করোনা নিয়ে আতঙ্ক নয়, সাবধানে থাকুন। ছবি: শাটারস্টক
বীর্যে পাওয়া গেল ভাইরাসের হদিস। লালারসে তার উপস্থিতির কারণে চুম্বন নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন ছিল। করমর্দনে ছিল নিষেধাজ্ঞা। ফলে কতটুকু ঘনিষ্ঠতা নিরাপদ, তা নিয়ে চিন্তায় ছিলেন স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। এবার সেই কফিনে পোঁতা হয়ে গেল শেষ পেরেকটিও।
নড়েচড়ে বসার মতোই ব্যাপার বটে। কারণ কিছুদিন আগে ১২ জন মৃদু উপসর্গের কোভিড রোগীকে নিয়ে এক স্টাডি হয়েছিল। রোগ সেরে যাওয়ার পর তাঁদের বীর্যে ভাইরাসের কোনও চিহ্ন ছিল না। ফলে ভাবা হয়েছিল, যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে রোগ ছড়াবে না। তাঁদের সে আশায় ছাই পড়েছে এবার। হাসপাতালে ভর্তি গুরুতর অসুস্থ কম বয়সি ৩৮ জন রোগীর সিমেন স্টাডি করেন বিজ্ঞানীরা। ১৫ জনের বীর্য নেওয়া হয় রোগের জটিল পর্যায়ে। তার মধ্যে ৪ জনের বীর্যে ভাইরাসের হদিস মেলে। বাকি ২৩ জন দেন রোগ একটু সামলে যাওয়ার পর। তাঁদের মধ্যেও দু'জনের সিমেন পজিটিভ। চিনে হওয়া এই স্টাডিটি বিজ্ঞানীরা প্রকাশ করেছেন 'জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন নেটওয়ার্ক ওপেন'-এ। আর তার পরই হই হই রব দুনিয়া জুড়ে।
কিন্তু কেন? এই স্টাডি থেকে তো বোঝা যাচ্ছে, রোগ হালকাভাবে থাকলে ও পুরোপুরি সেরে গেলে ভয় নেই! আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগ তো হালকাই থাকে! চিন্তা জটিল রোগীদের নিয়ে। তবে বিভিন্ন গবেষণা থেকে যা জানা গেছে, বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষদেরই রোগ জটিল হয় বেশি। তাঁদের দু'এক মাস ধাতস্থ হতে দিলে হয়তো সমস্যা মিটে যাবে। তা হলে বিজ্ঞানীরা এত চিন্তায় পড়লেন কেন?
আরও পড়ুন: প্রতিবেশী বা আবাসনে কেউ করোনা আক্রান্ত? যা যা খেয়াল রাখতেই হবে
চিন্তার কারণ
কারণ আছে বই কি। দু'এক মাসেই যে সমস্যা মিটবে, এমন নাও হতে পারে। কারণ শুক্রাশয়, চোখ, প্ল্যাসেন্টা, ভ্রূণ ও কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র হল এমন জায়গা, যেখানে ভাইরাস থেকে যেতে পারে দিনের পর দিন। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার হাত সেখান পর্যন্ত পৌঁছে চট করে তাদের ধবংস করতে পারে না। শরীরের এই সব গুরুতর অংশকে শরীরের হাত থেকে বাঁচাতেই এই নিদান দিয়েছে সে।
গোলমেলে লাগছে? তা হলে শুনুন। কোনও ব্যাকেটিরিয়া, ভাইরাস বা অন্য কিছুর সূত্রে শরীর যখন ভয়ানক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তাকে উদ্ধার করতে উঠে পড়ে লাগে। যত বিপর্যয় জটিল রূপ ধরে, তত মরিয়া হয়ে ওঠে ইমিউনিটি। জীবাণু মারতে এমন সব রাসায়নিকের ক্ষরণ বাড়াতে শুরু করে, যাদের প্রভাবে মন্দ হয় বেশি। প্রবল প্রদাহ শুরু হয়ে যায় শরীর জুড়ে। গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গগুলি তাল সামলাতে না পেরে একে একে খারাপ হতে শুরু করে। বিপর্যয় নেমে আসে শরীরে। প্রকৃতি হয়তো শরীরের এই কয়েকটি গুরুতর অংশকে এই বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে চায়। তাই সে এমন ব্যবস্থা করেছে, যাতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বাড়াবাড়ি এ সব অংশে না পৌঁছয়। সেই কারণেই এ সব জায়গার ভাইরাস কিছু দিন নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারে।
শারীরিক সম্পর্কের সময় গর্ভনিরোধক ব্যবহারের পরামর্শ চিকিত্সকের। ছবি: শাটারস্টক
এ সব নতুন কথা নয়। বিজ্ঞানীরা জানতেন সবই। তবে সেই জানা কথা নতুন রূপে তাঁদের কাছে এসে হাজির হয় ২০১৩-২০১৬-এই সময়কালে, যখন ওয়েস্ট আফ্রিকান ইবোলা ভাইরাস তার শাখা-প্রশাখা মেলছে। রোগ সেরে যাওয়ার পর বছর তিনেক পর্যন্ত কারও কারও বীর্যে ইবোলা ভাইরাসের হদিস পাওয়া যায়। যৌন সংসর্গের মাধ্যমে সে ছড়ায় বেশ কয়েক মাস পর্যন্ত।
আরও পড়ুন: বর্ষার মরসুমে চিন্তা বাড়াচ্ছে শিশুদের ডায়ারিয়া
তবে কি করোনা ছড়াবে পুরুষ থেকে নারীতে
বীর্যে সে কী মাত্রায় আছে, তা থেকে রোগ ছড়াতে পারে কি না, কতদিন সে একই ভাবে থাকবে ইত্যাদি কোনও তথ্যই হাতে আসেনি এখনও। কাজেই আগে বিজ্ঞান শেষ কথা বলুক। তার পর না হয় এ সব নিয়ে ভাবা যাবে, জানালেন চিকিত্সক সুকুমার মুখোপাধ্যায়।
কী মানতে হবে
"শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি", এমনই বলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামী। "প্রথমত, কোভিড রোগীর বীর্যে পাওয়া গেছে শুধু ভাইরাসের আরএনএ-টুকু। আরএনএ আছে মানেই যে জীবিত ভাইরাসটিও আছে, এমন নয়। আর সে না থাকলে সংক্রমণের গল্প নেই। এবার তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায়, ভাইরাস আছে, ইবোলা বা জিকা-র মতো, তাহলে পরের প্রশ্ন, গুরুতর রোগীর বীর্যে সে যে মাত্রায় আছে, মৃদু বা মাঝারি রোগীর বীর্যেও কি একই ভাবে আছে? বা যাঁর সংক্রমণ হয়েছে কিন্তু কোনও উপসর্গ হয়নি, তাঁর? তৃতীয় প্রশ্ন, রোগ থাকাকালীন বীর্যে ভাইরাস থাকলে, থাকুক। কারণ, রোগী তখন সংক্রমণ এমনিই ছড়াবেন। রোগ সেরে যাওয়ার পর সে কত দিন থাকছে? এই প্রশ্নের উত্তর এখন পাওয়া যাবে না, বলাই বাহুল্য। কাজেই আপাতত, যেমন সাবধান হয়ে চলছেন, তেমনই চলুন। হাত যেমন ধুচ্ছেন, মাস্ক যেমন পরছেন ঠিক তেমন ভাবে শারীরিক সম্পর্কের সময় গর্ভনিরোধক ব্যবহার করুন", বললেন সুবর্ণবাবু।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)