দুর্গাপুজো, কালীপুজো হোক কিংবা ছট অথবা রমজান— ধর্ম আচরণের অঙ্গ হিসেবে উপবাস করার প্রথা সবের সঙ্গেই জুড়ে আছে। অনেকে পুজোআচ্চায় অংশ নেন, তবে উপোস করেন না। বলেন, ‘ওসব বাজে, ঠাকুর কোথায় না খেয়ে থাকতে বলেছেন!’ সংশয় দূর করতে এক বৃদ্ধ পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ঠাকুরমশাই, উপোস করা কি জরুরি? উপোস করা হয় কেন?’ তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘না খেয়ে থাকা মানে তাঁকে ক্ষুধা এবং তৃষ্ণারূপে অনুভব করা। তিনি তো ক্ষুধারূপেণ, তৃষ্ণারূপেণ সংস্থিতা, তাই না? যাকে ভালবাসি, তার জন্য কষ্ট করতেও তো ভাল লাগে, তাই না খেয়ে থাকা।’ যে আরাধ্যকে ভালবাসা যায়, তার জন্য মানুষ হাসিমুখে কষ্ট করে।
যদি আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় দিক ছেড়ে শারীরিক দিকে আসি, তা হলে তো মনে প্রশ্ন উঠবেই উপবাস করা কি ভাল? এতে শরীরের লাভ হয় না ক্ষতি? প্রথমেই বলে রাখি, এ ব্যাপারে ভিন্ন ভিন্ন শুধু নয়, পরস্পরবিরোধী মতই বেশি। অনেক যোগগুরু কিংবা পুষ্টিবিদের কাছে এমন কথা শুনেছি, ১৪ থেকে ১৬ দিন অন্তর আমাদের পাকযন্ত্র একদিন করে বিশ্রাম চায়। সে দিনটা নাকি আমরা অভ্যেসে খাই, আসলে আমাদের খিদে পায় না। সে দিনও খাবার খেলে পাকযন্ত্রের উপরে অত্যধিক চাপ পড়ে যা শরীরের পক্ষে ভাল নয়। যেহেতু ১৪ বা ১৬ দিন হিসেব করে মনে রাখা পক্ষে কঠিন, তাই কেউ কেউ বলেন একাদশীর দিন কিংবা অমাবস্যা-পূর্ণিমার দিন উপোস করলে নাকি শরীর তার নিজস্ব ছন্দে কাজকর্ম করে যেতে পারে। আবার কারও মতে, পুরো উপবাস কখনওই নয়। সপ্তাহে একদিন কোনও কঠিন খাবার না খেয়ে শুধু ফলের রস খেয়ে থাকা উচিত। নির্জলা উপবাসে শরীরের কোষ একেবারে জলশূন্য হয়ে পড়ে, এটা ক্ষতিকর।
জেনারেল মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ ডা. সুবীর কুমার মণ্ডল বললেন, ‘‘দীর্ঘ উপবাসের পরে যে দিন প্রথম খাবার খাই, তখন শরীর ভীষণ ভাবে রিঅ্যাক্ট করে। একে রিফিডিং সিনড্রোম বলে। কোনও ধর্মীয় কারণে, অপারেশন বা হাসপাতালে দীর্ঘ চিকিৎসার পরে যে দিন প্রথম রোগীকে খাওয়ানো হয়, তখন রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, বুক ধড়ফড় ও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, ভুল বকা থেকে শুরু করে হার্ট ফেলিয়োর হতে পারে, কোমা এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে।’’
