হিয়া রোগা হবে বলে ভাতের পরিমাণ কমিয়ে রুটি খেয়ে যাচ্ছে প্রায় মাসতিনেক। কিন্তু কাজ দিচ্ছে না সে ভাবে। এ দিকে হিয়ার প্রিয় বন্ধু আত্রেয়ী ভাত, রুটি, আইসক্রিম, বিরিয়ানি সবই খায়, কিন্তু তার চেহারা দেখে তা বোঝার উপায় নেই। অন্য দিকে আবার কম বয়সেই মাঝেমাঝে রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে মুকুটের। স্কুলপড়ুয়া মুকুটের এহেন সমস্যায় চিন্তিত তার মা-বাবা। এত ছোট বয়সে উচ্চ রক্তচাপ কেন? চিকিৎসকের পরামর্শমতো জিন টেস্ট করিয়ে উত্তর মিলল। সেই মতো ডায়েট মেনে চলায় মুকুটের রক্তচাপও এখন নিয়ন্ত্রণে।
অনেকেই বলেন যে, হাওয়া খেলেও তাঁদের ওজন বাড়ে। অনেকে আবার চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয় সব স্বাদ নিয়েও ছিপছিপে। কারণ? তাঁদের জিনের গঠন। প্রত্যেক মানুষের জিনের গঠন আলাদা আর জিনের গঠন অনুযায়ী মানুষের মেটাবলিজ়মও ভিন্ন। তাই একই খাবার রোজ খেয়েও কারও ওজন বেশি, কেউ রোগা। কারও ডায়াবিটিস, কেউ আবার সম্পূর্ণ সুস্থ। তাই ডায়েট ঠিক করার আগে যদি চিনে নিতে পারেন নিজের জিনের গঠন, সেই অনুসারে খাদ্যতালিকা সাজিয়ে নিতে পারলেই শরীর চলবে আপনার অঙ্গুলিহেলনে। তবে আগে বুঝতে হবে এই ডায়েটকে।
জিনোম ডায়েট আসলে কী?
ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিস্ট হিনা নাফিস বললেন, ‘‘নিউট্রিশনাল জিনোমিক্সের দু’টি শাখা। একটি নিউট্রিজেনেটিক্স, অন্যটি নিউট্রিজিনোমিক্স। কোনও খাবার খেলে শরীর কী ভাবে রিঅ্যাক্ট করবে তা নির্ধারিত হয় নিউট্রিজেনেটিক্সে। আর খাবার কী ভাবে আমাদের শরীরে প্রভাব ফেলবে, তা ঠিক করে নিউট্রিজিনোমিক্স। একই খাবার খেলেও প্রত্যেকের শরীরে তার প্রভাব ভিন্ন। দেখা গিয়েছে হয়তো কেউ রোজ ফ্যাটবেসড খাবার খেয়েও ভাল আছেন। এ দিকে তারই পরিবারের অন্য কেউ একই ডায়েট মেনে চলায় কোলেস্টেরল বা হাই ট্রাইগ্লিসারাইডের সমস্যায় ভুগছেন। অনেকে হয়তো ডায়েটে কার্বস কমিয়ে অনেকটা ওজন ঝরিয়ে ফেলেন। অনেকে আবার ডায়েটে কমপ্লেক্স কার্বস বাড়িয়ে, ফ্যাট কমিয়ে ওজন ঝরাতে সফল হন। কোনও খাবার খেলে, কে কী ভাবে রিঅ্যাক্ট করবেন, তা জিন টেস্টের মাধ্যমে জানা সম্ভব।’’
জিন টেস্টের মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে যাবে আমাদের শরীর কোন খাবার গ্রহণ করে বা করে না। সেই অনুযায়ী ডায়েট চার্ট তৈরি করলে শরীর সুস্থ রাখা সহজ হয়। ডায়াটিশিয়ানদের মতে, জিনোম ডায়েট ব্যক্তিভেদে বদলে যায়।
জিন টেস্ট কেন দরকার? অনেকেই এখন খাবারের সঙ্গে সাপ্লিমেন্ট নিয়ে থাকেন। বিশেষ করে মাল্টিভিটামিন অনেকেই রোজ খান। কিন্তু তা আদৌ আমাদের শরীর গ্রহণ করছে কি না, সেটা আমরা দেখি না। হিনা নাফিসের কথায়, ‘‘ধরুন, জিনের গঠন অনুযায়ী ভিটামিন বি টুয়েল্ভ আপনার শরীর গ্রহণ করছে না। এ দিকে আপনি রোজ মাল্টিভিটামিন খেয়ে যাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে তা কোনও কাজে তো লাগবেই না, উপরন্তু এই অতিরিক্ত ভিটামিন যে বিষাক্ত অবশিষ্টাংশ তৈরি করবে সেটা পরিষ্কার করতে হবে লিভার ও কিডনিকে। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু জিন টেস্ট করে দেখলেন আপনার আসলে ভিটামিন সি ও ই দরকার। তা হলে আপনি মাল্টিভিটামিন না খেয়ে শুধু মাত্র ওই দু’টি ভিটামিন খেলেই আপনার চাহিদা মিটে যাবে। জিনোম ডায়েটকে ‘টু দ্য পয়েন্ট’ বলা যায়। কার শরীরের ঠিক কতটুকু দরকার, তা পরিষ্কার হয়ে যায় জিন টেস্টে। সেই মতো ডায়েট ফলো করলে কাজ হবে তাড়াতাড়ি।’’
এই ডায়েটে খাবারের তালিকা সকলের জন্য এক নয়। টেস্ট রিপোর্ট অনুযায়ী কোন ধরনের খাবার আপনার শরীর গ্রহণ করতে পারবে, তা বুঝে তালিকা তৈরি করা হয়। এখনও খাবারের প্রভাব নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। কফি বা ঠান্ডা পানীয়ের প্রভাবও দু’জনের শরীরে দু’রকম হতে পারে। হার্ট ভাল রাখতে কফি সহায়ক। কিন্তু অনেকেরই কফি খেলে অ্যাসিডিটি হয়। তাই জিনোম ডায়েটের পরামর্শ দেওয়ার পরেও, সেই খাবারের প্রভাব নিয়ে চলছে গবেষণা।
এর সুবিধে কী?
