বাড়ি তো শুধু বাড়ি নয়। মনের মতো করে তা সাজালে হয়ে ওঠে একটা সম্পূর্ণ অস্তিত্ব। যা জুড়ে থাকে সেই বাড়ির মানুষের রুচি, ব্যক্তিত্ব ও মনের পরিচয়। সে ঘরের আনাচকানাচেই ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে কত গল্পকথা! অনেক বছর আগে কেনা একটা আলমারিই হয়তো সেই গল্পের নায়ক হয়ে ওঠে। আবার দরজার রঙিন কাচ হয়ে ওঠে যেন সেই রূপকথার রাজকন্যা। এমনই এক অন্দরমহলের গল্প বলার পালা।
অন্দরে প্রবেশ
দুপুরশেষে বিকেল নামার মুখে গিয়ে পৌঁছলাম পাম অ্যাভিনিউয়ের এই ফ্ল্যাটে। কাঠের দরজার কারুকাজই তখন আভাস দিচ্ছে আংশিক অন্দরসাজের। দরজা খুললেন স্বয়ং গৃহকর্ত্রী বিনীতা জৈন। আর তার পিছনেই উঁকি দিচ্ছে বছর দশেকের স্তবন। তার আজ তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছে। বাড়িতে অতিথি আসবে শুনে সে-ও দুপুর-বিকেলে তৈরি হয়ে বসে। কী ভাবে আপ্যায়ন করবে, যেন বুঝে উঠতে পারছে না। কখনও সোফার কুশন এগিয়ে দিয়ে, কখনও বই দেখিয়ে বা মিউজ়িক সিস্টেমে গান চালিয়ে মন ভোলাতে লাগল।
ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি অন্দরে। হালকা রঙের দেওয়াল আর গাঢ় পালিশের কাঠের আসবাব এই ফ্ল্যাটকে আকর্ষক করে তুলেছে। ইতালিয়ান রঙিন কাচের কোলাজে তৈরি বারান্দার দরজা। সেখানে পড়ন্ত বিকেলের রোদ যেন আলোর খেলায় মত্ত। কাচের রংও বেশ অন্য রকমের। লাল কাচের অসমাপ্ত টেক্সচার দেখে মনে হয়েছিল, সেগুলি হয়তো পেন্টেড গ্লাস। কিন্তু পরে জানা গেল যে, সেগুলি আসলে লাল কাচ। এই টেক্সচার গৃহকর্তা ডা. রাহুল জৈনের পরিকল্পনা মতোই তৈরি করা হয়েছে। ইতালিয়ান মার্বেলের আদলে ঘরের আসবাবে রয়েছে ঐতিহ্যের ছোঁয়া।
কাঠ ও পিতলের যুগলবন্দি
কাঠের কাজে শৌখিনতা ধরা দিয়েছে আলমারি থেকে শুরু করে ডাইনিং টেবল... সর্বত্র। আলমারি দু’টি পালিশ করিয়ে উপরে নামের আদ্যক্ষর খোদাই করানো হয়েছে। আর সেই আলমারির ভিতরের পালিশ আবার হালকা তুঁতে রঙের। যার উপরে বিদেশি স্ট্যাম্প ও পোস্টকার্ড জমানোর শখই ছবির মতো সাজিয়ে চলেছে আলমারির অন্দরমহল। পিতলের পানের বাটা, বাসনের পাশে কাজ করা কাচের গ্লাসও নজর কাড়ছে সেই আলমারিতে। পিতলের জিনিসও এ বাড়ির অন্যতম আকর্ষণ। পিতলের বেসিন এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে অন্দরে। তার সঙ্গে নকশা করা দু’টি ওয়াল মাউন্টেড প্লেট। রান্নাঘরের টাইল্সও সাদার উপরে সুন্দর ছাপতোলা। স্প্যানিশ এই টাইলস অবশ্য জোগাড় হয়েছে খোদ কলকাতার বুকেই। বসার জায়গার সেন্টার টেবিলটিও বেশ নতুন ধরনের। জানা গেল, বিনীতার বিয়ের সময়ে সেটি এসেছিল তত্ত্বে। আগেকার দিনে রাজা-মহারাজাদের ভেট দেওয়া হত। বিনীতার মায়ের এই অ্যান্টিক কালেকশন বিয়ের সময়েই তাঁর সঙ্গে এসেছে এই বাড়িতে। পরে একই প্যাটার্নের সেন্টার টেবিল তৈরি করে তা উপরে সেট করে দেওয়া হয়েছে। এর ভিতরে স্টোরেজও আছে। এল শেপের একরঙা সোফার পাশে প্রিন্টেড কাপড়ে মোড়া সোফাটি যেন বৈঠকি মেজাজে বসে আছে। আর তার পিছনে হাতের কাজ করা পর্দাও বেশ জুতসই।
পুরাতন-প্রীতি
অ্যান্টিক জিনিসের প্রতি গৃহস্থের মন আছে, তা বোঝা যায়। দেওয়ালে েদখা মিলল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অরিজিন্যাল ম্যানুস্ক্রিপ্ট। ১৯২৪ সালের ২০ ডিসেম্বর বুয়েনস এয়ারেস থেকে দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একটি কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন, তাঁর স্বভাবসুলভ ডুডলিং-সহ। এক কালেক্টরের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করেছেন এই দম্পতি। সযত্ন বাঁধিয়ে রেখেছেন দেওয়ালে। তারই নীচে রয়েছে আসমুদ্রহিমাচল ভারতের একটি মানচিত্র। সেটিও নতুন নয়, প্রমাণ দিচ্ছে তার চারপাশের বিজ্ঞাপনই। আছে রবি বর্মার পেন্টিংও, প্রিন্টেড।
খুদের দুনিয়ায়
বাড়ির খুদেটির ঘরেও রয়েছে পরিণত চিন্তাভাবনা। খুদের ঘর মানেই তা আহ্লাদে ভরপুর নয়। বরং তাতে রয়েছে শিশুর ভবিষ্যতের প্রস্তুতির পরিবেশ। তার সঙ্গেই ইতস্তত ছড়ানো তার মনের খোরাক। বেজ রঙের কাঠের বুকশেলফের গায়ে বাচ্চাদের মতো আঁকিবুকি যেন শিশুসুলভ। সেই তাকে বইয়ের সারি চোখে পড়ার মতো। হ্যারি পটার থেকে শুরু করে রাসকিন বন্ড, স্ট্যাম্প কালেকশনের বই, এনসাইক্লোপিডিয়াও রয়েছে বহাল তবিয়তে। বইয়ের সারি থেকে চোখ সরালে তা আটকে যায় টেবিলের গায়ে সাঁটা কুইলিং দিয়ে তৈরি গ্রিটিংস কার্ড আর সুপারহিরোদের স্টিকারে। বিছানার চাদরে লুডোর ছকও বেশ মজার।
শেষের কথা
বাড়ি তো জড়পদার্থ। বাড়ির মানুষই তাতে প্রাণ সঞ্চার করে। চাদরের ভাঁজে, আধখাওয়া কফির কাপে, উল্টো ভাঁজের খবরের কাগজেই ধরা থাকে সেই প্রাণের স্পন্দন। এখানেও তার অন্যথা নেই। ব্যস্ত গৃহকর্তার স্টাডিও সে রকম। তার কোথাও আধপড়া বইয়ের ভিতর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে বুকমার্ক। কিছু বই সাজানো রয়েছে বইয়ের তাকে। কিছু বই আবার এলোমেলো পড়ে বিছানার উপরে।
গৃহসজ্জা যতই সম্পূর্ণ হোক, বাড়ির আলুথালু বেশই তাকে বাসস্থান করে তোলে। এই অসমাপ্ত চেহারাই আরও মুখর করে তুলল অন্দরমহল!
নবনীতা দত্ত
ছবি: দেবর্ষি সরকার