নিয়মিত মাইক্রোআভেনের ব্যবহার ক্ষতি করে শরীরের। ছবি: আইস্টক।
রান্নাঘরে মাইক্রোওয়েভ আভেন না থাকলে এ কালের অনেক গৃহিনীই দিশেহারা হয়ে পড়েন। এক দিকে বাইরে থেকে আনা খাবার গরম করা, অন্য দিকে অল্প তেলে অথবা তেল ছাড়া রান্নার জন্য অনেকেই মাইক্রোওয়েভ আভেনের দ্বারস্থ হন। কিন্তু জানেন কি বিভিন্ন সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, নিয়মিত মাইক্রোওয়েভে রান্না খাবার খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে রীতিমতো ক্ষতিকর!
যাঁরা দীর্ঘ দিন মাইক্রোওয়েভে রান্না করছেন, এই যন্ত্রটি ছাড়া চোখে অন্ধকার দেখেন তাঁদের সতর্ক হওয়ার সময় হয়েছে। এমনটাই জানালেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামী। তাঁর মতে, ‘‘আধুনিক জীবনে মাইক্রোওয়েভ অন্যতম নির্ভরতা হলেও এর ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ টানা উচিত। এই যন্ত্রে মাছ, মাংস, ডাল, যা-ই রান্না করা হোক না কেন, ডি-নেচারড হয়ে যায়। খাবারের কোনও কোনও খাদ্যগুণ সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। নাগাড়ে মাইক্রোওয়েভে রান্না খাবার খেলে ক্যানসার-সহ নানা শারীরিক সমস্যা ডেকে আনতে পারে।’’
পুষ্টিবিদ সুমেধা সিংহের মতে, ‘‘মাইক্রোওয়েভে রান্না করাই হোক বা খাবার গরম করা— এই যন্ত্রে ব্যবহার করা হয় রেডিয়েশন। এটি আমাদের শরীর-সহ পরিবেশেরও নানা ক্ষতি করে। অনেক সময় আমরা রেস্তরাঁর খাবার এনে মাইক্রোওয়েভে গরম করে খাই। ডিপ ফ্রাই করা খাবার রেডিয়েশন দিয়ে গরম করলে ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড আরও ক্ষতিকর হয়ে ওঠে বলে।’’
আরও পড়ুন: চিনিই সর্বনাশ ডাকছে চোখের, কী ভাবে সামলাবেন?
চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে কেস স্টাডির ভূমিকা অপরিসীম। এমনই এক ঘটনার দৃষ্টান্ত প্রায়ই দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। ১৯৯১ সালে ওকলাহামার এক হাসপাতালে হিপ সার্জারির রোগী নর্মা লেভিটের মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধে। হয়। এই ঘটনার তদন্ত আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এক পক্ষের দাবি ছিল, মাইক্রোওয়েভই এই মৃত্যুর জন্য দায়ী। আবার আর এক পক্ষ নার্সের অজ্ঞতাকে দায়ী করেছিলেন। আসলে অপারেশনের সময়ে নর্মা লেভিটের রক্তের দরকার হয়েছিল। তাড়াহুড়ো করে ঠান্ডা রক্তের প্যাক স্বাভাবিক তাপমাত্রায় আনতে মাইক্রোওয়েভে গরম করা হয়, আর তাতেই রক্তের বিভিন্ন উপাদান ওলটপালট হয়ে গিয়ে রোগীর শরীরে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। আর তাতেই একটা নিরাপদ অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে মারা যান নর্মা লেভিট।
গবেষণায় জানা গিয়েছে, নিয়মিত মাইক্রোওয়েভের রান্না খাবার খেলে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। এই নিয়ে রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময়ে সুদীর্ঘ সমীক্ষা ও গবেষণা করেছেন। রাশিয়ার বেশ কিছু জনগোষ্ঠী একটা সময়ে যাবতীয় রান্নাবান্না করত মাইক্রোওয়েভের সাহায্যে। তখন অনেকেরই রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন কমে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার সঙ্গে ছিল প্রচন্ড মাথার যন্ত্রণা, চোখে ব্যথা, অনিদ্রা, সারাদিন ধরে ঘুম ঘুম ভাব। এখানেই শেষ নয়, একই সঙ্গে পেটে ব্যথা, টেনশন, অ্যাংজাইটি, মনঃসংযোগের অভাব, হজমের গোলমাল-সহ নানা শারীরিক সমস্যা শুরু হয়। একই সঙ্গে এত মানুষের অসুস্থতার খবরে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন দেশের শাসকদল। দ্রুত এক হাজার গবেষক শুরু করেন সমীক্ষা। তখনই ধরা পড়ে আসল সত্যিটা। রোগের নাম দেওয়া হয় ‘মাইক্রোওয়েভ সিকনেস’।
