— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
খাতায়কলমে বর্ষার মরসুম শুরু হয়ে গিয়েছে আগেই। কিন্তু, টানা বৃষ্টির দেখা নেই। বরং বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি হওয়ার কারণে আবহাওয়ার তারতম্য ঘটছে প্রতি মুহূর্তে। আর সেই অনুকূল পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে দেদার বংশবিস্তার করছে ভাইরাস, ব্যাক্টিরিয়া। যার ফল, সরকারি এবং বেসরকারি সব স্তরের হাসপাতালে টানা জ্বর, সঙ্গে সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। শহর থেকে জেলা, সর্বত্র এক অবস্থা।
এমনিতেই বিক্ষিপ্ত বৃষ্টির ফলে জমা জলের কারণে মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। তার মধ্যেই বিভিন্ন প্রজাতির ভাইরাস বা ব্যাক্টিরিয়ার জন্য শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন কোমর্বিডিটিতে আক্রান্তদের অনেকের ক্ষেত্রেই তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘প্রতি বছরই আবহাওয়ার পরিবর্তনের সময়ে এই ধরনের সংক্রমণে কাবু হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। এর জন্য ইনফ্লুয়েঞ্জা বা নিউমোনিয়ার প্রতিষেধক নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারি প্রোটোকলে ওই প্রতিষেধকের বিষয়টিতে এখনও পর্যন্ত তেমন ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।’’ আবার, বাজারে প্রতিষেধকগুলির দাম অনেক বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষের পক্ষে তা নেওয়া সম্ভব হয় না।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, জ্বর ও সর্দি-কাশিতে আক্রান্তদের বেশির ভাগেরই ‘আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট’, অর্থাৎ নাক, গলা ও শ্বাসনালিতে সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে ‘লোয়ার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট’, অর্থাৎ ফুসফুসে সংক্রমণ বা নিউমোনিয়ায় আক্রান্তও মিলছে। সবেরই নেপথ্যে রয়েছে ইনফ্লুয়েঞ্জা, অ্যাডিনো, করোনা, আরএসভি (রেসপিরেটরি সিন্সিটিয়াল ভাইরাস)-সহ আরও কিছু ভাইরাস এবং কিছু ব্যাক্টিরিয়ার প্রকোপ।
সংক্রামক রোগের চিকিৎসক যোগীরাজ রায় বলেন, ‘‘সকলেরই ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যানেল পরীক্ষা করতে হবে বা হচ্ছে, তেমনটা নয়। তবে হাসপাতালে ভর্তি এবং ঝুঁকি রয়েছে, এমন রোগীদের ওই পরীক্ষা করা হচ্ছে। তাতে বেশি করে মিলছে ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ’।’’ গত দু’-তিন সপ্তাহ ধরে অধিকাংশ রোগীর শরীরে ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা-এ’ ভাইরাসের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিনের চিকিৎসক সোহম মজুমদারও। তিনি আরও জানান, দিন দুয়েক বা তিন দিন তীব্র জ্বর থাকছে। সঙ্গে গলা ব্যথা, মাথা ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় যন্ত্রণা। জ্বরের প্রকোপ কমার পরে শুরু হচ্ছে শুকনো কাশি। যোগীরাজ বলছেন, ‘‘জ্বর-সর্দি কমলেও শুকনো কাশি যেমন ১৫-২০ দিন ভোগাচ্ছে, তেমনই প্রচণ্ড দুর্বলতাও সহজে কাটছে না।’’
এখনকার আবহাওয়ায় কখনও বৃষ্টি, ঠিক তার পরেই চড়া রোদ উঠছে। কেউ বৃষ্টিতে ভিজছেন, কারও আবার ঘাম বেশি হচ্ছে। অনেকে সেই অবস্থাতেই এসিতে গিয়ে ঢুকছেন বা ঠান্ডা জল খাচ্ছেন। যার ফলে খুব সহজেই গলায়, ফুসফুসে সংক্রমণ হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই বলেন, ‘‘জলীয় বাষ্প বেশি থাকায় বাতাস ভারী হয়ে থাকছে। তাই বিভিন্ন ভাইরাস ও ব্যাক্টিরিয়া সহজে উড়ে বেরিয়ে যেতে পারছে না। বরং, সেটা বাতাসে থেকে যাচ্ছে। যে কারণে বেশি মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন। আবার, তাঁদের হাঁচি-কাশি থেকে বেরোনো ড্রপলেটের মাধ্যমেও অন্যেরা আক্রান্ত হচ্ছেন।’’
আবহাওয়ার পরিবর্তনে শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপে নেতিবাচক প্রভাবের ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নড়বড়ে হয়ে যায়। ফলে শরীর জীবাণুর বিরুদ্ধে সে ভাবে লড়তে পারে না বলেই জানাচ্ছেন রাজ্যের প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজিস্ট এবং ভাইরাস বিষয়ক গবেষক সিদ্ধার্থ জোয়ারদার। তাঁর কথায়, ‘‘স্যাঁতসেঁতে, জোলো আবহাওয়ায় ঠান্ডা লাগলে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় না। তখন ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। আবার ওই সময়ে সুযোগসন্ধানী জীবাণুও বংশবিস্তারের সুযোগ পায়। এই জোড়া ফলাতেই সর্দি-কাশি, জ্বরের প্রকোপ বাড়ে।’’