তিতাসকে নিয়ে তানিয়ার ঝামেলার শেষ নেই। সাড়ে তিন বছরের ছেলেটার দুষ্টুমিতে সক্কলে অতিষ্ঠ। এই গ্রিল বেয়ে জানলার উপরে উঠে গেল, তো এই টিভি-র স্ক্রিন বল মেরে ফাটিয়ে দিল। সর্বক্ষণ ‘ধর, ধর’, ‘দেখ, দেখ’ কাঁহাতক আর ভাল লাগে? অফিস গিয়েও শান্তি নেই তানিয়ার। প্রতি ঘণ্টায় বাড়ি থেকে ছেলের নামে নালিশ আসছে ফোনে।
দুষ্টুমির ধরন
শিশুরা এক জায়গায় বসে থাকবে না, দুষ্টুমি করবেই— সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু সে দুষ্টুমিরও মাত্রাভেদ আছে। কোনও শিশু যদি মারাত্মক দুষ্টু হয় এবং বয়সের সঙ্গেও তাতে লাগাম পরার চিহ্নমাত্র না থাকে, তবে সে দুষ্টুমিকে ঠিক স্বাভাবিকের পর্যায়ের ফেলা যায় কি? পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষের মতে, এই সব ক্ষেত্রে প্রথমেই দুষ্টুমির ধরন জানাটা খুব জরুরি।
সাধারণত শিশুর দুষ্টুমির ভিতর তিন ধরনের প্যাটার্ন লক্ষ করা যায়— কিছু জন হাতেপায়ে চঞ্চল। অর্থাৎ, এরা স্থির ভাবে কোথাও একটানা বসতে বা দাঁড়াতে পারে না। দ্বিতীয়ত, কিছু বাচ্চার মধ্যে আক্রমণাত্মক আচরণ দেখতে পাওয়া যায়। এরা হাতের কাছে থাকা জিনিসপত্র ছোড়ে, ভাঙচুর করে, অযত্ন করে অথবা আচমকা কাউকে আঁচড়ে, কামড়ে দেয়, মারধর করে, থুতু দেয় ইত্যাদি। তৃতীয়ত, আর এক ধরনের বাচ্চাদের আবার হাতেপায়ে দুষ্টুমির চিহ্ন তেমন দেখা দেয় না। কিন্তু এরা অন্যকে বিপদে ফেলতে ভালবাসে।
হাইপারঅ্যাক্টিভ শিশু
প্রথম ধরনের শিশুদের ক্লিনিক্যাল টার্মে বলা হয় হাইপারঅ্যাক্টিভ। এই সমস্যাকে বলা হয় অ্যাটেনশন ডেফিসিট অ্যান্ড হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজ়অর্ডার বা এডিএইচডি। সে ক্ষেত্রে প্রথমে দেখা প্রয়োজন শিশুর এমন অস্বাভাবিক চঞ্চলতার কারণ কী? হাইপারঅ্যাক্টিভ শিশু নিজেদের অপরিসীম এনার্জিকে ব্যয় করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু ফ্ল্যাট বা বাড়ির স্বল্প পরিসরে সেটা সব সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এ ক্ষেত্রে মা-বাবাকে তিন রকমের দায়িত্ব পালন করার পরামর্শ দিচ্ছেন পায়েল। বাচ্চাদের অন্তত নব্বই মিনিট থেকে দু’ঘণ্টা মাঠে বা খোলা জায়গায় ছেড়ে দিতে হবে, যেখানে সে ইচ্ছে মতো দৌড়ঝাঁপ, খেলা করতে পারবে। একটানা না করে সময়টা দু’ভাগে ভাগ করে দেওয়া যায়, তা হলে আরও ভাল। মা-বাবা যদি চাকরি করেন, তা হলেও অন্য কাউকে প্রতি দিন এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাদের মিউজ়িক্যাল ইনস্ট্রুমেন্টের প্রতি আকৃষ্ট করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাজনা খুব ভাল কাজ করে। মিউজ়িক থেরাপির মধ্য দিয়ে শিশুদের নার্ভাস সিস্টেমের এই ইর্যাটিক মুভমেন্টের উপরে প্রলেপ পড়ে। তাদের মন শান্ত হয়।
কেমন হবে ঘুমের ধরন?