হিনা নাফিসের কথায়, ‘‘জিন টেস্টের সুবিধে হল, সারা জীবনে এই টেস্ট একবার করলেই হয়। ফলে পরবর্তী কালে কোনও অসুখে বা সমস্যায় এই টেস্টের রিপোর্ট দেখে সহজেই সমাধান খোঁজা যায়। এমনকি কোনও সাপ্লিমেন্ট নেওয়ার আগেও রোগী নিশ্চিত হতে পারবেন, তাঁর জিনে সেই সাপ্লিমেন্ট আদৌ গৃহীত হবে কি না। আমাদের শরীরের কী দরকার, তা অনুপুঙ্খ ভাবে ধরা থাকে জিনের গঠনে। তাই ঠিক মতো ডায়েট চার্ট তৈরি করার ক্ষেত্রে জিন টেস্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে দিন-দিন।’’
রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে কি কার্যকর?
এইমস, কল্যাণীর বায়োকেমিস্ট্রির সহকারী অধ্যাপক অতনুকুমার দত্ত বললেন, ‘‘জিনগত রোগ সাধারণত দু’ধরনের হয়ে থাকে। যেমন সিঙ্গল জিন ডিজ়িজ় এবং পলিজেনিক ডিজ়িজ়। সিঙ্গল জিন ডিজ়িজ়ে কোনও একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে রোগ হয়, যেমন থ্যালাসেমিয়া। যে সব রোগ কোনও এনজ়াইমের ত্রুটির জন্য হয়, সেগুলিও জেনেটিক্স টেস্ট করলে বলা যায়। কিন্তু এই ধরনের রোগ খুব কম দেখা যায়। এক লক্ষ সদ্যোজাতর মধ্যে হয়তো এক-দু’জনের হয়। কিন্তু পলিজেনিক ডিজ়িজ় হলে তা কোন জিনের ত্রুটির জন্য হচ্ছে, তা ধরা মুশকিল। লাইফস্টাইল ডিজ়িজ় অর্থাৎ ডায়াবিটিস, ওবেসিটি এই ধরনের ডিজ়িজ়। এই সব রোগের জিনগত গবেষণার জন্য বড় স্যাম্পল সাইজ় দরকার পড়ে। ফলে তা খরচসাপেক্ষ হয়ে যায়। কিন্তু হোল জিনোম সিকোয়েন্সিং করলে তা ধরা যায়। যেমন হৃদ্রোগের জন্যও কিছু ধরনের জিন টেস্ট করা হয়।’’ তবে জিনের সঙ্গে পরিবেশের প্রভাবও সমান গুরুত্বপূর্ণ পলিজেনিক ডিজ়িজ়ে। কেউ সেডেন্টারি জীবনযাপন করলে তাঁর ডায়াবিটিস, ওবেসিটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর জিনে সেই প্রবণতা থাকলে সেই অসুখ হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায় বলে মত অতনুর। তবে কম বয়সে যদি কারও ডায়াবিটিসের মতো অসুখ দেখা যায় বা পরিবারে একাধিক ব্যক্তির কম বয়সে ডায়াবিটিস হওয়ার ইতিহাস থাকে, সে ক্ষেত্রেও জিন টেস্ট করে ডায়েট তৈরি করতে পারেন। এতে সেই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।
খাদ্যতালিকা তৈরিতে বা বিভিন্ন অসুখের সুরাহা খুঁজতে জিন টেস্ট নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। তাই জিনোম ডায়েট করতে চাইলে অবশ্যই আগে ডায়াটিশিয়ানের পরামর্শ নিন।