মধ্যবিত্ত পরিবারে ফ্যাটি লিভার, সিরোসিস অব লিভার... এই রোগের নামগুলি আর অচেনা নয়। রোগে আক্রান্ত হলে মানুষ যতটা সাবধান হন, আগেভাগে সচেতন হলে এর কিছুটা অন্তত ঠেকানো সম্ভব। কারণ লিভারের রোগের একটি বড় কারণ জীবনযাপনের ধরনের সঙ্গে যুক্ত। তবে সেটিই একমাত্র কারণ নয়।
লিভারের গুরুত্ব
চিকিৎসকদের মতে, একটা হাত বা পা না থাকলেও মানুষ বাঁচতে পারে। কিন্তু লিভারের কার্যক্ষমতা নষ্ট হলে মানুষকে বাঁচানো যায় না। কারণ লিভার শরীরের সব ধরনের কাজে জরুরি। খাবার হজম করতে সাহায্য করে লিভার। শরীরের এনার্জি উৎপাদন হয় লিভারে। বর্জ্য পদার্থের নিষ্কাশনেও সহায়ক লিভার।
তবে যকৃতের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, যার ফলে লিভারজনিত রোগের উপসর্গগুলি ধরা পড়ে দেরিতে। চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদারের মতে, ‘‘লিভারের ১/৮ ভাগ যদি কোনও কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে শরীর তা নিজে নিজেই সারিয়ে নিতে পারে।’’ কিন্তু লিভার যদি কোনও কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন কিন্তু এই স্বয়ংক্রিয় মেরামতি সম্ভব হয় না। তখন নানা উপসর্গ দেখা দিতে থাকে। ডা সুবীর কুমার মণ্ডলের মতে, ‘‘ফ্যাটি লিভারের সমস্যা অনেকেই বুঝতে পারেন না প্রথমে। তাঁরা অন্য কোনও উপসর্গের জন্য ইউএসজি করান। তখন হয়তো ফ্যাটি লিভারের সমস্যা ধরা পড়ছে।’’
রোগের প্রকারভেদ
লিভারের রোগগুলিকে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যায়— জেনেটিক, সংক্রমণজনিত আর লাইফস্টাইলঘটিত। জীবনযাপন-জনিত কারণেই দেখা দেয় ফ্যাটি লিভার ডিজ়িজ়। হেপাটাইটিসের অনেক কারণের মধ্যে সংক্রমণ একটি ফ্যাক্টর। আর লিভারে কপার বা আয়রন জমার ফলে যে সমস্যা তৈরি হয়, সেটা জেনেটিক। অতিরিক্ত আয়রন জমেও সমস্যা তৈরি হতে পারে। এটিকে বলা হয় হিমোক্রোমাটোসিস।
ফ্যাটি লিভার ডিজ়িজ়: এটিকে দু’টি ভাগে ভাগ করা যায়, নন-অ্যালকোহলিক এবং অ্যালকোহলিক। নাম থেকেই স্পষ্ট, অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে লিভারে ফ্যাট জমলে তাকে বলা হয় অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার। এটি ধরা পড়লে রোগীকে সচেতন হতে হবে। মদ্যপান পরিহার করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
চিকিৎসকদের মতে, ফ্যাটি লিভারের সমস্যা এ দেশে এখন দ্রুত হারে বাড়ছে। তার কারণ সেডেন্টারি লাইফস্টাইল। অ্যালকোহল ছাড়া অন্য কোনও কারণে লিভারে ফ্যাট জমলে সেটিকে বলা হয় নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার। ডায়াবিটিস, ওবেসিটি, শারীরচর্চার অভাব, অতিরিক্ত জাঙ্ক ফুড খাওয়া... এ সবের কারণে এই রোগ হয়। অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারের মতো বিপজ্জনক না হলেও এই রোগেও রোগীকে সচেতন থাকতে হবে। নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ এ দেশের মানুষদের জিনগত কারণেই লিভারে ফ্যাট জমার প্রবণতা বেশি। জিনের উপরে যখন মানুষের হাত নেই, তখন সুষম জীবনযাপনের অভ্যেস গড়ে তোলার উপরেই জোর দিতে হবে।
