আলাদিনের সেই প্রদীপটা কিন্তু বাস্তবেও আছে। তাকে আমরা ‘বুদ্ধি’ বলি। বুদ্ধিমানরাই আইনস্টাইন হয়ে ইতিহাস গড়েছেন, ফেলুদা রূপে মগনলাল মেঘরাজের মতো দুষ্টু লোকের চাল ব্যর্থ করেছেন। কেউ ধোনি হয়ে বিশ্বকাপ এনেছেন! অর্থাৎ বুদ্ধি থাকলে সমৃদ্ধি, সাফল্যের গ্যারান্টি অনেক বেশি।
আর যা দিনকাল, তাতে বু্দ্ধি করে না এগোলে সাফল্যলাভ তো দূর, শান্তিতে বেঁচেবর্তে থাকাটাই দুষ্কর। ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে সন্তানকে নিরাপদ রাখতে, ভাল রাখতে, ছোটবেলায় তার বুদ্ধিবৃত্তির যথাযথ বিকাশ নিয়ে সচেতন অভিভাবকেরা। ক্লাসরুমে এবং জীবনের পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেতে বুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা বোঝেন সক্কলে। একটি প্রশ্ন তাঁদের ভাবায়। সন্তানের বুদ্ধিমত্তা কি বাড়িয়ে দেওয়া যায়? বুদ্ধিবৃত্তি যাতে ষোলো কলায় বিকশিত হয়, তার জন্য কী ভাবে সহায়তা করবেন বাচ্চাদের? বিশেষজ্ঞরা কী পরামর্শ দিচ্ছেন?
বুদ্ধির বিকাশ কি সম্ভব?
মানুষ জিনগত ভাবে নির্দিষ্ট বুদ্ধি, মেধা নিয়ে জন্মায়। শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতা সেই বুদ্ধিকে ক্ষুরধার করে। বয়স বাড়ে, বুদ্ধি পাকে। তা হলে শৈশবেই বুদ্ধি শাণিত করা কী করে সম্ভব? মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জয়রঞ্জন রাম বলছেন, “ছোটবেলায়, দু’বছর বয়স পর্যন্ত মস্তিষ্কের বিকাশের, তার কোষগুলির পরিবর্তনের ক্ষমতা অনেক বেশি। বড় হলে এই ক্ষমতা কমে যায়। অল্প বয়সে মস্তিষ্কের উপর পরিবেশের প্রভাব অনেকটাই বেশি। আর সাফল্য পেতে বুদ্ধির পাশাপাশি, সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ (সোশ্যাল ডেভলপমেন্ট), মানসিক বিকাশও (ইমোশনাল ডেভলপমেন্ট) বেশ জরুরি। এই তিনটি গুণকে নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। মস্তিষ্কের এই নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাকেই প্রভাবিত করে বাচ্চার আশপাশের পরিবেশ।”
সেই উপযুক্ত পরিবেশ জোগানের দায়িত্ব অভিভাবকের। চেষ্টা করলে বাচ্চার মস্তিষ্কের কোষগুলি উদ্দীপিত, পুষ্ট করা যায়। চলতি কথায়, বুদ্ধিতে শান দেওয়া। পেরেন্টিং কনসালটেন্ট পায়েল ঘোষ জানালেন, গবেষণা বলছে, গ্রোথ মাইন্ডসেটই শেষ কথা। এ ক্ষেত্রে জিন গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাবা অঙ্কে কাঁচা বলেই বাচ্চা অঙ্কে দুর্বল হবে, তা নয়। কিছু সৃষ্টিশীল কাজে জিনের প্রভাব হয়তো থাকে। তবে বাচ্চার জীবনযাত্রায় কয়েকটি পরিবর্তনে বুদ্ধির বিকাশ সম্ভব। সেগুলির হদিস দিলেন তিনি।
বুদ্ধি পাকানোর ধাপগুলি
ব্লক বিল্ডিং জাতীয় কগনিটিভ ইনডোর গেমস দিয়ে বাচ্চার পরিপার্শ্বের সংখ্যা, আয়তন, পরিমিতি ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা তৈরি করে তুলুন। ‘স্পেশিয়াল ইনটেলিজেন্স’ বিকশিত হবে।
একে অপরের সঙ্গে কথা বললেও বুদ্ধিমত্তা, ভাবনায় স্বচ্ছতা আসে। এর জন্য ছোট থেকেই বাচ্চাদের সঙ্গে ভাব বিনিময় এবং ‘বিশ্লেষণমূলক’ কথোপকথন জরুরি। যেমন, কাজটা কী ভাবে করবে, কেন করবে? এই যে পাখা ঘুরছে, হাওয়া লাগছে। এই হাওয়াটা কোত্থেকে এল? ওরা মাথা খাটাতে শুরু করবে। ওদের ভাবার সুযোগ দিন। রূপকথার বই দিলে বাচ্চার কল্পনার জগৎ সমৃদ্ধ হবে। পাশাপাশি, একই রকম রঙিন ছবি দেওয়া আকর্ষক বিজ্ঞান, সাধারণ জ্ঞানের বইও পড়ান। সেগুলো দেখে তার মনে প্রশ্ন জাগবে। যুক্তিবোধ, জ্ঞানের পরিধি প্রসারিত হবে। চারপাশ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকবে, বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্য বাড়বে।
এ কথা প্রমাণিত, বাচ্চার স্ক্রিনটাইম যত কমাবেন, বুদ্ধির ধার তত বাড়বে। একঘেয়ে রিল, ইউটিউব ভিডিয়ো দেখে মন-মগজ সব ওই ছোট্ট বাক্সে থেমে না থাকে।
