কোনও আন্তর্জাতিক মেডিক্যাল জার্নালে এই টিকা সংক্রান্ত গবেষণার কথা প্রকাশিত হয়নি। ফাইল ছবি।
ভ্লাদিমির পুতিনের ঘোষণায় সাড়া পড়ে গিয়েছে পৃথিবী জুড়ে। স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিনের সফল প্রয়োগের খবর জানিয়ে রুশ রাষ্ট্র প্রধানের দাবি, এ বারে জব্দ হবে অতিমারি সৃষ্টিকারী কোভিড ১৯ ভাইরাস। কিন্তু সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ দেবকিশোর গুপ্ত জানালেন, “প্রথমত গবেষণার পর কোনও কার্যকর টিকা প্রয়োগ করার আগে কোনও মেডিক্যাল জার্নালে সেই গবেষণা পত্র প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এই টিকার গবেষকরা সেই পথ মাড়াননি। ধরা যাক, মহামারি আটকানোর তাড়ায় গবেষণা পত্র জার্নালে পাঠানোর সময় পাওয়া যায়নি। কিন্তু ভ্যাকসিন প্রয়োগের আগে ফেজ থ্রি ট্রায়াল তো বাধ্যতামূলক। স্পুটনিক ভি-র ক্ষেত্রে ফেজ থ্রি ট্রায়ালও অসম্পূর্ণ।”
ফেজ থ্রি ট্রায়াল দিতে হয় ৩০০ থেকে ৩০০০ মানুষের ওপর। টিকা দেওয়ার পর কিছু দিন কার্যকারিতার ওপর নজর রাখা হয়। সময় লাগে কয়েক মাস। রাশিয়ার আবিষ্কৃত টিকার ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। এই প্রসঙ্গে দেবকিশোরবাবু জানালেন, “টিকা বাজারে ছাড়ার ব্যাপারে ফেজ থ্রি ট্রায়াল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ট্রায়ালে তিনটি জিনিস দেখা হয়। এক টিকাটি কতটা নিরাপদ, দুই এর কার্যকারিতা এবং তিন, টিকার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। ফেজ টু অবধি স্বল্প মেয়াদি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া জানা গেলেও ফেজ ট্রি ট্রায়ালে দীর্ঘ মেয়াদি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া জানা যায়। ন্যূনতম তিন মাস না পেরলে দীর্ঘমেয়াদি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বোঝা সম্ভব নয়।”
তাই স্পুটনিক ভি-র নিরাপত্তা নিয়ে একটা বড় প্রশ্ন চিহ্ণ থেকেই যায়। ভ্লাদিমির পুতিনের বক্তব্য, টিকা দেওয়ার পর টেস্ট করে দেখা গিয়েছে যে, শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই অ্যান্টিবডি মানুষের শরীরে কত দিন কার্যকর থাকবে সে বিষয়ে কিছুই জানা যায়নি। “এই সব না জেনে গণহারে টিকা দেওয়ার ব্যাপারটা চিকিৎসক হিসেবে আমি সমর্থন করি না”— বললেন দেবকিশোরবাবু।
আরও পড়ুন: করোনা যুদ্ধে বাজিমাত রাশিয়ার? বিশ্বে প্রথম টিকা তৈরির দাবি পুতিনের
ভাইরোলজিস্ট সিদ্ধার্থ জোয়ারদারের মতে, “উন্নত দেশের একজন রাষ্ট্রপ্রধান যখন দায়িত্ব নিয়ে বিশ্বের মানুষের কাছে টিকার ব্যাপারটা ঘোষণা করেছেন তখন নিশ্চয়ই এর পিছনে একটা যুক্তি আছে। ও দেশের বিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই রাষ্ট্রপ্রধানকে ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলেছেন এবং প্রমাণ দাখিল করেছেন। তাই তিনি এ কথা জোর দিয়ে ঘোষণা করতে পেরেছেন।”
পুতিনের বক্তব্য, টিকা দেওয়ার পর দেখা গিয়েছে, শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
তবে একটা ব্যাপারে সিদ্ধার্থবাবুর সংশয় আছে। যে হেতু কোনও আন্তর্জাতিক মেডিক্যাল জার্নালে এটি প্রকাশিত হয়নি, তাই বিশ্বের বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। এ ছাড়া স্থানীয় ভাবে টিকা কার্যকর হলেও অন্য দেশে এর কোনও কার্যকারিতা থাকবে বলে মনে হয় না। কেননা কোভিড ১৯ ভাইরাসটি এক এক দেশে এক এক ভাবে সংক্রমণ সৃষ্টি করছে। সবার জন্য টিকা কার্যকর কি না জানতে গেলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ওপর ট্রায়াল দিতে হয়। কিন্তু রাশিয়ার টিকাটির ব্যাপারে সেই ট্রায়াল হয়নি।
আরও পড়ুন: বার বার ব্যবহার করতে হচ্ছে সাবান-স্যানিটাইজার, কী করবেন?
স্পুটনিক ভি টিকার অ্যান্টিবডি লেভেল এবং সেলুলার রিঅ্যাক্টিভিটি সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেও কিছুই জানানো হয়নি। হু-র নির্দেশিকা অনুযায়ী নতুন টিকা সবাইকে দেবার আগে বেশ কয়েকটি ট্রায়াল দিতে হয়। ব্যাপারটা কিছুটা সময়সাপেক্ষ। অ্যানিম্যাল ট্রায়ালের পর প্রথম পর্যায়ে হিউম্যান ট্রায়ালে ২০ থেকে ৮০ জনের ওপর টিকা প্রয়োগ করা হয়। এর পর দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫০০ জন বা তারও বেশি মানুষের ওপর ট্রায়াল হয়। তৃতীয় পর্যায়ে ৩০০০ থেকে ৫০০০ মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয়। ফোর্থ স্টেজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কয়েক লক্ষ মানুষকে টিকা দিয়ে তাঁদের নজরে রাখতে হয়, কারও কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হল কি না দেখা হয়। এ ছাড়াও টিকা কত দিনের জন্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করছে তাও দেখতে হয়। রাশিয়ার টিকার ক্ষেত্রে এ সবই অজানা। টিকা কত দিন কার্যকর এবং তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কিছুই স্পষ্ট নয়।
আরও পড়ুন: কেউ উপসর্গহীন বাহক, কেউ করোনা সংক্রমিত, ভাইরাসের আচরণ বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কেমন
তবে একমাত্র আশার ব্যাপার, এই ভাইরাসটির নানা রকম স্ট্রেন আছে। সিদ্ধার্থবাবুর মতে, “যদি রাশিয়ার মতো অনেকগুলি দেশ স্থানীয় ভাবে কোভিড ১৯ ভাইরাসের বিভিন্ন স্ট্রেনের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারে, তা হলে এই অতিমারিকে আটকে দেওয়া সহজ যাবে।”
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)