করোনাভাইরাস নিয়ে াতঙ্ক দানা বাঁধছে গোটা দেশে। ছবি: এএফপি।
ভুল ধারনা ও অকারণ গুজবে দেশ জুড়ে বাড়ছে করোনা-আতঙ্ক।
এমনিতেই চিকিৎসা নেই বলে এই আতঙ্ক আরও বেশি করে চেপে ধরছে সকলকে। আর এই ভয়ের আগুনে ঘি ঢালছে নানা সোশ্যাল মিডিয়া ও লোকমুখে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভুল ধারণা বা মিথ।
কী কী ভুল ধারণা ভেঙে না ফেললে আখেরে লাভ তো নেই-ই, করোনার মোকাবিলাই করা যাবে না, জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। দেখে নিন সে সব কী কী।
আরও পড়ুন: এই সব নিয়ম মানতে ভুল করবেন না, অসতর্ক হলেই থাবা বসাতে পারে করোনাভাইরাস
করোনা নিয়ে সচেতনতার পাঠ প্রয়োজন গোটা বিশ্বে।
হ্যান্ড ড্রায়ারে ঘন ঘন হাত শুকোনো: বাইরে থেকে এলে বা ঘরে থাকলেও ঘন ঘন হ্যান্ড ড্রায়ার্সের সামনে দাঁড়িয়ে হাত শুকিয়ে নিলেই করোনা এড়ানো যাবে, এমন একটা মিথ ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন সংস্থার হ্যান্ড ড্রায়ার বিক্রিও অনেক বেড়ছে গত কয়েক দিনে। কিন্তু এই ধারণা একেবারেই ভুল বলে দাবি ‘হু’-র। বরং বাইরে থেকে এসে ভাল করে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট (চলতি কথায় পটাশ) বা অ্যালকোহল বেসড কোনও হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে কনুই অবধি হাত ধুয়ে, পরিষ্কার কোনও তোয়ালে বা গামছায় হাত মুছে নিন। হাত কিছু ক্ষণ উঁচু করে রেখে প্রাকৃতিক হাওয়া বা পাখার হাওয়াতেও শুকিয়ে নিতে পারেন।
সারা শরীরে অ্যালকোহল বা ক্লোরিন ছড়ানো: করোনাভাইরাস নিয়ে কাজ করে চলা বক্ষবিশেষজ্ঞ সুমিত সেনগুপ্ত এই বিষয়টির বিরুদ্ধে সচেতন করলেন। ‘হু’-এর সঙ্গে তিনিও একমত। তাঁর মতে, অ্যালকোহল বা ক্লোরিন সারা শরীরে স্প্রে করে এই ভাইরাস আটকানো অসম্ভব। উল্টে ত্বকের পক্ষে এগুলো ক্ষতিকর হতে পারে। বরং অ্যালকোহল বেসড কোনও হ্যান্ড ওয়াশ করোনা ঠেকাতে সাহায্য করে।
কী ভাবে ছড়াচ্ছে করোনাভাইরাস? দেখে নিন।
চিনে পাড়ার খাবার বা চিন থেকে আসা লোকজন এড়ানো: এমন আচরণ হাস্যকর বলেই মত চিকিৎসকদের। তাঁদের কথায়, কোনও ভাবেই কলকাতা বা ভারতের অন্য প্রান্তে কোনও চিনে পাড়ার খাবার থেকে এই অসুখ ছড়ায় না। চিনে যে সাপ বা বাদুড় খাওয়ার প্রচলন আছে, তা থেকে অসুখের বিষ মিলেছিল। কিন্তু ভারতে এ সব খাবার খাওয়ার চল নেই। তাই ফ্রায়েড রাইস, চাউমিন বা মোমো খান পেটপুরে, নিশ্চিন্তে।
চিন থেকে কেউ এলেই তিনি করোনা বয়ে এনেছেন এমন ধারণা একেবারেই ঠিক নয়। করোনার লক্ষণ প্রকাশ পেলে তবেই তার থেকে দূরে থাকুন। অকারণে সুস্থ মানুষের সঙ্গে এমন ব্যবহারের কোনও কারণই নেই।
চিন থেকে আসা পার্সেল নেব না: যে সব ক্ষেত্রে চিন নামটা রয়েছে, তাতেই ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। অনেকেই ভাবেন, যিনি পার্সেল দিয়েছেন বা চিন থেকে ভারতে আসতে যত হাত ঘুরে এসেছে এই পার্সেল তাতে করোনা আক্রান্ত কেউ থাকলেও থাকতে পারেন। এই ধারণা একেবারেই ভিত্তিহীন বলে দাবি ‘হু’ ও চিকিৎসকদের। বরং তাঁদের মতে, অহেতুক এই ভয় না পেয়ে নিশ্চিন্তে চিন থেকে আসা পার্সেল গ্রহণ করুন। কারণ, করোনাভাইরাসের জীবাণু কোনও জড় পদার্থের উপর বেশি ক্ষণ বাঁচে না।
আরও পড়ুন: মুরগি বা পাঁঠার মাংস থেকে কি করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে?
পোষ্য থেকে ছড়ায়: না ছড়ায় না একেবারেই। বরং বাড়ির পোষ্যকেও এই অসুখ থেকে দূরে রাখা উচিত তার মানুষ মা-বাবার। দু’একটি ক্ষেত্র বাদে কুকুর, বিড়াল বা পাখিদের শরীরে এই জাতীয় ভাইরাসের অস্তিত্বের সে ভাবে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে, পোষ্যদের সঙ্গে বাইরে বেরলে বা তাদের সঙ্গে বাইরে থেকে খেলাধুলো করে এসে দু’জনেই ভাল করে সাফসুতরো থাকার চেষ্টা করুন। হাত-পা ভাল করে ধোওয়া, পোষ্যের প্রয়োজনীয় যত্ন এগুলো যে কোনও অসুখ থেকেই দূরে রাখবে দু’জনকেই।
নাক থেকে জল ঝরলেই করোনা: এই সম্ভাবনার কথা হেসেই ওড়ালেন চিকিৎসক অমিতাভ নন্দী। যে কোনও সাধারণ ঠান্ডা লাগা, সর্দি-কাশি মানেই তা করোনা নয়। বরং দীর্ঘ দিন নানা ওষুধপত্রেও অসুখ না সারলে তখন তা ভয়ের। তখনই পলিমারেস চেন রিঅ্যাকশন বা পিসিআর পরীক্ষা করে দেখা হয়, শরীরে এই ভাইরাস ঢুকেছে কি না।
ত্রিস্তরীয় নীল বা সবুজ রঙের ডিসপোজাল মাস্ক ব্যবহার করুন।
মাস্ক হলেই হল: না হল না। যে কোনও মাস্ক কিন্তু এই অসুখ ঠেকানোর জন্য উপযুক্ত নয়। বরং বাজারচলতি সস্তা দামের মাস্ক থেকে অন্য নানা সংক্রমণ বাড়তে পারে। তা হলে কেমন মাস্ক কার্যকর? চিকিৎসকদের মতে, সাধারণ মাস্ক নয়, ত্রিস্তরীয় নীল বা সবুজ রঙের ডিসপোজাল মাস্ক রুন, যা কেবলমাত্র ওষুধের দোকানে কিনতে পাওয়া যায়।
তিল তেল ও রসুন করোনা ঠেকায়: প্রতি দিন সকালে এক কোয়া রসুন শরীরের নানা উপকার করে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, শ্লেষ্মা ঠেকানো এ সব রসুনের ভাল গুণ। তিল তেলেরও এমন নানা ফলকারী দিক রয়েছে। কিন্তু এদের কোনওটাই করোনাভাইরাস ঠেকাতে পারে না। করোনা রোখার কোনও বাড়তি ক্ষমতা এদের আছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
শুধু বয়স্ক আর শিশুদের ভয়: মোটেই তা নয়। করোনা-আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ও বয়স দেখলেই তা বোঝা যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শিশু ও বয়স্কদের কম থাকে বলে ভয় তাদের বেশি। তার মানে এই নয় যে একমাত্র শিশু ও বয়স্করাই এর শিকার হতে পারে।
মাংস বাদ: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ গৌতম বরাটের কথায়, ‘‘এ সবই মানুষের রটানো ভয়। করোনা ভাইরাসের যা প্রকৃতি, তাতে তা নির্দিষ্ট কিছু চিনা বাদুড় ও সাপের মাংস থেকে ছড়াতে পারে। কিন্তু কিছুতেই মুরগির মাংসে তা আসতে পারে না। ভারতীয় মুরগির শরীরে এই ভাইরাস-বিষ থাকা অসম্ভব। তবে অসুখ ছড়ালে কিছু বাড়তি সতর্কতা আমরা সব সময় নিতে বলি। তাই কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে।’’
নিয়ম মেনে চলার কথা বললেন ভায়ারোলজিস্ট সুশ্রুত বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাঁর মতে,‘‘মুরগির মাংসে বা খাসির মাংস থেকে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার কথা একেবারেই ভিত্তিহীন। আমরা, ভারতীয়রা যে ভাবে মাংস রান্না করি, তাতে যে কোনও ভাইরাসই অত আঁচে বাঁচে না। তবে যে কোনও ভাইরাস থেকে বাঁচার সহজ উপায় হল, রান্নার সময় কিছু নিয়ম মেনে চলা।’’
(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)