কিউআর কোড। পুরো নাম কুইক রেসপন্স কোড। বর্তমান যুগে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। করোনা অতিমারির সময় ছোঁয়াচ এড়িয়ে টাকা আদানপ্রদানের জন্য এর ব্যবহার এই কোডকে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে।
শুধু টাকা আদানপ্রদানই নয়, আরও নানবিধ কাজ যেমন রেস্তরাঁর মেনু, ট্রেন, বিমানের টিকিট কেনা ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা হয় এই কিউআর কোড।
১৯৯৪ সালে জাপানি সংস্থা ‘ডেনসো ওয়েভ’-এর ইঞ্জিনিয়ার মাসাহিরো হারা আবিষ্কার করেন কিউআর কোড। প্রাথমিক ভাবে গাড়ি তৈরির করার সময় যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে রাখার জন্য এটি ব্যবহার করা হত।
কিন্তু সাধারণ বার কোডের তুলনায় এর দ্রুত পঠনক্ষমতা এবং বেশি তথ্য ধরে রাখতে পারার ক্ষমতা এটিকে গাড়ি শিল্পের বাইরেও জনপ্রিয় করে তোলে।
কিউআর কোড এবং বার কোডের কাজ প্রায় একই। দুটোই যে কোনও পণ্যের তথ্য মজুত রাখতে সক্ষম। বার কোড শুধুমাত্র অনুভূমিক অক্ষে তথ্য সংগ্রহ করে রাখতে পারে। অন্য দিকে কিউআর কোড উল্লম্ব এবং অনুভূমিক দুই অক্ষেই তথ্য সংগ্রহ করে রাখতে পারে। ফলে আরও বেশি তথ্য একই জায়গায় রাখা যায়। সে জন্যই এর গ্রহণযোগ্যতা বেশি।
আমরা সহজেই ০-৯ সংখ্যা পড়তে পারলেও কম্পিউটারের কাছে তা সহজবোধ্য নয়। বার কোড বিভিন্ন প্রস্থের সাদা কালো দাগের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য সাঙ্কেতিক অক্ষরে সংগ্রহ করে রাখে। কোনও দোকানে কোনও পণ্যের ওপর লাগানো বার কোড মূলত ওই পণ্যের জন্য নির্ধারিত আইডি। বার কোড ক্ষতিগ্রস্থ বা অস্পষ্ট হয়ে গেলেও যন্ত্রের পক্ষে সেটি পড়ে ফেলা অসম্ভব নয়।
কিউআর কোড একটি সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে একটি বর্গাকার গ্রিডে সাজানো অনেকগুলো কালো বর্গক্ষেত্র নিয়ে গঠিত। যা ক্যামেরার মতো একটি ইমেজিং ডিভাইস দিয়ে পড়া যায়। এই কোড পড়ার জন্য প্রয়োজনীয় অ্যাপ আমাদের স্মার্টফোনেই থাকে।
একটি কিউআর কোডের তথ্য একটি বর্গাকার গ্রিডে বিন্দুগুলির একটি সিরিজ। প্রতিটি বিন্দু বাইনারি কোডে এক এবং প্রতিটি খালি জায়গাগুলি শূন্যকে প্রতিনিধিত্ব করে। এই গ্রিডগুলি ইউআরএল সহ সংখ্যা, অক্ষর বা উভয়ের সেট সাঙ্কেতিক অক্ষরে সংগ্রহ করে৷ সবচেয়ে ছোট গ্রিডে ২১টি সারি এবং ২১টি স্তম্ভ এবং সবচেয়ে বড় গ্রিডে ১৭৭টি স্তম্ভ এবং ১৭৭টি সারি থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, কিউআর কোডগুলি একটি সাদা পটভূমিতে কালো বর্গক্ষেত্র ব্যবহার করে তৈরি হয় যা প্রতিটি বিন্দুকে আলাদা করে চিহ্নিত করার কাজ সহজ করে তোলে।
যখন কোনও ব্যক্তি একটি কোড স্ক্যান করেন তখন তাঁর ফোনের ক্যামেরার কিউআর রিডার কোডটি পাঠোদ্ধার করে। ফলস্বরূপ ওই কোডে রাখা তথ্য আপনার ফোনে একটি প্রক্রিয়া চালু করে। যদি কিউআর কোডে একটি ইউআরএল থাকে, তা হলে আপনার ফোন আপনাকে ইউআরএলটি উপস্থাপন করবে। এ বার আঙুল ছোঁয়ালেই আপনার মোবাইল ব্রাউজারে ওই ইউআরএলটি খুলে যাবে।
চিনা সংস্থা ‘আলিপে’ ২০১১ সালে টাকা আদানপ্রদানের জন্য প্রথম কিউআর কোডের ব্যবহার করা শুরু করে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তা চিনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
কিউআর কোডের মাধ্যমে টাকা লেনদেন বেশ সহজ। যে অ্যাপের মাধ্যমে আপনি টাকা পাঠাবেন সেই অ্যাপে মাত্র এক বার ব্যাঙ্ক সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য আপলোড করে দিলেই হবে। প্রতিটি লেনদেনের সময় উপভোক্তাকে নিজের ব্যাঙ্কের যাবতীয় তথ্য খুঁজে বার করার দরকার পড়ে না।
ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (আরবিআই) ২০১৬ সালে বাজারে আনে ‘ভারতকিউআর’। ন্যাশনাল পেমেন্ট কর্পোরেশন, মাস্টারকার্ড এবং ভিসা মিলে তৈরি করে এটি। ২০১৮ সালে সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য ‘ভারতকিউআর’কে বাজারে ছাড়া হয়।
কিউআর কোড সাধারণ ভাবে বিপজ্জনক নয়। কিন্তু কোডের মধ্যে সঞ্চয় করে রাখা তথ্য কখনও কখনও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
ধরে নিন, কোনও কোডে একটি ক্ষতিকারক লিঙ্ক রেখে দেওয়া আছে। এখন আপনি ওই লিঙ্কে ক্লিক করলে আপনাকে সেটি কোনও সন্দেহজনক ওয়েহসাইটে নিয়ে যেতে পারে। সেই ওয়েবসাইট থেকে হয়তো আপনার মোবাইল বা ট্যাবে ম্যালওয়্যার ঢুকে পড়তে পারে। এমনকি লিঙ্কে ক্লিক করে ফেললে আপনার যাবতীয় তথ্য কোনও হ্যাকারের কাছে চলে যেতে পারে। আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। দেখে নিতে হবে ওই কিউআর কোডে যে লিঙ্কটিতে আপনি ক্লিক করছেন সেটি বিশ্বস্ত কি না।
অনেক সময় কিউআর কোড স্ক্যান করার জন্য ব্যবহৃত অ্যাপটিতে এমন একটি দুর্বলতা থাকতে পারে যার ফলে আপনার ফোন বা ট্যাব হ্যাক হয়ে যেতে পারে। শুধুমাত্র কিউআর কোড স্ক্যান করার মাধ্যমেই এই সমস্যা হতে পারে। আপনাকে এতে লিঙ্কটিতে ক্লিকও করতে হবে না। এই আশঙ্কা এড়াতে, আপনার কিউআর কোড স্ক্যান করতে স্মার্টফোন প্রস্তুতকারকের দেওয়া বিশ্বস্ত অ্যাপ ব্যবহার করা উচিত।