ওজন বেশি মানেই মেটাবলিক সিনড্রোম। কোভিড হওয়ার আশঙ্কাও বেশি এই কারণেই। ছবি: শাটারস্টক
করোনা আবহে বেশিরভাগ সময়টাই কেটেছে বাড়িতে, বেড়েছে ওজন। ওজন একেবারে নিক্তির মাপে থাকতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, উচ্চতা অনুযায়ী ওজন যা হওয়ার কথা, তার চেয়ে ১০-১৫ শতাংশ বেশি থাকলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল থাকে। অসুখ-বিসুখ কম হয়। ফিটনেসও কিছু কম থাকে না। কিন্তু জীবনযাত্রাও জড়িয়ে রয়েছে এর সঙ্গে। বেশি ওজন যে কোনও রোগের মতোই করোনার ক্ষেত্রেও ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। শুধু করোনার ঝুঁকি নয়, আক্রান্ত হলে জটিলতার আশঙ্কাও বাড়বে এ ক্ষেত্রে।
কেউ যদি সঠিক খাবার খেয়ে ও পর্যাপ্ত ব্যায়াম করে ওজন একদম মাপে মাপে নিয়ে আসতে পারেন, তাতে কোনও ক্ষতি নেই। কিন্তু কেউ যদি তা না পারেন, তাঁরও টেনশন করার কিছু নেই, সুস্বাস্থ্যের দিক থেকে অন্তত। তবে বাড়তি ওজনের সঙ্গে যদি কিছু অসুখ-বিসুখ থাকে, যেমন ডায়াবিটিস, হাই প্রেশার-কোলেস্টেরল, হৃদরোগ ইত্যাদি, তবে তা চিন্তার ব্যাপার। তখন ওই অতিরিক্ত ওজনটুকু কমিয়ে না ফেললে বিপদ বাড়ে।
বাড়তি ওজন, অসুখ ও বিপদ
ওজন বৃদ্ধির একটি সূচক আছে, যাকে বলে বডি মাস ইনডেক্স বা বিএমআই। ওজন কেজি-তে মেপে তাকে মিটারে মাপা উচ্চতার বর্গ দিয়ে ভাগ করলেই পাওয়া যায় বিএমআই। বিজ্ঞানীরা হিসেব-নিকেশ করে দেখেছেন, বিএমআই ১৮.৫-২৫-এর মধ্যে আসা মানে ওজন আছে নিক্তির মাপে। ২৫-৩০-এর মধ্যে এলে মানুষটি সামান্য মোটা। কিন্তু এটুকুতে সচরাচর কোনও ক্ষতি হয় না। বিএমআই ৩০-৩৫ মানে মোটা। এতেও এমনিতে খুব একটা সমস্যা নেই। কিন্তু ওবেসিটির সঙ্গে সম্পর্কিত অসুখ-বিসুখ, যেমন ডায়াবিটিস বা ডায়াবিটিসের আগের পর্যায়, হাই প্রেশার-কোলেস্টেরল, হৃদরোগ, ধূমপানের অভ্যাস, ফুসফুসের কোনও অসুখ ইত্যাদি থাকলে সাবধান হওয়া দরকার।
বিএমআই ৩৫-৪০ মানে খুব মোটা বা ২ ডিগ্রি ওবেস। এর সঙ্গে কোনও রোগ থাক বা না থাক, ওজন না কমালে চলবে না। আর ৪০-এর উপর উঠে গেলে তো কথাই নেই। তাকে বলে মরবিড ওবেসিটি। অর্থাৎ এই ওজনই মানুষটির মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
কেন এমন
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিএমআই ৩০-৩৫ হওয়ার সঙ্গে যদি মেটাবলিক সিনড্রোম থাকে, যা ডায়াবিটিসের আগের পর্যায়, কি ডায়াবিটিস,হাই প্রেশার-কোলেস্টেরলের মধ্যে এক বা একাধিক রোগ থাকে, শরীরে প্রদাহের প্রবণতা বেড়ে যায় খুব, দুর্বল হয় রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা। বাড়ে সংক্রমণের আশঙ্কা ও জটিলতা।
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, যাঁদের ওজন খুব বেশি থাকে, বিএমআই প্রায় ৪০-এর কাছাকাছি বা বেশি, তাঁদের বেশির ভাগেরই মেটাবলিক সিনড্রোম থাকে বলে কোভিড হওয়ার আশঙ্কা যেমন বেশি, বেশি জটিলতার আশঙ্কাও। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, "ওজন খুব বেশি হলে ফুসফুসে উপরেও চাপ পড়ে। আর কোভিডে যেহেতু ফুসফুসই আক্রান্ত হয় বেশি, রোগের জটিলতা বেড়ে যেতে পারে আচমকা।"
আরও পড়ুন: বুক ধড়ফড়? পা, গোড়ালি ফুলে যাচ্ছে? হার্টের ছন্দে গোলমাল নয় তো?