তবু আমেরিকা-ইউরোপ-সহ অন্যান্য উন্নত দেশের পাশাপাশি আমাদের দেশেও এর ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। আমেরিকায় প্রায় ৯০ শতাংশ পরিবার খাবার গরম ও রান্নার কাজে মাইক্রোওয়েভ আভেন ব্যবহার করেন। তবে চিকিৎসকদেরল মতে, পুরোপুরি ছাড়তে না পারলেও মাইক্রো আভেন ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সাবধনতা অবলম্বন করুন।
আরও পড়ুন: ঘন ঘন অ্যান্টিবায়োটিক খান? ‘সুপারবাগস’ বিপদ ডাকছে অজান্তেই
মাইক্রোওয়েভে দুধ ফোটাবেন না। কারণ, এতে দুধের মধ্যে থাকা কিছু প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি, দুধে থাকা উপকারি অ্যামিনো অ্যাসিড পরিবর্তিত হয়ে কার্সিনোজেনিক সাবস্ট্যান্স তৈরি করে। কার্সিনোজেনিকের অর্থ বিষাক্ত রাসায়ানিক— যা ক্যানসার ডেকে আনে। মাইক্রোওয়েভে চিকেন বা মাটন রান্না সহজ ও নির্ঝঞ্ঝাট বলে অনেকেই চটজলদি মাইক্রোওয়েভ কুকিং পছন্দ করেন। কিন্তু জানলে আঁতকে উঠবে যে মাংসে থাকা বিভিন্ন অ্যামিনো অ্যাসিড মাইক্রো আভেনের পাল্লায় পড়ে ডি-নাইট্রোসোডিএন্থানল অ্যামিনস নামে বিষাক্ত যৌগ উৎপাদন করে, যা ক্যানসারের শঙ্কা বাড়িয়ে তোলে। ডিপ ফ্রিজে রাখা বরফ জমা সব্জি এই ম্যাজিক মেশিনে গরম করলে উপকারী প্ল্যান্ট অ্যালকালয়েড বিষাক্ত পদার্থে পরিণত হয়। এটিও আমাদের শরীরে বিভিন্ন রোগ ডেকে আনে। বিট, গাজর, মুলোর মত রুট ভেজিটেবলস মাইক্রোওয়েভে সেঁকে নিয়ে স্যালাড বানালে এক দিকে যেমন এর পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়, তেমনই এত বেশি ফ্রি র্যাডিক্যাল উৎপন্ন হয় যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। খাবারে থাকা ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই-সহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মাইক্রোওয়েভের ফলে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। নিয়মিত মাইক্রোওয়েভের রান্না খেয়ে অ্যাপেন্ডিসাইটিস, গলস্টোন, বন্ধ্যাত্ব, ছানি এবং ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজের প্রবণতা বাড়ে। মাইক্রো আভেনের ফলে করোনারি আর্টারিতে (হার্টের রক্তবাহী ধমনি) চর্বির প্রলেপ পড়ার গতি বেড়ে যায় হুহু করে। ফলে হার্টের অসুখ এবং আচমকা হার্ট অ্যাটাকের চান্স বাড়ে। হজমক্ষমতা একেবারে কমে যায়, লাগাতার বদহজম চলতেই থাকে। নিয়মিত মাইক্রোওয়েভের রান্না খেলে লসিকাগ্রন্থির কর্মক্ষমতা কমে যায়। লসিকা আমাদের শরীরকে কয়েকটি ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। তাই লসিকার কার্যক্ষমতা হ্রাস পেলে তা শঙ্কার। মাইক্রোওয়েভের খাবার খেলে অন্ত্র এবং পাকস্থলীর ক্যানসারের প্রবণতাও বাড়ে। লাগাতার মাইক্রোওয়েভ ব্যবহারে আমাদের মস্তিষ্কের তরঙ্গকে ওলটপালট করে দেয়। নার্ভ ও মস্তিষ্কের সমস্যা দেখা দেয়। আর এর প্রভাবে মানসিক স্থিতাবস্থা নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করে। স্মৃতিশক্তি, বুদ্ধি, স্থিরতা, ধৈর্য কমতে শুরু করে। শুরু হয় ডিপ্রেশন।