পরিবার ও বন্ধুদের থাকতেই হবে পাশে। ছবি: শাটারস্টক
যে কোনও বড় দুর্ঘটনার পরই কিছু মানুষ পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেসে বা রোগ-পরবর্তী মানসিক চাপে ভুগতে শুরু করেন। সে বন্যা হোক বা ভূমিকম্প কিংবা ধর্ষণ, মহামারি, যুদ্ধ বা বড় কোনও দুর্ঘটনা, আতঙ্কের স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে তাঁদের মনে। ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে। রাতের পর রাত ঘুমোতে পারেন না। দুঃস্বপ্ন দেখেন। মনে হয়, জীবন শেষ হয়ে গেছে, আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না।
যাঁরা নিজে থেকে বা কারও সহায়তায় বা মানসিক চিকিৎসায় মাসখানেকের মধ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন, তাঁদের সমস্যা মিটে যায়। যাঁরা পারেন না, তাঁরা হয় নিজেকে শেষ করে দেওয়ার সুযোগ খোঁজেন, নয়তো অর্ধোন্মাদ হয়ে জীবন কাটাতে থাকেন। দুশ্চিন্তা বা স্ট্রেস পুরোদস্তুর ডিজঅর্ডারে পরিণত হয়। যার নাম 'পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসর্ডার' বা পিটিএসডি।
কোভিড জাঁকিয়ে বসার পরও শুরু হয়েছে এই ব্যাপার। সারা পৃথিবী জুড়েই। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, চিনের উহানে সাধারণ অবস্থায় যেখানে এক শতাংশ মানুষের পিটিএসডি ছিল, কোভিডের পর তা বেড়ে হয়েছে ৭ শতাংশ। যেখানে জটিল ধরনের কোভিডের প্রকোপ বেশি ছিল, পিটিএসডি-ও সেখানে বেশি হয়েছে। প্রায় ১৮.৪ শতাংশ।
যেখানে রোগের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে কম ছিল, সেখানে হয়েছে ৫.২ শতাংশ মানুষের। এই তালিকায় শুধু যে রোগীরা রয়েছেন এমন নয়। যাঁদের রোগ এখনও হয়নি, কিন্তু রোগের আতঙ্কে প্রহর গুনছেন, তাঁরা আছেন। বাদ যাননি স্বাস্থ্য কর্মীরাও। প্রবল চাপের মুখে দিনরাত রোগী ঘাঁটতে ঘাঁটতে, তাঁরাও এক সময় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে প্রায় ৪.৪ শতাংশ মানুষ পিটিএসডি-তে আক্রান্ত হচ্ছেন।
আরও পড়ুন: করোনা মোকাবিলায় মেডিক্যাল কলেজে প্লাজমা ব্যাঙ্ক, কতটা কাজ করবে এটি?
কেন এমন
“আতঙ্কের ধকল সামলানোর ক্ষমতা সবার সমান থাকে না। কেউ বড় সমস্যাও সহজে সামলাতে পারেন, কেউ ভেঙে পড়েন ছোট আঘাতেই। সেই জন্যই দেখা যায় উদ্বেগপ্রবণ মানুষের সমস্যা বেশি হয়।” জানালেন মনোচিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম।
এ ছাড়া স্কিৎজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজঅর্ডার বা মেজর ডিপ্রেশনের রোগী, যাঁরা একাকিত্বে ভোগেন, নিউরোটিক পার্সোনালিটি অর্থাৎএকটুতেই যাঁদের রাগ-দুঃখ-হতাশা-উদ্বেগ-অপরাধবোধ বা ভয় মাত্রা ছাড়ায়, নেশা করেন, অনিদ্রায় ভোগেন, আইকিউ কম, তাঁদের বিপদ বেশি হয়। বেশি হয় মহিলাদেরও। একাধিক বড় দুর্ঘটনা এক সঙ্গে ঘটলে সমস্যা বাড়ে।
সমস্যা বাড়ে তাঁদের, যাঁরা ছোটবেলা থেকে কোনও দুর্ঘটনার স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন। আবার যাঁরা সমস্যা সমাধান করার চেয়ে এড়িয়ে যাওয়া বেশি পছন্দ করেন বা কারও সাহায্য ছাড়াই সব কিছু সামলে ফেলতে পারবেন বলে ভাবেন, তাঁদেরও অনেক সময় বিপদ হয়। এ কথা বললেন চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম।
আরও পড়ুন: খুলে যাচ্ছে জিম ও যোগকেন্দ্র, কী আছে কেন্দ্রের নির্দেশিকায়?
