সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ফলের রস খেয়ে স্কুলে যেতেই পছন্দ করে মেঘলা। এতে তার বেশ হালকা লাগে!
রাতের বেলা ওয়েব সিরিজ় দেখতে বসে কখন যে বড় বাটিটার ক্যারামেল পপকর্ন শেষ হয়ে যায়, খেয়াল থাকে না আকাশের।
আবার ক্যান্টিনের ক্রিস্পি চিলি চিকেন ছাড়া ভাবতেই পারে না ঊর্মি।
এই বিষয়গুলো শুরুর দিকে স্বাভাবিক মনে হতেই পারে। কিন্তু কখনও একদম খেতে না চাওয়া, আবার কখনও মুঠোমুঠো খাবার খাওয়া... কোনওটাই স্বাভাবিক লক্ষণ নয়। আর এই অস্বাভাবিকত্ব ধীরে ধীরে ছাপ ফেলে জীবনেও। ‘ইটিং ডিসঅর্ডার’-এর শিকার হয়ে টিনএজারদের কৈশোর তো বটেই, জীবনের ভিতও নড়বড়ে হয়ে যায়।
ইটিং ডিসঅর্ডার কী?
সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন নিয়মিত খাদ্যাভ্যাস। সেই খাবারের তালিকায় থাকতে হবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় সব উপাদানই। কৈশোরে পা রাখা ছেলে বা মেয়েটির বাড়ন্ত বয়সের জন্য বেশি দরকার পুষ্টির। কেউ কেউ কখনও অতিরিক্ত খায়, কেউ আবার কিচ্ছুটি দাঁতে কাটে না। অতিরিক্ত খাবার খাওয়া বা না খাওয়া— দুটোই ইটিং ডিসঅর্ডারের মধ্যে পড়ে।
আবার কখনও যে মেয়েটির বয়স ও উচ্চতার অনুপাতে ওজন একটু বেশি, সে খিদে পেলেও খায় না। বরং না খেয়ে রোগা হওয়ার চেষ্টা করে। এ ছাড়াও প্রায়শই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজের ইচ্ছে মতো ক্রাশ ডায়েট করতে শুরু করে। এটিও ডিসঅর্ডারের লক্ষণ।
কখন চিন্তা করা জরুরি
টিনএজ সন্তানের ওজন এক-দু’কিলো বাড়া-কমা চিন্তার কারণ নয়। কিন্তু ঘনঘন অনেকটা পরিমাণে ওজনের হ্রাস-বৃদ্ধি হলে তলিয়ে ভাবা প্রয়োজন।
অনেক ছেলেমেয়েই খাওয়ার আগে খুঁটিয়ে ক্যালরি মাপার চেষ্টা করে। দৈনন্দিন ক্যালরি গ্রহণের পরিমাপ থাকা জরুরি। কিন্তু প্রত্যেক মুহূর্তে মেপে খাওয়া স্বাস্থ্যকর নয়। ১০০ গ্রামের পরিবর্তে ১২৫ গ্রাম শসা খেলে বিশাল তারতম্য হয় না। তবে সমস্ত পদের ক্ষেত্রেই এই হেরফের হলে অবশ্য মুশকিল।
খাবার খাওয়া হোক বা না হোক, আপনার সন্তান অল্পেই ক্লান্ত হয়ে পড়লে কিংবা দিনের বেশির ভাগ সময়ে ঝিমিয়ে থাকলে চিন্তার বিষয়।
পিরিয়ডসের সাইকল শুরু ও শেষ হওয়ার সময়ে মুড সুইং করে। তা স্বাভাবিকও। কিন্তু তার জন্যই মাত্রাতিরিক্ত খাবার খাওয়া বা একেবারে উপোস করে থাকা ঠিক নয়। সন্তান এই দু’টির কোনওটি করলেই ভাবতে হবে।
গোড়াতেই গলদ
এই জাতীয় ইটিং ডিসঅর্ডারের কারণটা কী? পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বলছেন, ‘‘এর সঙ্গে ভীষণ ভাবে জড়িয়ে আছে স্লিপ ডিসঅর্ডার। অনেক রাত পর্যন্ত স্মার্টফোন আর ট্যাব নিয়ে মগ্ন থাকার ফলে বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে ঘুমোতে যাচ্ছে দেরি করে। ফলে পরের দিন ঘুমও ভাঙছে দেরিতে। ভারী ব্রেকফাস্ট করার ইচ্ছে বা সময় থাকছে না। কম খেয়ে বেরোচ্ছে তারা। এনার্জি লেভেলও কম থাকছে।’’ আবার বহু স্কুলের ঝাঁ চকচকে ক্যান্টিনের পিৎজ়া, বার্গার, ঠান্ডা পানীয় সমস্যা বাড়াচ্ছে। অনেক ছেলেমেয়েই পকেটমানি পেতে অভ্যস্ত। বাড়ির খাবারের পরিবর্তে ক্যান্টিনের বা প্যাকেটজাত খাবারেই তাদের মন বেশি মজে। খাবারের কোয়ালিটি না বুঝে, স্বাদ ভাল বলে সেগুলি খায় তারা।
কেন ক্ষতিকর?