হেপাটাইটিস
পুরনো লোহিত রক্তকণিকা অর্থাৎ যাদের কার্যক্ষমতা অবলুপ্ত বা কমে গিয়েছে, সেগুলি ধ্বংস হয়ে তৈরি হয় বিলিরুবিন নামক পদার্থ। নিয়মিত মল-মূত্রের সঙ্গে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিলিরুবিন শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। বাকিটা লিভার তার কুপ্রভাব মুক্ত করে গলব্লাডারে পাঠিয়ে দেয়।
লিভারের কোষের মধ্যে কতকগুলো সরু নালি রয়েছে। এই নালিগুলো দিয়ে বিলিরুবিন গলব্লাডারে পৌঁছয়। যখন এই কোষের দেওয়ালগুলো ফুলে যায়, তখন নালিগুলির মধ্য দিয়ে বিলিরুবিন যেতে পারে না। ফলে তা রক্তে জমতে জমতে জন্ডিসের আকার ধারণ করে। ইনফেকটিভ জন্ডিসের এটাই কারণ।
এ ছাড়া আরও দু’টি কারণে জন্ডিস হতে পারে। প্রথমত, বিলিরুবিন উৎপাদনের মাত্রা যদি লিভারের কার্যক্ষমতার চেয়ে বেড়ে যায়, তখন রক্তে বিলিরুবিন জমতে থাকে। দ্বিতীয়ত, লিভারে হয়তো কোনও সমস্যা নেই, কিন্তু তার আশপাশে অগ্ন্যাশয় ও গলব্লাডারে টিউমর, স্টোন বা ক্যানসারের কারণে ওই নালিগুলির মুখে বাধা তৈরি হচ্ছে। যার ফলে বিলিরুবিন ঠিক জায়গায় পৌঁছতে না পেরে রক্তে জমছে। একে বলা হয় অবস্ট্রাকটিভ জন্ডিস। জেনারেল ফিজ়িশিয়ান সুবীর কুমার মণ্ডলের কথায়, ‘‘জন্ডিস হতে পারে বলে সব সময়ে ফুটিয়ে জল খাওয়া কোনও সমাধান হতে পারে না।’’
চিকিৎসকদের মতে, লিভার ভাল রাখার জন্য আলাদা করে কিছু খেতে হবে, জরুরি নয়। সুষম খাদাভ্যাসের বিকল্প নেই। যদি মনে হয় সমস্যা হচ্ছে, অবিলম্বে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তাঁর পরামর্শমতো বর্জনীয় খাবারগুলি অবশ্যই বাদ দিন।
ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় লিভারের রোগ
কয়েকটি রোগের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় লিভারে ক্ষত তৈরি হতে পারে। যেমন, এপিলেপ্সি, টিবির কিছু ওষুধে লিভারে অতিরিক্ত কপার জমা হয়। ডা. তালুকদারের মতে, ‘‘রোগীকে ওষুধ দেওয়ার এক মাস পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা হয়। হলুদ ইউরিন হওয়া বা অন্য কোনও সমস্যা শরীরে তৈরি হচ্ছে কি না, তা রোগী যেন লক্ষ রাখেন। এক মাস পরে রক্ত পরীক্ষা করেও দেখা হয়। যদি অসুবিধে হয়, ওষুধ বদলে দেওয়া হয়।’’
লিভারের রোগের উপসর্গ এবং ক্ষতির পর্যায়ক্রম
সমস্যার প্রথম ধাপ, লিভারের আকার বড় হয়ে যাওয়া। তার পর ফ্যাটি লিভার, ফাইব্রোসিস, সিরোসিস এবং ক্যানসার। প্রতিটি ধাপে পরিস্থিতির অবনতি হতে সময় লেগে যায় কয়েক বছর। তাই প্রথম ধাপ থেকেই সচেতন হন।
ফ্যাটি লিভারের সমস্যা বাড়লে খাবার হজম না হওয়া, গা বমি করা এমন কিছু উপসর্গ দেখা যাবে। এই পর্যায়ে সতর্ক না হলে জন্ডিস হতে পারে। তবে ঘন ঘন জন্ডিস হওয়া কোনও কঠিন রোগের লক্ষণ হওয়াও অসম্ভব নয়।
লিভার সুস্থ রাখতে সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা আর সুস্থ জীবনযাপন করা উচিত।