তবে আশার কথা এই যে, সঠিক পদ্ধতিতে ডায়েট ও ব্যায়াম করে অতিরিক্ত ওজনের ৫ শতাংশও যদি কমিয়ে ফেলা যায়, প্রেশার-সুগার-কোলেস্টেরল সবই কমতে শুরু করে।
বাজারের তেল-মশলাদার খাবার ও ভাজাভুজি ছেড়ে দিলে ওবেসিটির সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ফাইল ছবি।
সমাধান
“ওজন কমার ৭০ শতাংশ চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে সঠিক ডায়েটের মাঝেই। কাজেই কেউ যদি সিম্পল কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার, যেমন, চিনি, মিষ্টি, ময়দা, ফলের রস, নরম পানীয় ইত্যাদি খাওয়া কমিয়ে বা বন্ধ করে কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার, যেমন লাল চালের ভাত, আটার রুটি, পর্যাপ্ত শাক-সবজি, ডাল, ছোলা, রাজমা, পরিমিত মাছ-ডিম-মাংস-ফল-দুধ খেতে শুরু করেন, বাজারের তেল-মশলাদার খাবার ও ভাজাভুজি ছেড়ে দিতে পারেন, কম সময়ের মধ্যেই ওজন কমে যায়।” জানালেন পুষ্টিবিদ প্রিয়ঙ্কা মিশ্র।
আরও পড়ুন: শরীর অচল থেকে পক্ষাঘাত, করোনার দোসর কি এ বার গুলেনবারি সিনড্রোম? কী বলছেন চিকিৎসকেরা
“ওজন কমাতে ডায়েটিংয়ের পাশাপাশি ব্যায়াম করতে হবে। একেবারে যাঁরা শুয়ে-বসে থাকেন তাঁরা শুরুতে হালকা হাঁটাহাঁটি ও ঘরের কাজ দিয়ে শুরু করে, আস্তে আস্তে বিশেষজ্ঞের পরামর্শমতো ব্রিস্ক ওয়াকিং ও স্ট্রেচিং করবেন। পরের ধাপে আরেকটু ভারী ব্যায়াম করতে হবে। তবে সবটাই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মতো। বিশেষ করে যদি বয়স বেশি হয়, হাই প্রেশার-সুগার, হৃদরোগ বা হাঁটু-কোমরে ব্যথা থাকে। কম বয়সে ও কোনও অসুখ-বিসুখ না থাকলেও ভারী ব্যায়াম করার আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।” জানালেন ফিটনেস বিশেষজ্ঞ চিন্ময় রায়।
শেষ কথা
একটু চেষ্টা-চরিত্র করে এই করোনাকালেই যদি ওজন কমিয়ে ফেলতে পারেন, অন্য আরও অনেক সমস্যার পাশাপাশি প্রদাহের প্রবণতাও কমবে শরীরের। তার হাত ধরে কমবে কোভিডের আশঙ্কা ও জটিলতা।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)