•প্যাকেটের খাবার খেতে ভাল লাগে। কিন্তু তা থেকেই কতশত রোগ বাসা বাঁধছে, তা টের পাওয়া যায় না গোড়ায়। ইটিং ডিসঅর্ডার থেকেই ওবেসিটির প্রবণতা আসে। ওবিস হয়ে গেলে তা আসলে নানা রোগকে নিমন্ত্রণ জানায়।
•হরমোনেরও সমস্যা ডেকে আনে খাবারের অনিয়মিত চর্চা।
•অনেক কম বয়স থেকেই অ্যাসিডিটি, গ্যাসট্রাইটিসের সম্মুখীন হচ্ছে বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা।
•হতাশা, অবসাদ, স্ট্রেসও বাড়তে থাকে। মন খারাপ হলেই মুঠোমুঠো খাবার খাওয়া বা উপোস করে থাকা ঠিক নয়। আবার নেগেটিভ বডি ইমেজ, আত্মবিশ্বাসহীনতার মতো সমস্যা তো রয়েছেই।
কী করণীয়?
•অনেক মা বলেন ‘আমার বাচ্চা তো মোটেও শাক খায় না’, ‘সয়াবিন কী জিনিস, তার স্বাদই জানে না আমার মেয়ে’। এই জাতীয় মনোভাব প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। বরং ছোট থেকে সব ধরনের আনাজপাতি-শাক খাওয়াতে শেখানো উচিত।
•সন্তানকে দেওয়া পকেটমানি যেন প্যাকেটজাত খাবারে না খরচ হয়। টাকা জমিয়ে পরে ভাল কিছু কিনতে উৎসাহ দিতে পারেন সন্তানকে।
•সন্তানদের বোঝাতে হবে ভাল ভাবে। নিজেকে ফিট ও সুন্দর দেখতে চায় সকলেই। শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুন্দর দেখানোর জন্য সুষম আহার জরুরি— এটা বোঝাতে পারলে কাজটা সহজ হবে।
•বাড়িতে সকলে মিলে শারীরচর্চা, ভাল খাবার খাওয়া, সুস্থ জীবন যাপনের পরিবেশ তৈরি করা দরকার। ছুটিতে ট্রেকিংয়ে যেতে পারেন। বিকেলে বাইরে খেলতে যাওয়ার অভ্যেস করানোও জরুরি। •কার্বোহাইড্রেট বা ফ্যাট মানেই খারাপ নয়। বরং প্রাতরাশে হাই কার্ব জরুরি, বোঝাতে হবে তা-ও।
•রাস্তার খাবার না খাইয়ে মায়েরা বাড়িতেই চটজলদি কিছু খাবার বানিয়ে দিতে পারেন। রাস্তার তেলে ভাজা কিনে না দিয়ে, বাড়িতেই টাটকা তৈরি করে খাওয়ানো ভাল।
•স্ন্যাক্স মানেই ভাজাভুজি নয়। শুকনো বাদাম, ফলও খাওয়ার অভ্যেস করাতে পারেন।
•কারও বাড়িতে গেলে বড়রা চিপ্সের প্যাকেট, কোল্ড ড্রিঙ্ক নিয়ে যান। তার পরিবর্তে ফলমূল, বাদাম, বিস্কিট নিয়ে যেতে পারেন।
ইটিং ডিসঅর্ডার প্রজন্মের পর প্রজন্মকে এগিয়ে দেয় অনিশ্চয়তা ও নানা সমস্যার দিকে। তাই অভিভাবক ও সন্তান— দু’পক্ষই তৎপর হলে সুস্থ জীবনযাপনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সহজ হবে।
মডেল: বন্দনা প্রামাণিক, শিবাঙ্গী মুখোপাধ্যায়; ছবি: অমিত দাস মেকআপ: প্রিয়া গুপ্ত
লোকেশন: লাহাবাড়ি