করোনা সংক্রমণের পর প্রথম দিকে অল্পস্বল্প উপসর্গ থাকলেও শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে। ফাইল ছবি।
হাসপাতালে বেড নেই, সরকারি বা বেসরকারি সব হাসপাতালই ভর্তি। কোভিডের সামনের সারির যোদ্ধাদের জন্যও নেই। অগত্যা মারাত্মক সমস্যা না হলে হাসপাতালের দিকে পা বাড়াচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। আর হয়তো বা এই কারণেই অকালমৃত্যু ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অল্পবয়সী কোভিড আক্রান্তদের।করোনা আক্রান্ত হয়ে শ্রীরামপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ৩৮ বছরের দেবদত্তা রায়ের মৃত্যু সাধারণ মানুষকে এক বিরাট প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
এত দিন পর্যন্ত জানা ছিল, কোভিড-১৯ বয়স্ক এবং কোমর্বিডিটি আছে এমন মানুষদের জন্যই ভয়ঙ্কর। দেবদত্তা রায়ের কোনও কোমর্বডিটি ছিল বলে জানা যায়নি। তাহলে অল্প বয়সে তাঁর মৃত্যুর কারণ কী! মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় জানালেন অতিমারি সৃষ্টিকারী নভেল করোনা ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি জানতে এখনও আরও কিছু সময় লাগবে। এই ভাইরাস কখন যে কীভাবে মারাত্মক আকার নেবে সে বিষয়ে আমরা এখনও কিছুটা অন্ধকারে আছি বলে জানালেন চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের ঘটনাটির প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত মতামত হল,বয়স অল্প হওয়ার কারণে উনি রোগটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। কেননা, বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা, কোনও কোমর্বিডিটি না থাকলে এবং বয়স ৬০ বছরের নীচে হলে কোভিড সেরকম কোনও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু নতুন ভাইরাসটির অনেক চরিত্রই আমাদের অজানা।’’
সুকুমারবাবুর অভিমত, অনেক সময় নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর প্রথম দিকে অল্পস্বল্প উপসর্গ থাকলেও শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। এক্ষেত্রে রোগীকে স্থিতিশীল রাখতে উপসর্গভিত্তিক ওষুধ দেওয়ার পাশাপাশি অক্সিজেন দিতেই হয়। বাড়িতে থাকাকালীন তাঁর শরীরে অক্সিজেনের অভাব হয়েছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। যখন কষ্ট শুরু হয়েছে তখন হয়তো রোগ অনেকটা মারাত্মক আকার নিয়েছে। ভাইরাসের সংক্রমণে ফুসফুসের সূক্ষাতিসূক্ষ্ম রক্তজালিকায় ব্লাড ক্লট বা রক্তের ডেলা আটকে গিয়ে অক্সিজেনের ঘাটতি শুরু হয়। এই অবস্থায় অনেকের শরীরে সাইটোকাইন স্ট্রম নামে এক ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই অবস্থা থেকে রোগীকে ফিরিয়ে আনার জন্য যে ধরনের ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হয় সব হাসপাতালে সেই ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি, বললেন সুকুমারবাবু। আবার ব্যবস্থার যথযথ প্রয়োগ হলেও যে রোগী বেঁচে যাবেন সে কথাও বলা যায় না। দেবদত্তা রায় উপযুক্ত ব্যবস্থাযুক্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যথাযথ চিকিৎসা পেয়েছিলেন কিনা সেবিষয়ে জোর দিয়ে কিছু বলা যায় না। সময় থাকতে চিকিৎসা না করালে শুধু নভেল করোনাই নয়, যে কোনও অসুখ যে কোনও বয়সের জীবনহানির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে জানালেন সুকুমারবাবু।
আরও পড়ুন: ফ্রিজ থেকে কি করোনা ছড়ায়? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা, জেনে নিন
কোমর্বিডিটি নেই, বয়সও কম, তা-ও কোভিড-১৯ আক্রান্তের মারা যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করায় ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশালিস্ট দীপঙ্কর সরকার বললেন, মহামারি বা অতিমারির চিকিৎসার সঙ্গে টি টোয়েন্টি ক্রিকেট ম্যাচের তুলনা করলে মুশকিল। দুটো বাউন্ডারি হাঁকালে ম্যাচ জেতার মতো অমুক ওষুধ বা অক্সিজেন দিলেই মুমূর্ষু রোগী সটান উঠে দাঁড়িয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন, ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়। সত্যি কথা বলতে কি, এই ধরনের মহামারির ক্ষেত্রে চিকিৎসার সময় কোনও সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন মেনে চলার ব্যাপারটাও একটু গোলমেলে। প্রত্যেকটি মানুষের রোগের ধরন ও শরীরের অবস্থা এক নয়, এক এক জনের ক্ষেত্রে এক এক রকম উপসর্গ ও অন্যান্য অসুবিধা দেখা যায়।
