহায্য, পরামর্শের জন্য সব সময় রয়েছে আত্মজা-র মতো গোষ্ঠীগুলি। এঁরা একমত, দত্তক সন্তানকে আগলে রাখার প্রথম শর্ত একসঙ্গে সত্যের মুখোমুখি হওয়া। সে ক্ষেত্রে যে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে একে অপরের ঢাল হয়ে দাঁড়ানো যাবে। মা-বাবা শক্ত থাকলে, মন খারাপ না করলে সন্তানের মনেও সেই ঘটনার কোনও প্রভাব পড়বে না।

ছবি: অমিত দাস, জয়দীপ দাস

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement