টিবি। ব্যাকটিরিয়াঘটিত আর পাঁচটা রোগের মতোই একটি রোগ। কিন্তু তার নামের মধ্যেই কেমন যেন একটা ভয়, হতাশা আজও জড়িয়ে। ভারতে এ রোগের হার চোখে পড়ার মতো বেশি। যদিও এর কোনও বিজ্ঞানসম্মত কারণ নেই, তবে মনে করা হয়, আমাদের দেশে যেহেতু জনঘনত্ব খুব বেশি, তাই রোগীর হার বেশি। যে সব রোগ মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় (যেমন করোনা), জনঘনত্ব বেশি হওয়ার কারণে তা খুব সহজে ছড়িয়ে পড়ে। তা ছাড়া, অপুষ্টিতেও টিবির সম্ভাবনা বাড়ে। তবে সুস্থ জীবনযাপন, যথাযথ ওষুধ এবং পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া... এ সব কিছুর যোগফলে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব।
রোগের লক্ষণ
মাইকো ব্যাকটিরিয়াম টিউবারকুলোসিস নামক ব্যাকটিরিয়ার কারণে এ রোগ হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশি থেকে অন্য ব্যক্তি সংক্রমিত হন। এ ভাবেই রোগটি ছড়ায়। প্রাথমিক ভাবে ওজন কমে যাওয়া, খিদে কম হওয়া, একটা সার্বিক দুর্বলতা... এগুিল টিবির সাধারণ লক্ষণ। যে অঙ্গে টিবি হয়েছে, সেই অঙ্গজনিত কিছু কিছু উপসর্গও দেখা দেয়। ফুসফুসে টিবি হলে, কাশি হতে পারে। কাশির সঙ্গে রক্তও বেরোয় অনেক ক্ষেত্রে। তবে সব ক্ষেত্রে তা নাও হতে পারে। শরীরের বিভিন্ন অংশে গাঁট ফুলে যায়। আমাদের গলায় অনেক লিম্ফনোড থাকে, সেই লিম্ফনোড ফুলতে পারে। এ ছাড়া কুঁচকি বা আর্মপিটের গাঁট কখনও কখনও ফুলতে দেখা যায়। তবে লাংসেই সবচেয়ে বেশি টিবি হয়। কারণ রোগটিতে একজন মানুষ থেকে অন্য জন আক্রান্ত হন। তাই ফুসফুস বেশি আক্রান্ত হয়। লাংসের বাইরে যে জায়গাগুলো আক্রান্ত হয়, তাকে এক্সট্রা পালমোনারি বলে। এক্সট্রা পালমোনারি অর্গানও এই রোগে আক্রান্ত হয়, যেমন ব্রেনের বাইরের লেয়ার মেনিনজেস, চোখ, লিম্ফনোড, হার্টের বাইরের লেয়ার পেরিকার্ডিয়াম, ইনটেস্টাইন, হাড় ইত্যাদি। এ ছাড়া বিরল কিছু ক্ষেত্রে আক্রান্ত হতে দেখা যায় অ্যাড্রিনাল গ্ল্যান্ড, কিডনি ইত্যাদি।
রোগের চিহ্নিতকরণ
লাংসে টিবির ক্ষেত্রে প্রথমে কিছু ব্লাড টেস্ট করে দেখা হয়। তার পর লাংসের এক্স-রে। তাতে যদি কিছু না পাওয়া যায়, তখন সন্দেহ থাকলে সিটি স্ক্যান করে দেখা হয়। চেস্ট ফিজ়িশিয়ান ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশ্যালিস্ট ডা. অনির্বাণ নিয়োগী বললেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল থুতু পরীক্ষা। এ ক্ষেত্রে নানা রকম নতুন টেস্ট এসেছে, ওয়র্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজ়েশন যেগুলো রেকমেন্ড করে। পরীক্ষায় প্রায় বিপ্লব এসেছে বলা যায়। পেশেন্টের হিস্ট্রি, থুতু পরীক্ষা, এ সবের উপর ভিত্তি করেই ওষুধের ক্যাটিগরি ভাগ করা হয়। এ ছাড়াও মান্টু টেস্ট করা হয়। তবে সেটা এখন অতটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। আরএনটিসিপি (রিভাইসড ন্যাশনাল টিবি কন্ট্রোল প্রোগ্রাম)-র গাইডলাইন অনুসারেই আমাদের দেশে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে টিবির চিকিৎসা করা হয়। আরএনটিসিপি মান্টু টেস্টকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। ব্লাড টেস্ট, থুতু পরীক্ষা, এক্স-রে, সিটি স্ক্যান এবং সেই অঙ্গ অনুসারে নানা রকম টেস্ট করতে দেওয়া হয়। যেমন, লাংসের বাইরে টিবি হলে সেখানে জল জমে। সেই জলের টেস্ট। পেটের মধ্যে হলেও জল জমে, তখন সেই টেস্ট। অনেক সময় শরীরের নানা জয়েন্টে টিবি হয়। তখন সাইনোভিয়াল ফ্লুইড টেস্ট করতে পাঠানো হয়। গ্ল্যান্ডে হলে বায়োপসি করতে হয়। তবে টিবির জীবাণু মাইক্রোস্কোপে মাত্র দু’ থেকে পাঁচ শতাংশ ক্ষেত্রে ধরা পড়ে। সেটা কিছুটা টেকনিক্যাল কারণ এবং কিছুটা জীবাণুর সংখ্যা কম থাকার কারণে। কিন্তু উপসর্গ এবং যে অঙ্গে হয়েছে তার হিস্ট্রি শুনে, ব্লাড রিপোর্ট, এক্স-রে, সিটি স্ক্যান দেখে, বিভিন্ন অর্গানের নির্দিষ্ট টেস্টগুলো দেখে, যদি ক্লিনিক্যালি দেখা যায় যে, জ্বর হয়েছে, দীর্ঘদিন কাশি, ওজন কমেছে, ডায়াবিটিস রয়েছে বা ইমিউনিটি কমের কারণে ওষুধ খেতে হয়... সেখানে সন্দেহ থাকলে, টিবির ওষুধ দেওয়া হয়। আমাদের দেশে যেহেতু টিবির হার খুবই বেশি, তাই কিছুটা সন্দেহের ভিত্তিতে ওষুধ দেওয়া হয়। একে বলা হয় এমপেরিসিজ়ম। চিকিৎসা শাস্ত্রে এ ভাবে ওষুধ দেওয়ার চল বহু বছরের পুরনো।’’
টিবির ওষুধ কাজ করতে কারও ক্ষেত্রে এক বা দু’ সপ্তাহ, কারও ক্ষেত্রে চার সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তার পর যখন কাশি বা জ্বর কমতে শুরু করে, তখন ইনডাইরেক্টলি বোঝা যায়, রোগটি টিবি-ই ছিল। কারণ ক্ষেত্র বিশেষে সমস্ত টেস্ট করেও বোঝা যায় না, সমস্যাগুলো টিবির কারণেই।
টিবি কি সংক্রামক?
স্পুটাম পজ়িটিভ টিবি ফুসফুসে হলে, রোগী যদি হাঁচে বা কাশে, তা থেকে টিবি ছড়াতে পারে। কিন্তু লাংসের বাইরে কোথাও হলে (যেমন, লাংসের বাইরের লেয়ারে অর্থাৎ প্লুরা বা গ্ল্যান্ডে বা হার্টে ইত্যাদি) তা ছোঁয়াচে নয়। স্পুটাম পজ়িটিভ টিবির ক্ষেত্রে প্রথম মাস তো বটেই, তার পরেও পরিবারের অন্যদের বিশেষ করে, বয়স্ক ও বাচ্চাদের থেকে দূরে থাকা জরুরি। হাঁচি-কাশির সময়ে মুখ ঢেকে রাখতে হবে বা মাস্ক পরতে হবে। রোগীর ব্যবহৃত জিনিস পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ব্যবহার না করাই ভাল।
একবার টিবি থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তির পরবর্তী সময়ে কি আবার আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকে?