কোভিড-১৯ একটা চ্যালেঞ্জ, প্রতি মুহূর্তে লড়াই করছেন চিকিৎসকরা। ফাইল ছবি।
গত কয়েক মাসে এমন কিছু রোগী পাওয়া গিয়েছে, যাঁদের জ্বর-কাশি-শ্বাসকষ্ট কিছুই নেই। অথচ কোভিড পজিটিভ সেই রোগীর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা অত্যন্ত কম, বললেন দীপঙ্করবাবু। সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে অক্সিজেন দিয়ে মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছন আটকে দেওয়া হয়েছে। করোনার উপসর্গ হিসেবে জ্বর, কাশি, পেটের সমস্যা ছাড়াও অনেকের শরীরে ধীরে ধীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যেতে পারে। তাঁদের ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে রোগীর অবস্থা মারাত্মক হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। নভেল করোনার সংক্রমণ হলে কার অবস্থা আচমকা কতটা মারাত্মক হয়ে যেতে পারে সেই তথ্য এখনও আমাদের অজানা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্দেশিকা মেনে চিকিৎসা করে রোগীকে সুস্থ করা গেলেও আচমকা অনেক কম ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের অবস্থা জটিল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। আর সেই কারণেই কোভিড-১৯-এর চিকিৎসা করা আমাদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ, বললেন দীপঙ্করবাবু।
আরও পড়ুন: ‘ফেল’ নয়, ‘এসেনশিয়াল রিপিট’, সিবিএসই বোর্ডের সিদ্ধান্তে প্রভাব পড়বে পড়ুয়া মনস্তত্ত্বে?
চল্লিশ বছরের কম বয়স এবং ব্লাড প্রেসার বা ডায়াবিটিস না থাকা সত্ত্বেও কোভিড-১৯ আক্রান্ত দেবদত্তা রায়ের আচমকা মৃত্যুর পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে বলে জানালেন জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী। আগে মনে করা হয়েছিল কোভিড-১৯ শ্বাসনালী ও ফুসফুসকে আক্রমণ করে বলেই মারাত্মক আকার নেয়। কিন্তু পরবর্তী কালে জানা গেল, ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে সূক্ষ্ম রক্তজালিকায় রক্তের ডেলা আটকে যাওয়ার জন্য শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়াই শ্বাসকষ্ট ডেকে আনে। তবে নিঃশ্বাসের কষ্ট শুরুর আগে শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। কিন্তু কোনও রকম উপসর্গ থাকে না। একে বলে হ্যাপি হাইপক্সিয়া।
শ্রীরামপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ৩৮ বছরের দেবদত্তা রায়ের মৃত্যু হল করোনায়। ফাইল ছবি।
কোভিড-১৯ পজিটিভ হলে সেরকম কোনও শারীরিক সমস্যা না থাকলে রোগীকে হোম কোয়রান্টিনে থাকার কথা বলা হলেও নিয়মিত মনিটরিং প্রয়োজন, বললেন সুবর্ণবাবু। বিশেষ করে শরীরে অক্সিজেন স্যাচুরেশন জানতে পালস অক্সিমিটারের সাহায্য নিতে হবে। যদি শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে ৯৫ শতাংশ হয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় ওষুধ শুরু না করলে রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি খুব বেশি। হোম কোয়রান্টিনে থাকলে ওষুধ দেওয়া হয় না।
আরও পড়ুন: সার্জারির পর কমিয়ে রাখা হয় 'ইমিউনিটি', অর্গ্যান ট্রান্সপ্লান্ট নিয়ে যা জানতেই হবে
নিয়ম করে অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাপা মুশকিল হয়, বললেন সুবর্ণবাবু। দেবদত্তা রায়ের ক্ষেত্রে হয়তো বা এরকম কিছু হয়েছিল। যেহেতু কাজের সূত্রে তাঁকে অনেক মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়েছিল তাই তাঁর ভাইরাল লোড, অর্থাৎ শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ অত্যন্ত বেশি ছিল বলে মনে হয়। তাই আর চিকিৎসা করার সুযোগ পাওয়া যায়নি।