কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চলছে সারা বিশ্বে। ফাইল ছবি।
কবে আসবে কোভিড ভ্যাকসিন? ভ্যাকসিন এলেই কি করোনাকে দূরে রাখা যাবে? চিন্তিত সারা বিশ্ব। ভ্যাকসিন গবেষণা, উৎপাদন ও সুষম বণ্টনের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র সহযোগিতায় তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক জোট । বিজ্ঞানের আলো যাতে প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, সে বিষয়েই নিশ্চিত হতে চাইছেন সারা বিশ্বের বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক মহল। সম্প্রতি ‘কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্ক গ্রুপ’ এ বিষয়ে একটি ওয়েবিনারের আয়োজন করেছিল। ছিলেন বিশ্বের নানা প্রান্তের বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা। ছিলেন রাজ্যের কয়েক জন আশা কর্মী, সরকারি হাসপাতালে কর্মরত নার্স এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীরাও। সাধারণ মানুষকে ভ্যাকসিনের বিষয়ে সচেতন করতে এবং করোনা ঠেকাতে কী কী মাথায় রাখতে হবে, আলোচনায় সে বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করলেন বিশিষ্ট জনেরা।
ওয়েবিনারে ছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্কের সদস্য চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী, ইমিউনোলজিস্ট (রোগ প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ) সত্যজিৎ রথ, সংক্রামক ব্যাধি চিকিৎসক সায়ন্তন বন্দ্যোপাধ্যায়, চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকার, ভ্যাকসিন কনফিডেন্স প্রকল্পের অধিকর্তা তথা ‘লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিকাল মেডিসিন’-এর সংক্রামক ব্যাধি বিভাগের অধ্যাপক হেইডি লারসন। তিনি গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনের (জিএভিআই)-এর এক জন শীর্ষকর্ত্রীও বটে। তাঁদের আলোচনায় উঠে এল ভ্যাকসিন সংক্রান্ত নানা তথ্য।
কেন কোভিড ভ্যাকসিন গবেষণা দ্রুত এগোচ্ছে
গুটিবসন্ত বা ইনফ্লুয়েঞ্জার সময় বিজ্ঞান এতটা উন্নত ছিল না। এখন প্রযুক্তি আরও উন্নত। তাই জিন সিকোয়েন্সও দ্রুত করা গিয়েছে। এ ছাড়াও আফ্রিকায় ইবোলা ছড়িয়ে পড়ার সময় মানুষ বুঝতে পেরেছে, নতুন একটা রোগ এলে প্রস্তুত থাকতে হবে। সেই সময় সারা বিশ্বে একটা তহবিল সংক্রান্ত জোটের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। এই ‘সেপি’ বা ‘কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস’ থাকায় করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণাও দ্রুততর হয়েছে। তাই অন্য রোগের থেকে কোভিডের ভ্যাকসিন তৈরির সময়রেখাও অনেকটাই এগিয়ে।
আরও পড়ুন:নিউ নর্মালে নানা রোগ বাড়াচ্ছে দূষণ
কোভিডের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। তাই গুজব থেকে সাধারণ মানুষকে দূরে রাখার দায়িত্ব নিতে হবে প্রশাসনকেই। বহু দেশ ভ্যাকসিনকে কুক্ষিগত করে রাখতে চাইছে। তাই এ দেশেও ভ্যাকসিন কারা আগে পাবেন, এ নিয়ে রাজনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক স্তরে দ্রুত আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন। মানুষের অর্থবল কম। তাই নিখরচায় ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, হেইডি লারসন এবং অভিজিৎ চৌধুরী।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিতের কথায়, ‘‘আমি আশাবাদী, একটা ভ্যাকসিন ২০২১ সালের মধ্যে অন্তত আসবেই।’’ তাঁর কথায়, ‘‘ভ্যাকসিন উৎপাদনের বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। কারণ, বিশ্বে প্রায় ৭০০ কোটি মানুষের বসবাস। তবে ভ্যাকসিন তৈরিতে সময় লাগবে। তৈরির পরেও দীর্ঘ সময় লাগবে উৎপাদনে। সেরাম ইনস্টিটিউটের দাবি, ১০ কোটি ভ্যাকসিন তৈরি করবে তারা। কিন্তু সেটাও কঠিন কাজ। ভ্যাকসিন কত শতাংশ কার্যকর, কত জনের জন্য, কত দিনের জন্য তৈরি হবে সেটা এখনও কেউ জানি না। তাই ধৈর্য ধরতে হবে।’’
