ব্যাকটিরিয়া বিনাশ ফাঙ্গাসের সর্বনাশ

ত্বকে লালচে ভাব, চুলকানি, ব্যথা হল জীবাণু ও ছত্রাক সংক্রমণের উপসর্গ। প্রতিষেধক ও চিকিৎসা দুই-ই প্রয়োজন। অনেক সময়েই পরিবেশ থেকে ব্যাকটিরিয়া বা জীবাণু শরীরে ঢুকে পড়ে। তারা শরীরের ভিতরে নানা রোগ সৃষ্টি করে।

Advertisement

চিরশ্রী মজুমদার

শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share:

কয়েক ধরনের অসুখ শীতে একটু কম জ্বালায়। ত্বকে ব্যাকটিরিয়া বা ফাঙ্গাল ইনফেকশন তেমনই অসুখ। কিন্তু আমাদের মন্দ কপাল। একে তো এখানে শীত তেমন পড়েই না, তার উপরে আছে দূষণ। তাই একটু হেলাফেলা করলেই এই সংক্রমণ ঠান্ডাতেও বাড়ে। একে তো সেটা বহু দিন ভোগায়, তার উপরে ত্বকে দাগ-ছোপ রেখে যায়। তাই একটু পরিচ্ছন্ন ও সতর্ক থাকুন।

Advertisement

কীভাবে হয় সংক্রমণ

Advertisement

শরীরে কিছু উপকারী ব্যাকটিরিয়া থাকে। তারা সাধারণত কোনও ক্ষতি করে না। কিন্তু অনেক সময়েই পরিবেশ থেকে ব্যাকটিরিয়া বা জীবাণু শরীরে ঢুকে পড়ে। তারা শরীরের ভিতরে নানা রোগ সৃষ্টি করে। আবার চামড়ার উপরেও বাসা বাঁধতে পারে। শরীরে জীবাণুর অত্যধিক বাড়বৃদ্ধি হলেও চর্মরোগ হয়। ফোঁড়া, ফুসকুড়ি, ইমপটাইগো (মুখে, ঠোঁটের উপরে চাক বেঁধে লাল র‌্যাশ। বাচ্চাদের খুব হয়) হল চেনা জীবাণু সংক্রমণ। অন্য দিকে, শরীরের যে সব জায়গায় প্রোটিন থাকে, সেখানে ফাঙ্গাস বা ছত্রাকের সংক্রমণ হয়। কারণ, ছত্রাক প্রোটিন খেয়েই বাঁচে। চুল, নখে ভীষণ ফাঙ্গাস ইনফেকশন হতে দেখা যায়। খুব চেনা কিছু ছত্রাক সংক্রমণ হল দাদ, হাজা, ছুলি, মুখের ভিতর থ্রাশ, বাচ্চার কোটেড টাং (জিভে সাদা সাদা ছত্রাকের পরত পড়ে)।

চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সন্দীপন ধর কয়েকটি উপসর্গ বলে দিলেন। এগুলির সাহায্যে সহজেই ব্যাকটিরিয়া ও ফাঙ্গাল ইনফেকশনকে আলাদা করে চেনা যায়। ছত্রাকের সংক্রমণ হলে আক্রান্ত অংশ খুব চুলকায়, সাদা সাদা ছোপ বা গোল, চাকা চাকা দাগ হয়। জীবাণু আক্রান্ত ত্বক লাল ও গরম হয়ে যায়। ব্যথাও হয়।

কোথায় হতে পারে

শরীরের খাঁজে এই ধরনের সংক্রমণ বেশি হয়। যেমন স্তনের নীচে, বাহুমূলে, ঊরু ও জঙ্ঘার সন্ধিস্থলে, আঙুলের ভাঁজে, পায়ের পাতায়। শরীরের ঢাকা অংশও সংক্রমণে আক্রান্ত হয়। বাচ্চাদের ন্যাপি র‌্যাশ, মেয়েদের ব্যক্তিগত অঙ্গের সংক্রমণ খুব চেনা সমস্যা।

বিশেষত মেয়েরা (ফোঁড়া, ফুসকুড়ি), অ্যাকিউট প্যারোনিকিয়া (নখকুনি)-র সমস্যায় ভোগেন। এগজ়িমা, অ্যালার্জি, ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজ়মা থাকলে ত্বকে ব্যাকটিরিয়া থাকে। সেখান থেকেই ফুসকুড়ি বা ফারাঙ্কল হয়। নখকুনি হয় অ্যানিমিয়া, থাইরয়েড, ব্লাড সুগারের জন্য। তাই নখকুনি বা ফারাঙ্কল হলে আগে সমস্যা খতিয়ে দেখে অ্যান্টিবায়োটিক খেতে দেওয়া হয়। কিছু ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক মলম লাগাতে দেওয়া হয়। তাতেই রোগ নিরাময় হবে।

প্রতিরোধের রাস্তা

এই ধরনের সংক্রমণ হলে ফেলে রাখবেন না। সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। চিকিৎসায় এই সব অসুখ খুব দ্রুত নিরাময় হয়ে যায়। কিন্তু এই ধরনের অসুখ সারানোর ঘরোয়া কোনও টোটকা নেই। তবে স্বাস্থ্যবিধি এবং প্রাথমিক পরিচ্ছন্নতার নিয়মগুলি মেনে চলতে হবে। তা হলে এ ধরনের সংক্রমণ ঠেকিয়ে রাখা যাবে। যেমন নিয়মিত নখ কাটা ও নখ শেপে রাখা। রোজ পরিষ্কার ও কাচা জামাকাপড়, অন্তর্বাস, মোজা, রুমাল ব্যবহার করা। শীত হোক বা গ্রীষ্ম, সাবান মেখে নিয়মিত স্নান করা। তার পরে পরিষ্কার তোয়ালে দিয়ে শুকনো করে গা মুছে নেওয়া।