উপবাস কত উপকারী, এ নিয়ে তথ্যের অভাব নেই। উপবাস করলে যৌবন দীর্ঘস্থায়ী হয়, শরীর থেকে টক্সিন বেরিয়ে গিয়ে ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়ে, ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা বাড়ে, শরীর থেকে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল বেরিয়ে যায়, ডায়াবিটিসের পক্ষে উপকারী ইত্যাদি। কিন্তু এই মিথগুলো আদৌ কি সত্যি? ডা. সুবীর কুমার মণ্ডল বললেন, “এ কথার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কারণ রক্তে গ্লুকোজ় পৌঁছলে ফিডব্যাক পদ্ধতিতে ইনসুলিন হরমোনের ক্ষরণ হয়। এটি অতিরিক্ত গ্লুকোজ়কে রক্ত থেকে সরিয়ে গ্লাইকোজেন ফর্মে লিভার ও পেশিতে সঞ্চয় করে। দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে শরীরে ইনসুলিনও ক্ষরিত হবে না। তার পর যেই শরীরে খাবার ঢুকবে, ব্লাড সুগার লেভেল হঠাৎ অনেকটা বেড়ে যাবে। শুধু ব্লাড সুগার নয়, স্টমাক আলসার, গ্যাসট্রাইটিস কিংবা হায়াটাল হার্নিয়া থাকলে উপোস তাঁর পক্ষে অবশ্যই ক্ষতিকর।”
অনেকটা একই কথা বললেন ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিস্ট হিনা নাফিসও। তাঁর মতে, “ডায়াবিটিস কিংবা গ্যাসট্রিক আলসারের রোগীর পক্ষে উপবাস কখনওই উপযুক্ত নয়। উপোস বা ফাস্টিং মানে পরিপাক ক্রিয়ার বিশ্রাম, সেটার তো কিছু সুবিধে আছেই। কিন্তু সেই উপকারিতা নির্ভর করে উপোস কী ভাবে করা হচ্ছে তার উপরে। অনেকে উপোস ভাঙার পরে এত বেশি তেল-মশলা দেওয়া খাবার খেয়ে ফেলেন কিংবা প্রচুর পরিমাণে ফল মিষ্টি খান, তাতে উপোসের সমস্ত সুফলটাই চলে যায়। উপোস করতে হবে নিয়ম মেনে। উপোসের আগে পরে সব সময়েই হাল্কা খাবার খাওয়া দরকার। নিয়ম করে প্রচুর জল খাওয়া দরকার। কেউ হয়তো ফলের রস খাওয়া দরকার বলে
পাঁচ-সাত গ্লাস ফলের রস খেলেন, তাতে কিন্তু উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হবে।”
তা হলে রোগা হওয়ার জন্য উপবাস করা কি ঠিক নয়? ডা. সুবীর কুমার মণ্ডলের কথায়, “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর একটা স্লোগান আছে, ‘নো ফাস্ট, নো ফিস্ট’। মানে না খেয়ে থাকাও নয়, আবার অতিরিক্ত খাওয়াও নয়। বিশেষ করে ডায়াবিটিস রোগীর পক্ষে দুটোই ক্ষতি করে। উপবাস করে রোগা হওয়ার কথা বলে, এমন ধরনের ডায়েটিং শুরু করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধৈর্য রাখা যায় না। আমরা সব সময়ে বলি, অল্প সময়ের ব্যবধানে ছোট ছোট মিল খান। এবং সবরকম খাবার খান। কোনও বিশেষ রোগ না থাকলে পাঁচ রকম ব্যঞ্জন শরীরের পক্ষে উপকারী। তাই এটা আমাদের বহু শুভ অনুষ্ঠানের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। আপনি সব কিছুরই উপকার পেলেন। কোনওটারই বেশি খাওয়ার ফলে যে অপকার হয়, তার থেকেও বাঁচলেন। অনেক সময়ে অনেকে রোগা হওয়ার প্রয়োজনে ‘ফিলার’ জাতীয় খাবার বেশি খান, অর্থাৎ কার্বোহাইড্রেট বাদ দিয়ে আনাজপাতি, স্যালাড, স্প্রাউটস খেয়ে পেট ভরালেন। এতে আমাদের ব্রেন ভাবতে শুরু করে যে, এতে তো কম ক্যালরি আছে, ফলে অনেক সময়ে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ফুড ইনটেক হয়ে যায়। এ রকম চললে ডাইজেস্টিভ এনজ়াইমের কার্যকারিতার উপরে খারাপ প্রভাব পড়ে। স্বাভাবিক ক্ষেত্রে সব রকম খাবার খেতে হবে, এটাই ঠিক পন্থা। ‘অ্যান অ্যাপল আ ডে, কিপস আ ডক্টর অ্যাওয়ে’— কথাটার আদৌ কোনও মানে আছে কি না ভাল করে ভেবে দেখুন। শুধু আপেলই বা কেন? কোন ফলে খাদ্যগুণ নেই বলুন তো? বিভিন্ন ফলে বিভিন্ন মিনারেলস আছে, তাই সব রকম ফলই সব সময় ঘুরিয়েফিরিয়ে খেয়ে দেখুন।”
জানা গেল, চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে উপবাস নয়, নিয়ম মেনে খাওয়াই শরীর সুস্থ রাখার চাবিকাঠি। আবার বেশি খাওয়াও শরীরের পক্ষে ভাল নয়। সেটাও তো এড়ানো উচিত। মজার ছলেই একটা উপায় বলে দিলেন ডা. মণ্ডল, “বাঙালিদের মেনুতে বিভিন্ন ধরনের আইটেম, মানে তেতো দিয়ে শুরু করে মিষ্টি দিয়ে শেষ, এটা বিজ্ঞানসম্মত বটে। কিন্তু আমি বলি, বেশি খাওয়া এড়াতে চাইলে উল্টো দিক থেকে শুরু করাই সবচেয়ে নিরাপদ। একেবারে শেষে রাখা মিষ্টি বা ডেসার্ট দিয়ে শুরু করুন। আর একটু দাঁড়িয়ে আসল মেনুতে যান। এর ফলে প্রথমেই আপনার ব্লাড সুগার লেভেল বেড়ে যাবে, এবং সব মিলিয়ে অল্প খেলেই দ্রুত পেট ভরে যাওয়ার মতো অনুভূতি তৈরি হবে। আমি নিজে দেখেছি, এইভাবে বেসাল মেটাবলিক রেটও একেবারে নর্মাল রাখা সম্ভব। তবে এ সবই সাধারণ ফুড ফর্মুলা। আপনার বিশেষ কোনও রোগ বা সমস্যা থাকলে অবশ্যই কোনও বিশেষজ্ঞ বা নিউট্রিশনিস্টের পরামর্শ নিন।”
হিনা নাফিস আরও বললেন, “উপোসের আগে বা পরে কী খাওয়া হচ্ছে সেটা খুবই জরুরি। সব সময় হাল্কা আর সহজে হজম হয় এমন খাবার খেতে হবে। একই খাবার, কখনও ভাল, কখনও খারাপ। যেমন ধরুন, আলু। উপোসের পরে আপনি অল্প নুন দিয়ে আলু সিদ্ধ খেলেন, কিংবা ছোলা দিয়ে আলুর চাট করে খেলেন। সেগুলো আপনাকে ভাল ফল দেবে। কিন্তু আলু ভাজা বা পটেটো চিপ্স খেলেন। তা হলে কোনও উপকারই হবে না। ভাত এমনিও খাওয়া যায়, ঘি-জাফরান দিয়ে পোলাও করেও খাওয়া যায়। আপনি কোনটা বেছে নিচ্ছেন, তার উপরে আপনার স্বাস্থ্য নির্ভর করবে। সব সময়ে, বিশেষ করে উপোস করার আগে বা পরে, সমস্ত রকম প্রসেসড ফুড, টিনড ফুড, জাঙ্ক ফুড, ফাস্ট ফুড এবং ঘরে তৈরি ডিপ ফ্রায়েড খাবার থেকেও দূরে থাকুন।”
মন চাইলে উপোস করতে পারেন। কিন্তু ভাল মন্দ সবটা জেনে বুঝে এবং শরীর বাঁচিয়ে তা করুন। শরীরও মন্দির এবং স্বাস্থ্যরক্ষাও ধর্ম, এ কথা ভুললে কিন্তু চলবে না।