ভ্যাকসিন এলেই প্রয়োগ নয়, প্রয়োজন আরও অপেক্ষার
অভিজিতের কথায়, ‘‘ভাইরাস চারিত্রিক বৈশিষ্ট ক্রমাগত বদলাতে থাকে। তাই ফ্লু-এর ভ্যাকসিনও প্রতি বছর বদলাতে হয়। একাধিক ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হলে তাদের কর্মক্ষমতাও আলাদা হবে। ফলে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পরবর্তী ধাপটা অনেক সময়সাপেক্ষ। কারা প্রথম ভ্যাকসিন পাবেন, সে বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। সে ক্ষেত্রে আর্থিক অবস্থান নির্বিশেষে যাঁদের প্রয়োজন, তাঁদেরই যেন ভ্যাকসিন দেওয়া হয়।’’ কলকাতা শহরে যাঁদের কো-মর্বিডিটি আছে, রাজ্য প্রশাসন তাঁদের তালিকা তৈরি করছে। অভিজিতের অনুরোধ, সেই তালিকা যেন গোটা রাজ্যের জন্যই তৈরি হয় এবং প্রত্যন্ত এলাকার মানুষদের কাছে যেন স্থানীয় স্তরে ভ্যাকসিন পৌঁছতে পারে। এই তালিকা তৈরির কাজ, সমবণ্টন এবং দুর্নীতি ঠেকানোর বিষয়টি নিয়ে এখন থেকেই পরিকল্পনা করা প্রয়োজন বলেই মনে করেন অভিজিৎ। পাশাপাশিই, তিনি বলেন, ‘‘শুধু রাজনীতি নয়, ভ্যাকসিন আগে বাজারে এনে মুনাফা লাভের জন্য বিভিন্ন নির্মাতা সংস্থার মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’’
আরও পড়ুন:স্বাদ-গন্ধের অনুভূতি নেই মানেই কি করোনা, কী বলছেন চিকিৎসকরা
ভ্যাকসিন এলেই কি করোনা উধাও
এমন প্রশ্ন অনেকেরই। কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্কের সদস্য চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরীর কথায়, ‘‘এই প্রশ্নকে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে দেখতে হবে। ভ্যাকসিন এসে গেলেই সমস্যা মিটে যাবে। এক দফা ভ্যাকসিন খেলেই করোনা চলে যাবে, এই সরলীকৃত ধারণাটা ঠিক নয়। ভ্যাকসিন কোনও জিয়নকাঠি নয়। ভ্যাকসিন এলেই যে মাস্ক পরা বন্ধ করে, সব বিধি ভুলে আগের মতো জীবনযাপন শুরু করা যাবে, এমনটাও নয়। মাস্ক পরা বন্ধ করা যাবে না কোনও মতেই।’’
ভ্যাকসিন তৈরিতে সময় লাগবে, সময় লাগবে উৎপাদনেও। ফাইল ছবি।
মনে রাখা জরুরি
১। ভ্যাকসিন করোনা ঠেকানোর অন্যতম পথ। কিন্তু একমাত্র পথ নয়।
২। ভ্যাকসিন উৎপাদনের পর তা প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছনো নিশ্চিত করতে হবে প্রশাসনকে।
৩। উৎপাদনের পাশাপাশি ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে বণ্টনের দিকটিতেও সমান দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের কাছেও ভ্যাকসিন পৌঁছনোর ব্যবস্থা করতে হবে। সেই পরিকল্পনা নিতে হবে।
৪। ১৩০ কোটির দেশে প্রথম পর্যায়েই ভ্যাকসিন সকলের কাছে পৌঁছনো অসম্ভব। প্রথমে কাদের সেটি দিতে হবে, তা-ও ঠিক করে নিতে হবে। প্রথম সারির করোনা যোদ্ধা যেমন চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়াও কো-মর্বিডিটি ফ্যাক্টরসম্পন্নদের প্রাধান্য দিতে হবে।
ভ্যাকসিন কবে আসবে
হেডি লারসন বলেন, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের নির্দিষ্ট দিন বলা বিজ্ঞানের পক্ষে সম্ভব নয়। সবাই আশাবাদী হতেই পারেন। কিন্তু ভ্যাকসিন আগে তৈরি করা নিয়ে যে দৌড় শুরু হয়েছে, তা সাধারণ মানুষের জন্য ঠিক নয়। এতে বরং মানুষের দুশ্চিন্তা বাড়ছে।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)