ওষুধ খেয়ে টিবির ইনফেকশন যদি নিয়ন্ত্রিত হয় এবং সেই ব্যক্তি রোগমুক্ত হন, তা হলে দ্বিতীয় বার রোগের আশঙ্কা থেকে যায়, এমনটা কিন্তু নয়। তবে রোগমুক্ত হওয়ার সংজ্ঞা বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষেত্রে আলাদা। ফুসফুসের ক্ষেত্রে এক রকম, লিম্ফনোডের ক্ষেত্রে তা আর এক রকম। দ্বিতীয় বার ইনফেকশন দু’রকম ভাবে হতে পারে। কোনও কারণে জীবাণু হয়তো ভিতরে থেকে গেল, সেটা আবার পরে গিয়ে বহিঃপ্রকাশ ঘটাল। অথবা আবার যদি কারও নতুন করে ইনফেকশন অর্থাৎ রি-ইনফেকশন হয়। ডা. নিয়োগীর কথায়, ‘‘রোগীকে যদি গাইডলাইন অনুসারে ওষুধ দেওয়া হয় এবং তিনি নিয়ম করে ওষুধ খান, তার পর নির্দেশিকা মেনে ডাক্তার তাঁকে রোগমুক্ত বলে ঘোষণা করেন, তা হলে তাঁর দ্বিতীয় বার টিবি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কমই থাকে। সেই সঙ্গে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া, ইমিউনিটি ঠিক থাকা, ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো বিষয়গুলো সুস্থতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। খুব কম ক্ষেত্রেই কারও দ্বিতীয় বা তৃতীয় বার এই রোগ হতে দেখা যায়। যদি তা হয়, সে ক্ষেত্রে ড্রাগ রেজ়িসট্যান্স টিবি এমডিআর অথবা এক্সডিআর এর কথা মাথায় রাখতে হবে।’’
কী কী সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন
অবশ্যই সুস্থ জীবনযাপন করতে হবে। পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া প্রয়োজন। ওষুধগুলোও পুরোপুরি ডাক্তারের নির্দেশমতো খেতে হবে। ওষুধের কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হলে, তা অবিলম্বে ডাক্তারকে জানানো দরকার। রোগী যেন কখনওই নিজে থেকে ওষুধ বন্ধ না করেন। ডা. নিয়োগী বললেন, ‘‘টিবির ওষুধ মিনিমাম ছ’মাস, কোনও ক্ষেত্রে আট মাস, দশ মাস অনেক ক্ষেত্রে দু’বছর পর্যন্ত খেতে হতে পারে। মাস দুয়েক ওষুধ না খেয়ে কেউ যদি ড্রাগ ডিফল্টার হয়ে যান, তা হলে কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে ওযুধের কোর্স সম্পূর্ণ বদলাতে হবে। তাই ওষুধের কোর্স অবশ্যই শেষ করবেন।’’
এ সবের পাশাপাশি সুস্থ থাকার জন্য নেশা থেকে দূরে থাকা বিশেষ ভাবে প্রয়োজন। অন্য রোগ থাকলেও খেয়াল রাখতে হবে, তা যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে। প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য হাই প্রোটিন ডায়েট প্রয়োজন, যদি না সেই ব্যক্তির অন্য কোনও রোগের কারণে হাই প্রোটিন ডায়েটে কোনও রকম নিষেধ থাকে। বিশেষ করে ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে সুগার লেভেল যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তা হলে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পাবলিক প্লেসে যেখানে অন্যের হাঁচি বা কাশি থেকে রোগ ছড়ানোর ভয় থাকে, সেখানেও সাবধানে থাকতে হবে।
পরিশেষে এটাই বলার, টিবি নিয়ে মানুষের মনের সঙ্কোচ কিন্তু এখনও পুরোপুরি যায়নি। যদিও এই রোগটি একটি সাধারণ ব্যাকটিরিয়া জনিত ইনফেকশন মাত্র। একজন মানুষ থেকে অন্য মানুষের মধ্যে ছড়ায়। চিকিৎসার পর সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া যায়। শুধু দরকার গাইডলাইন অনুসারে ওষুধ খাওয়া। এর জন্য সরকারি প্রচেষ্টাও রয়েছে। তাই ভয় না পেয়ে সচেতন হোন, তা হলেই আর এ রোগ নিয়ে কোনও চিন্তা নেই।
মডেল: অলিভিয়া সরকার, ত্বরিতা চট্টোপাধ্যায়; ছবি: অমিত দাস, দেবর্ষি সরকার