যাঁদের পরিবার ও বন্ধু সহৃদয়, মনের কথা খুলে বলতে পারেন, বিপদের মোকাবিলা করার সাহস আছে, সব কিছুর ভাল দিক দেখেন, পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন, আধ্যাত্মিক চেতনা আছে, তাঁদের সমস্যা কম হয়।
ভাইরাস এবং চিকিৎসাও বিপদের কারণ
বিভিন্ন স্টাডি থেকে জানা গেছে, জটিল কোভিড রোগীদের বিপদ বেশি হয়। এর মূলে কিছুটা হাত আছে ভাইরাসের, কিছুটা প্রাণান্তকর চিকিৎসার। ভাইরাস অনেক সময় ব্রেনেও ছড়ায়। ফলে মুড সুইং, দোটানা, অবুঝপনা ও চিন্তাভাবনার অসঙ্গতি বেশ কিছুদিন থেকে যায় অনেকের। কারও হয় অবসাদ। রোগ যত জটিল হয়, পাল্লা দিয়ে বিপদ বাড়ে।
আমেরিকায় হওয়া এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি কোভিড রোগীদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশের আইসিইউ কেয়ার লাগে। তার মধ্যে যতজন বাঁচেন, তাঁদের প্রায় ৯৬ শতাংশের পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেসের উপসর্গ হয়। এর কারণ, রোগ ও চিকিৎসার প্রবল কষ্ট।
জটিল রোগীদের আইসিইউ-তে যেভাবে চিকিৎসা করা হয়, নাকে-গলায় নল ঢোকানো, ভেন্টিলেটরের সঙ্গে যুক্ত করা ইত্যাদি, তার কষ্ট অমানুষিক। কষ্ট কমাতে কখনো বেশি করে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়। স্টাডি থেকে জানা গেছে, এতেও আবার পিটিএসডি-র আশঙ্কা বাড়ে। তবে শুধু কোভিডের ক্ষেত্রে নয়, যে কোনও জটিল আইসিইউ রোগীর ক্ষেত্রেই এ কথা সত্যি। আইসিইউ-তে বেশ কিছুদিন কাটানোর পর অনেক রোগীরই পুরোদস্তুর ডিজঅর্ডার না হলেও পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেসের উপসর্গ দেখা দেয়।
রোগ যত জটিল হয়, পাল্লা দিয়ে বিপদ বাড়ে। ছবি: শাটারস্টক
সামাজিক কারণও জড়িত
কোভিড রোগীরা খুব একা হয়ে যান। সংক্রমণের ভয়ে কেউ তাঁদের ধারেকাছে ঘেঁষেন না। ফলে রোগের প্রকোপে শরীরে-মনে বিধ্বস্ত রোগীর যে ভালোবাসা ও সেবার দরকার হয়, তা সেভাবে পান না তাঁরা। একটু সেরে ওঠার পর তার সঙ্গে যোগ হয় জীবন-জীবিকার চরম অনিশ্চয়তা, সামাজিকভাবে একঘরে হওয়ার ভয়। প্রবল হেনস্থা। বিজ্ঞানীদের মতে, এসবের কারণেই সার্স, মার্স, ইবোলা ইত্যাদির মহামারির সময় যত জন পিটিএসডি-তে আক্রান্ত হয়েছিলেন, কোভিডে হচ্ছেন বা হবেন তার চেয়ে আরও অনেক বেশি মানুষ।
আরও পড়ুন: নিজে থেকে কোভিড টেস্ট করা কতটা জরুরি? কী বলছেন চিকিৎসকরা?
সমাধান
• কোভিডের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। কারণ রোগ একবার হলে, তা সে যত মৃদুই হোক-না কেন, এত রকম ধকল সামলাতে হবে যা দুর্বল মনের মানুষের জন্য এক বিরাট চাপের ব্যাপার।
• পিটিএসডি-র রিস্ক ফ্যাক্টর থাকলে আগে থেকে সতর্ক থাকুন। সামান্যতম উপসর্গ দেখা দিলেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ কিন্তু নিজে থেকে সারবে না। ফেলে রাখলে পরিস্থিতি জটিল হবে দিনে দিনে।
• মনোচিকিৎসকের পরামর্শ নিলে, তিনি কখনোও থেরাপি করবেন, কখনোও ওষুধ দেবেন, কখনও আবার দুটোরও প্রয়োজন হতে পারে।
• থেরাপির মধ্যে প্রধান হল কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি। পরিস্থিতিকে যেভাবে দেখার ফলে মানুষটির মনে ভয় ঢুকেছে, তাকে কাটাছেঁড়া করে থেরাপিস্ট ভুলগুলোকে চিহ্ণিত করেন। ও কীভাবে সেই সব ভাবনাকে শুধরে বাস্তবমুখী চিন্তা করতে হবে তা শেখান ধাপে ধাপে।
• প্রয়োজন হলে ১২ সপ্তাহ ধরে করা হয় কগনিটিভ প্রসেসিং থেরাপি। সপ্তাহে এক-দেড় ঘণ্টার সেশন। প্রথমে রোগীকে পুরো ঘটনা, মনের ভাব, ভয়ের কারণ খুলে বলতে বলা হয়। তারপর বলা হয় লিখতে। এই লেখার পর্বেই থেরাপিস্টের সাহায্যে রোগী ধীরে ধীরে বুঝে যান, তাঁর সমস্যা কোথায় ও কীভাবে তাঁকে চলতে হবে।
• কারও ক্ষেত্রে করা হয় আই মুভমেন্ট ডিসেন্সিটাইজেশন অ্যান্ড রিপ্রসেসিং থেরাপি। সপ্তাহে একদিন করে তিন মাস। এতে থেরাপিস্টের হাত নাড়ানো, লাইট জ্বালানো বা কোনও বিশেষ আওয়াজের দিকে মন দিতে বলা হয় রোগীকে। কষ্টের বিষয় থেকে মন ঘুরিয়ে অন্যদিকে এনে ফেলাই এই থেরাপির উদ্দেশ্য।
• স্ট্রেস ইনকুলেটিং ট্রেনিংয়ে মাসাজ, ব্রিদিং ও অন্য রিল্যাক্সেশন এক্সারসাইজের সাহায্যে কী ভাবে মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তা শেখানো হয়।
• এসবে কাজ না হলে দেওয়া হয় ওষুধ। কখনও প্রথম দিকেও দিতে হয়। সঙ্গে দরকার হয় বাড়ির লোকের সহযোগিতা। সবে মিলে ধীরে ধীরে রোগী স্বাভাবিক হয়ে ওঠেন।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)