টেমসের ধারে পুজোর প্যারেড তোড়জোড় শুরু। —প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
চারচাকায় বিলেত পাড়ি। তা-ও আবার পুজোর টানে! এমনই তো করেছেন চন্দননগরের কৌশিক রায়। দু’মাস ধরে গাড়ি চালিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছেন লন্ডন। সেখানেই আজ, শনিবার, পুজোর প্যারেড।
প্যারেড বললে বাংলা মানে যেমনটা হয়, এ অবশ্য তার চেয়ে বেশ খানিকটা আলাদা। দুর্গার প্যারেড হবে লন্ডনের নৌকা চড়ে, টেমস নদীতে। আর সেই নৌকা থেকে টেমসের জলে মিশবে বিশ্বের আরও ১৫টি নদীর জল। কৌশিকদের এত মাসের ধকল তো তারই জন্য! কৌশিকের সঙ্গে আছেন আরও ছ’জন। তাঁর স্ত্রী দেবাঞ্জলি রায় এবং পাঁচ বন্ধু। সকলে মিলে দুটো গাড়ি নিয়ে নেপাল-তিব্বত পেরিয়ে, সড়ক পথেই মধ্য এশিয়ার বহু দেশ ডিঙিয়ে টার্কি হয়ে গিয়ে পৌঁছেছেন ইউরোপে। সেখানেও অস্ট্রিয়া, জার্মানি, বুলগেরিয়ার মতো বেশ কয়েকটি দেশ দিয়ে চলেছে গাড়ি। ইংলিশ চ্যানেল পার করে শুক্রবার রাতে অবশেষে তাঁরা পৌঁছে গিয়েছেন লন্ডন। সেখানেই আজ মহা আয়োজন। লন্ডন থেকে ফোনে আনন্দবাজার অনলাইনকে কৌশিক জানালেন, বিভিন্ন দেশের ছোট-বড় নানা নদীর জল তুলে নিয়ে গিয়েছেন তাঁরা। এক ব্যাগ ভর্তি শুধু নদীর জলের বোতল গিয়েছে তাঁদের সঙ্গে। যেমন আছে গঙ্গা, যমুনার জল, তেমনই আছে রাইন, ইয়েলো রিভারের জল। সেই সব নদীর জল এ বার মিশবে গিয়ে টেমসে। এ ভাবেই লন্ডনে হবে বিজয়ার আনন্দ।
কখনও কখনও লন্ডন কলকাতার মতো দেখায়। এই শনিবারটা তেমনই। টেমসে নদীতে পাওয়া যাবে গঙ্গার গন্ধ। জড়ো হবেন বিলেতবাসী বাঙালিরা। এ বার তৃতীয় বছরে পা দিচ্ছে লন্ডনের টেমসে দুর্গা প্যারেড। কলকাতার সংস্থা ‘লাল বাবা রাইস’ তাদের পাশেও আছে। নৌকাবিহারে যাবেন দেবী। তার জন্যই চলছে আয়োজন। বিলেতবাসী বাঙালিরা যেমন সেই আয়োজন করেছেন, তেমন বিলেতের মানুষের কাছে দুর্গাপুজোর আনন্দ পৌঁছে দিতে আগ্রহ দেখিয়েছেন এ দেশের অনেকেও। সবে মিলে লন্ডনকে বিসর্জন দর্শন করাচ্ছেন। সঙ্গে ধরে রাখা হচ্ছে বাঙালির সংস্কৃতির নানা দিক।
লন্ডনের পথে সঙ্গীদের সঙ্গে কৌশিক রায়। —নিজস্ব চিত্র।
ইংল্যান্ডের সংগঠন ‘হেরিটেজ বেঙ্গল গ্লোবাল’-এর উদ্যোগে আয়োজন করা হচ্ছে বিলেতের নদীতে এই প্যারেডের। একটি বড় লঞ্চে করে দুর্গাপ্রতিমা নিয়ে হবে উদ্যাপন। সঙ্গে বাংলার গান, বাংলার আনন্দ। লন্ডন থেকে আয়োজকদের তরফে অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় জানান, দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত চলবে দুর্গা প্যারেড। তিনি বলেন, ‘‘কলকাতার দুর্গাপুজো দেখার উৎসাহ যাতে বিদেশে আরও বাড়ে, সেটিই আমাদের এই উৎসবের আসল উদ্দেশ্য। সে কাজে আমরা লন্ডনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করা বাঙালিদের যুক্ত করছি। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্রছাত্রী নৌকার সাজসজ্জার কাজ করেছেন। আবার প্রতিমা তৈরি করেছেন কলকাতার টেকনো ইন্ডিয়া-র পড়ুয়ারা। তাঁরা তৈরি করে দেওয়ার পরে দুর্গাপ্রতিমা পাঠানো হয়েছে লন্ডনে। তা-ই থাকছে এ বারের টেমস প্যারেডের কেন্দ্রে।
গত বার লন্ডনে বিজয়া উদ্যাপনে ভাটিয়ালি গান গাইছেন বাংলার সঙ্গীতশিল্পী সৌরভ মণি। —নিজস্ব চিত্র।
বাংলার সঙ্গীতশিল্পী সৌরভ মণি গত বার যুক্ত ছিলেন লন্ডনে বিজয়া উদ্যাপনের এই অভিনব অনুষ্ঠানের সঙ্গে। এ বার ভিসা সংক্রান্ত টানাপড়েনে আর যাওয়া হয়নি। তবে আগের বারের আনন্দ এখনও তিনি ভুলতে পারেননি। সৌরভ বলেন, ‘‘টেমস নদী দিয়ে নৌকা চলছে, তার মধ্যে ভাটিয়ালি গান গাইছি আমি। সে দিনটা এখনও মনে আছে। নিজের দেশে পুজোর আনন্দ যেমন অনেক, তেমন অন্য দেশের সকলকে নিজেদের পুজো দেখানোর আনন্দও কম নয়।’’ অনির্বাণদের উদ্দেশ্যও এটাই। তিনি বলেন, ‘‘বিদেশের বাঙালিদের কাছে কলকাতার দুর্গাপুজোর আনন্দটা তুলে ধরতে চাই। তাতে হয়তো পুজোর সময়ে কলকাতায় বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা কিছুটা বাড়বে। আমাদের এটুকুই চাওয়া।’’
টেমসের জলে এ ভাবেই হয় বিসর্জন। —নিজস্ব চিত্র।
কৌশিকরাও তো সেই টানেই পাড়ি দিয়েছেন এত দূর। দুর্গাপুজোর আনন্দ বিলেতে বয়ে নিয়ে গিয়েছেন খাস কলকাতা থেকে। এর পর যখন দেশে ফিরবেন, তখন ঝুলিতে নিয়ে আসবেন বিলেতে বিসর্জন দেখার গল্প।