মস্তিষ্কের ট্রেনিং
চিন্তাশক্তি গড়ে তুলতে প্রয়োজন মজবুত স্মৃতিশক্তি। তার জন্য ওর মন শান্ত করা ও মনঃসংযোগ বাড়ানো দরকার। পড়ায় মন বসাতে মিউজ়িক থেরাপি কার্যকর। তবে, প্রচলিত গান শুনতে শুনতে অঙ্ক করব বললে শুনবেন না। যে অঙ্কে চ্যালেঞ্জ আছে, সেগুলি এ ভাবে সমাধান করা যাবে না। গানের কথা মনঃসংযোগে বাধা দেবে। আলফা রে জাতীয় সঙ্গীত মন বসাতে সাহায্য করে। এগুলি চিন্তাভাবনার চারধারে মনঃসংযোগের বৃত্ত তৈরি করে। চিন্তাভাবনাকে একটা বিন্দুতে নিয়ে আসে। তার সহায়ক পরিবেশ বাড়িতে রাখুন। কঠিন বিষয়কে শান্ত মনে পড়তে, বুঝতে এবং ভাবতে সুবিধে হবে। পরবর্তী কালে বাচ্চার বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ বেশি হবে।
পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত রেজ়াল্ট ভাল, সিক্সে হঠাৎ খারাপ। অর্থাৎ সিলেবাসটা একটু কঠিন হয়েছে, ওর মেধা সেই পরের স্তরে পৌঁছয়নি। এই সমস্যা থেকে মুক্ত করতে ছোট থেকে ওর মস্তিষ্ককে কমফর্ট লেভেলের বাইরে আনার অভ্যেস রাখুন। পায়েলের পরামর্শ, যা জানে বা পারে তার চেয়ে ‘ওয়ান লেভেল আপ’ অবস্থানের টাস্ক দিন। সেটা পারলে, আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। না পারলে, সেই ধাপের কাজ দিতে থাকুন, যতক্ষণ না ওর মন অন্য ভাবে ভেবে বাধা টপকানোর রাস্তা খুঁজে নিচ্ছে।
পায়েল বললেন, ‘আউট অব দ্য বক্স’ বা অভিনব চিন্তাকে লালন করতে প্রয়োজন অবসর, একলা থাকা। শুধু পড়ে গেলে, দেখে গেলে সৃষ্টিশীল ভাবনা জন্মায় না। ওই অভিজ্ঞতাগুলি অবচেতনে জমবে। শূন্য মনে, একা থাকার সময়, ওই সঞ্চয় থেকেই নতুন ধরনের চিন্তার পত্তন হবে। ‘ব্রেন স্টর্মিং’-এর সূত্রপাত হবে, যা জীবন-পরিবর্তনের কারিগর। মাঝেসাঝে বাচ্চার মস্তিষ্ককেও ‘ফ্রি টাইম’, ‘ফ্রি স্পেস’ উপভোগের সুযোগ দিন। চার পাশে ঘুরে বেড়াক, পরিবেশের রূপ-রস-গন্ধ শুষে নিয়ে মস্তিষ্ক তেজিয়ান হয়ে উঠবে।
ডা. রামের কথায়, “ঘনিষ্ঠরা বলেন, সচিনের চেয়েও বেশি প্রতিভাধর বন্ধু কাম্বলি। কিন্তু সচিন জিতলেন তাঁর টেম্পারামেন্টের জোরে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সার্বিক বিকাশ জরুরি। সামাজিক চেতনা, অন্যের জন্য ভাবা, বিশ্বাসের বন্ধন তৈরি করা, দয়া-সহানুভূতি তীক্ষ্ণ হলে জীবনে এগিয়ে যাবে। ব্যক্তিগত ও কাজের জগতের সম্পর্কগুলো ভাল হবে। এই সব ‘সোশ্যাল ও ইমোশনাল ডেভলপমেন্ট’-এ সহায়ক কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি। যেমন নাচ, গান, ক্রিকেট-ফুটবল ইত্যাদি টিমস্পোর্টস। একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে কাজ করা ইত্যাদি। এ সব কাজেও ছোটদের এগিয়ে দিন। সব ধরনের মানুষের সঙ্গে মিশুক।”
ঘরেই আছে মগজাস্ত্র
জীবনে পাঁচ বার সফল হলে, বারো বার ব্যর্থ হবে। ব্যর্থতার সেই কষ্টার্জিত অভিজ্ঞতাই জয়ের লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছনোর মূল পাথেয়। বাচ্চারা ব্যর্থ হলেও, চেষ্টাটাকে প্রশংসা করুন। ডা. রাম বলছেন, “বাচ্চা অভিভাবকের থেকে কী রকম প্রতিক্রিয়া পাচ্ছে, তার উপর তার মস্তিষ্কের ‘কানেকশন’-এর ঘনত্ব নির্ভর করে। এ সময় মস্তিষ্ক কতটা উদ্দীপিত হচ্ছে, তার উপর নির্ভর করবে তা ভবিষ্যতে শীতের পাতাঝরা বিবর্ণ গাছ হবে না বসন্তের ঘন সবুজ বৃক্ষরাজি। সুখী পরিবার, অভিভাবকের স্বাস্থ্যকর আচরণ, জ্ঞান-গুণের আবহ— সবই মস্তিষ্ককে সম্পদশালী করে।”
অর্থাৎ শিশুর মস্তিষ্কের বাড়বৃদ্ধি নির্ভর করবে অভিভাবকের আচরণ ও তাঁর তৈরি করা পরিবেশের রসদের উপর। সঙ্গে ওর এবং নিজের জন্য অবসর রাখুন। দুনিয়ার জানালাটা খুলে দিন ওর সামনে। তার জন্য নিজেদের জীবনের গুণগত মানও খানিকটা বাড়িয়ে নিতে হবে।