গুরুত্ব দেওয়া উচিত বাচ্চাদের স্লিপ সাইকলের উপরও। এই ধরনের শিশুরা সাধারণত দুপুরবেলায় অনেকক্ষণ ঘুমোয়। ফলে রাতে তারা পরিপূর্ণ এনার্জি নিয়ে বহুক্ষণ জেগে থাকে। সারা দিন তারা শুধুমাত্র এনার্জি খরচের জন্য দৌড়ঝাঁপ করে, তা নয়। ঘুম ঠিকমতো না হলে এদের শরীরে একটা অস্বস্তি হতে থাকে। ইর্যাটিক বিহেভিয়রের এটিও একটা কারণ। ঘুমের সাইকল ব্যাহত হলে অনেক শিশুই রেস্টলেস হয়ে যেতে পারে। হাইপারঅ্যাক্টিভ শিশুদের দুপুরের ঘুমোনোর সময় কোনও ভাবে দেড় ঘণ্টার বেশি হবে না। আর রাতে ঘুমের সময় সাড়ে ন’টা-দশটা থেকে সকাল ছ’টা-সাতটা।
এই রুটিনে তাদের অভ্যস্ত করা হলে হাইপারঅ্যাক্টিভ শিশুদের সমস্যার সমাধানও তাড়াতাড়িহওয়া সম্ভব।
বাড়ির পরিবেশের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ
যে সব শিশু ভাঙচুর বা মারধর করে, তাদের ক্ষেত্রে দেখতে হবে বাড়ি থেকে তারা এ ব্যাপারে কোনও প্রচ্ছন্ন সমর্থন পাচ্ছে কি না অথবা দুষ্টুমির জন্য তাদের মারধর করা হচ্ছে কি না। হয়তো এমন ধরনের আচরণ তারা কোথাও দেখেছে, সেটাই সে নিজেও প্রকাশ করতে চায়। বাড়িতে হয়তো সে নিয়মিত মার খায়, অথবা মা-বাবার ঝগড়া, চেঁচিয়ে কথা বলা, জিনিসপত্র ভাঙচুরের সাক্ষী। তখন সেই শিশু নিজের মতো করে বুঝে নেয় যে, রাগ হলে হয়তো এটাই করতে হয়।
অনেক সময় শুধু বাড়ির মধ্যে নয়, টিভি বা মোবাইল অথবা গেমসেও সে এমনটা দেখে থাকতে পারে। এ সব ক্ষেত্রে আগে অভিভাবকদের শান্ত, কিন্তু দৃঢ় ভাবে সন্তানের সঙ্গে কথা বলা অভ্যেস করতে হবে। এবং সোজাসুজি সন্তানের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হবে। সরাসরি আই কনট্যাক্ট এই শিশুদের ক্ষেত্রে ম্যাজিকের মতো কাজ করে। এবং প্রয়োজন ‘লজিক্যাল কনসিকোয়েন্স’। যেমন, “যদি তুমি একটা গাড়ি ভাঙো, তা হলে তোমার সমস্ত গাড়ি আলমারির মাথায় উঠে যাবে।” শুধু মা-বাবা নন, পরিবারের অন্য সদস্যদেরও একই আচরণ করতে হবে। আবার শিশুটি যদি নিজেই রাগ সংবরণ করতে পারে, তা হলে তার সেক্ষেত্রে কিন্তু তার প্রশংসাও প্রাপ্য।
যে শিশুরা অন্যকে বিপদে ফেলতে বা বুলি করতে চায়, তাদের ক্ষেত্রে বুঝতে হবে কেন সে এমনটা করছে? অনেক সময়ে বাড়িতে যদি সারাক্ষণ অন্যের সঙ্গে তুলনা চলতে থাকে, শিশুটির সামনেই অন্য আর একটি শিশুকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়, তবে তার মধ্যে একটা প্রতিহিংসাপরায়ণতা তৈরি হতে পারে। তখন সে কাউকে ভাল থাকতে দিতে চায় না। অনেক সময় বাড়িতেও মা-বাবা বা নিকট আত্মীয়রা পরস্পরের সঙ্গে খিটখিটে আচরণ করতে থাকলে সেই আচরণ বাড়ির শিশুটির মধ্যেও দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে শিশুটির সঙ্গে খুব ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করতে হবে। মা-বাবা না পারলে তৃতীয় কোনও ব্যক্তির সাহায্য নিতে হবে। প্রয়োজনে স্কুলের টিচারদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে হবে, যাতে তাঁরা শিশুটিকে বোঝানোর দায়িত্ব নেন। যে মুহূর্তে শিশু নিজেদের নিরাপত্তাহীনতার খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে, সেই মুহূর্তে অন্যদের ক্ষতি করার প্রবণতাও কমে যাবে।
বাচ্চারা দুষ্টুমি করবেই। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই তা শিশুবয়সের ধর্ম মনে করে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। দুষ্টুমির কারণ খুঁজে তার সমাধান করতে হবে। সঠিক সময়ে সমস্যা চিহ্নিত হলে তাতে ভবিষ্যতের আচরণগত সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা যায়।
পৌলমী চট্টোপাধ্যায়