প্রতীকী ছবি। ছবি: সংগৃহীত
সন্ধ্যা ৭:৩০টা, লেক গার্ডেন্সের মোড়। পরপর ২-৩টে ক্যাফে। ভিতরে এত ভিড় যে রাস্তার উপরে বাড়তি চেয়ার পেতে বসার ব্যবস্থা। সব চেয়ার-টেবিলই প্রায় গায়ে গায়ে। সামাজিক দূরত্বের কোনও বালাই নেই। তবে তা নিয়ে কারুর কোনও মাথাব্যথাও নেই। প্রচুর তরুণ-তরুণী বসে কফি-স্যান্ডউইচ খাচ্ছেন। গল্প করছেন। খেতে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই কারুর মুখে মাস্ক নেই। তাঁদের প্রাণোচ্ছল হাসি-ঠাট্টা দেখে বোঝার উপায় নেই যে দেশজুড়ে করোনার তৃতীয় ঢেউ নিয়ে আতঙ্কিত চিকিৎসা-মহল।
অগস্টের শেষে নাকি করোনার তৃতীয় ঢেউ আসছে। সরকার সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইদানীং করোনা সংক্রমণ খানিক কমলেও চিকিৎসকেরা বারবার সতর্ক করে দিচ্ছেন, যেন সারাক্ষণ কোভিডবিধি মেনে চলা হয়। না হলে তৃতীয় ঢেউ আটকানোর কোনও রকম উপায় নেই। তারই মাঝে ডেল্টা, ডেল্টা প্লাস, কাপ্পা, ল্যাম্বডা— যে যখন পারছে ভয় দেখাচ্ছে। অথচ লক়ডাউন পরিস্থিতি অনেকটা শিথিল হওয়ায় মুক্তির স্বাদ পেয়েছে আমবাঙালি। তারা যত পারে এই সময়টা ঘোরাঘুরি করে নিচ্ছেন।
ফুলবাগানের বাসিন্দা জয়ন্ত মণ্ডল। স্ত্রী এবং পাঁচ বছরের কন্যাকে নিয়ে সামনের সপ্তাহে বেড়াতে যাচ্ছেন উত্তরবঙ্গের দুয়ার্সে। টিকিট কাটার পর তিনি বেশ উচ্ছ্বসিত। ‘‘যাওয়ার আগে আমাদের কোভিড-পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। তবে সফরের জন্য পরীক্ষা করালে এখন সব ল্যাবই বেশ তাড়াতাড়ি রিপোর্ট দিয়ে দেয়। তাই সেই নিয়ে খুব একটা চিন্তা নেই,’’ বললেন জয়ন্ত। আর করোনা নিয়ে চিন্তা? ‘‘ধুর! জঙ্গলে আবার করোনা কীসের,’’ উত্তর এল এক নিমেষে।
এখন বেশির ভাগ জায়গায় বেড়াতে গেলে কোভিড-রিপোর্ট দেখানো আবশ্যিক। কিন্তু অরণ্য-প্রাচীদের অন্য অভিজ্ঞতা। এক দল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রছাত্রী লকডাউনের মাঝেই ঝাড়খণ্ড ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। করোনা-পরিস্থিতি একটু নিয়ন্ত্রণে আসতেই তাঁরা বেরিয়ে পড়ে। সফর শুরুর সময় কোনও রকম নিয়ম ছিল না। আচমকাই নিয়ম হয় পর্যটকদের কোভিড-রিপোর্ট প্রয়োজন। কিন্তু তাতে দমে যাননি দলের কেউ-ই। ‘‘এতদিন পর বেড়াতে গিয়ে ফিরে আসা যায় নাকি! ঝাড়খণ্ড ঢোকার মুখে আমাদের গাড়ি পুলিশ আটকে ছিল। ২০০ টাকা দিতে সব ম্যানেজ হয়ে গিয়েছে,’’ হাসতে হাসতে বললেন অরণ্য। ৬-৭ জন বন্ধুবান্ধব মিলে তাঁরা দিব্যি ঘুরে চলেও এসেছেন। তাঁদের সকলেরই মত, করোনার ঢেউ আসতেই থাকবে। কিন্তু তা বলে কি বেড়ানো বন্ধ হবে!
প্রতীকী ছবি।
ঘরবন্দি থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিল বাঙালি। এবং তারা ভালই বুঝেছে, কিছু দিন পর ফের এক রকম পরিস্থিতি হয়ে যেতে পারে। তাই এই সময়টা চুটিয়ে উপভোগ করে নিচ্ছেন অনেকেই। কেউ বেড়াতে যাচ্ছেন, কেউ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা জমাচ্ছেন ক্যাফে-রেস্তরাঁয়। কেউ আবার অবিরাম বিয়ের বাজার করে যাচ্ছেন। অভিরূপ-নীলাঞ্জনার বিয়ে হওয়ার কথা এই নভেম্বরেই। বাবা-মায়েদের সঙ্গে তাঁরা প্রত্যেকদিন এখন বিয়ের বাজার করছেন। দিনের শেষে রেস্তরাঁয় খাচ্ছেন। অভিরূপের বাবার বয়স ৭২, নীলাঞ্জনার মায়ের ৬৮। বাবা-মায়ের জন্য ভয় করে না? ‘‘আমাদের দু’জনের বাবা-মায়েরই টিকাকরণ হয়ে গিয়েছে। তা হলে ভয় কীসের? বিয়ে তো একবারই করব জীবনে,’’ নীলাঞ্জনার জবাব।
এখনও পর্যন্ত কলকাতা শহরে অনেকেই কোভিড-টিকা নিয়ে ফেলেছেন। আবার অনেকেই নেননি। শিশুদের টিকাকরণ এখনও দেশে কোথাও শুরু হয়নি। তাই চিকিৎসকদের একাংশ চিন্তিত তৃতীয় ঢেউ নিয়ে। শিশুরা কতটা সুরক্ষিত, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। কিন্তু যাঁদের সন্তান, তাঁদের চিন্তা কতটা? যে দিন থেকে শপিং মল খোলার অনুমতি দেয় রাজ্য সরকার সে দিনই ১১ বছরের ছেলেকে নিয়ে সল্টলেকের এক মলে হাজির হন সুদীপ্ত এবং রাজরূপা। নিজেদের একটি করে টিকা নেওয়া হয়ে গেলেও ছেলের এখন সে উপায় নেই। তাকে নিয়ে কোনও ভয় নেই? ‘‘কত দিন বাড়ির ভিতর থাকা যায়? তৃতীয় ঢেউ এলে তো আবার ঘরবন্দি হয়েই থাকতে হবে। তাই এখন আমরা একটু কেক-প্যাস্ট্রি খেতে বেরোলাম। মন ভাল রাখাও তো জরুরি,’’ রাজরূপার মত।
মন ভাল রাখতে গিয়ে তৃতীয় ঢেউ কি সময়ের আগেই ডেকে আনছে বাঙালি? সে প্রশ্নের জবাব সময়ই দিতে পারবে।