উচ্চ ক্যালরি যুক্ত খাবার খেলে রক্তে চিনির মাত্রা বাড়ে। তাতে শরীরে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বাড়ে। কোন কার্বোহাইড্রেট রক্তে সুগারের মাত্রা কতটা বাড়ায়, তার একটি সারণি আছে। সেই সারণি অনুযায়ী কার্বোহাইড্রেট-সমৃদ্ধ খাবারের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স তৈরি হয়। যেমন ভাতের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স খুব বেশি। প্রসেসড খাবারের এই সূচক অত্যন্ত বেশি। গ্লাইসেমিক ইনডেক্সে উপরের দিকে থাকা খাবার খেলেই জীবাণু, ছত্রাকের সংক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই এই খাবারগুলি এড়িয়ে চলুন।

পাস্তা, পিৎজ়া, মুরগি ভাজার মতো সুস্বাদু খাবার ব্লাড সুগারের মাত্রা বাড়ায়। তাতে সংক্রমণের সমস্যাও বাড়ে। তাই এই সব খাবারের লোভ সংবরণ করুন।

শীতকালের সমস্যা

গরমে ঘামলে বা বর্ষার স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় এই সংক্রমণ বাড়ে। শীতে ত্বক শুকনো থাকে, তাই রোগের প্রাদুর্ভাব কমার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয় না। তার কারণ এখানে জমিয়ে শীত পড়ে না। তা ছাড়া শীতকালে অনেকেই আলস্যের বশে অপরিচ্ছন্ন থাকেন। শীতের পোশাক কম কাচেন, গরম জামার ভিতরেই ঘেমে যান। আবার গরম জামার ভিতরে যে জামাটি পরেছেন, সেটি তেমন ময়লা হয়নি বলে ধরে নেন। দিনের পর দিন সেটা পরতে থাকেন। নিয়মিত স্নান করতে চান না। এমন করলে শীতকালেও সংক্রমণে যথেষ্ট কষ্ট হতে পারে।

• শীতে পিকনিক, ঘুরতে যাওয়া শুরু হয়ে যায়। এতেও ত্বকে-চুলে বাইরের ধুলোময়লা আটকায়। ব্যাকটিরিয়া, ফাঙ্গাসের বাসা বাঁধতে সুবিধে হয়। কাজেই শীতকালে বাইরে বেড়াতে গেলে, কয়েকটি বিশেষ স্বাস্থ্যবিধি মনে রাখুন।

• পিকনিক থেকে ফিরে পরিষ্কার করে গা-হাত পা ধুয়ে নিন।

• হোটেলে বিছানা বা স্নানঘর পরিষ্কার দেখালেও সেখান থেকেও ইনফেকশনের ভয় থাকে। তাই সাবধানতা হিসেবে বাড়ি থেকে পরিষ্কার তোয়ালে ও চাদর নিয়ে যেতে পারেন।

• কোনও পোকামাকড় কামড়ালে ফেলে রাখবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ লাগান।

• সংক্রমণ হলে ট্যালকম পাউডার লাগানোর সময়ে সচেতন থাকুন। এতে ত্বকের ঘর্মগ্রন্থি বন্ধ হয়ে যায়। তাতেও সংক্রামক জীবাণুর সুবিধে হয়। পরিবর্তে মেডিকেটেড পাউডার ব্যবহার করতে পারেন, বিশেষত শরীরের খাঁজে।

স্নানের সময়ে সতর্কতা

• অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে স্নানের প্রথা ভুল। সাধারণ সাবান মেখে ভাল করে স্নান করলেই হবে। আসলে ত্বকে কমেনসল ব্যাকটিরিয়া বা ফাঙ্গাস থাকে। এরা ত্বকের স্বাভাবিক প্রহরী। বাইরের ব্যাকটিরিয়া, ফাঙ্গাসকে চট করে ত্বকে ঢুকতে বাধা দেয়। অ্যান্টিসেপটিকে স্নান করলে এই রক্ষীর দল ধুয়েমুছে যায়। এ দিকে এ সব অ্যান্টিসেপটিকের এত ক্ষমতা নেই যে, এরা বাইরের জীবাণুকে আটকে রাখবে। কাজেই সাধারণ সাবান মেখেই স্নান করুন। ত্বক নিরাপদ থাকবে।

• তেল মেখে শ্যাম্পু করুন। চুল পরিষ্কার থাকবে। স্ক্যাল্পে মৃত কোষ বা খুসকির সমস্যা হবে না। খুসকি থেকেও স্ক্যাল্পে সংক্রমণ হতে পারে।

• গ্রামবাংলায় থাকলে বা ঘুরতে গেলে পুকুরে স্নান করা থেকে বিরত থাকুন। এতে ব্যাকটিরিয়া, ফাঙ্গাসের উৎপাত বাড়ে। গভীর নলকূপের জল ব্যবহার করলে সুস্থ থাকবেন।

ব্যাকটিরিয়া ও ফাঙ্গাসকে গোড়ায় বিনাশ করাই ভাল। না হলে এই সংক্রমণ থেকে রোগ অনেক গভীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তখন চিকিৎসাও অনেক জটিল হয়ে যাবে। তাই সাবধান হতে হবে প্রাথমিক পর্যায়ে।

মডেল: অলিভিয়া সরকার, সুস্মেলি দত্ত

ছবি: অমিত দাস

মেকআপ: সুমন গঙ্গোপাধ্যায়

পোশাক: ইমেজ অ্যান্ড স্টাইল, গড়িয়াহাট

লোকেশন: লাহাবাড়ি, বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিট

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement