প্রতীকী ছবি।
গবেষণা চলছিলই। চলছিল একের পর এক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। অর্থাৎ টেস্ট টিউব, পেট্রি ডিশের পর্ব চুকিয়ে আক্রান্ত মানুষের শরীরে প্রয়োগ করে ওষুধের ভাল-মন্দ খতিয়ে দেখছিলেন বিজ্ঞানীরা। উঠে আসছিল বেশ কিছু পরিচিত ওষুধের নাম। ম্যালেরিয়ার ওষুধ, এইচআইভি ও ইবোলা ভাইরাস মারার ওষুধ, কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশেষে স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখে পাওয়া গেল সুখবর, হাইড্রোক্সি ক্লোরোকুইন ও অ্যাজিথ্রোমাইসিনের যুগলবন্দিই নাকি সেই ম্যাজিক ওষুধ, যে করবে মুসকিল আসান। এবং এই অসাধ্য সাধনের জন্যআমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা এফডিএ-কে বিস্তর সাধুবাদ দিলেন তিনি।
হাঁপ ছেড়ে বাঁচা গেল! এত হাত ধোয়া-ধুয়ি ও গৃহবন্দিত্বের পর্ব বুঝি চুকল এবার। ম্যালেরিয়া ঠেকাতে আমরা যেমন কথায় কথায় ক্লোরোকুইন খেয়ে নিই, জঙ্গলে বেড়াতে গেলে বিশেষ করে,এ বার না হয় কোভিড-কে ঠেকাতে খেতে শুরু করব!
ঠিক এই সময়ই সামনে এল এফডিএ-র সতর্কবাণী না, এত দ্রুত কিছু করা যাবে না। ক্লোরোকুইন-অ্যাজিথ্রোমাইসিন কোনও ম্যাজিক ওষুধ নয়। সব ধরনের কোভিড-১৯ রোগীর ক্ষেত্রে তারা কাজ করবে, এমন কথা বলা যায় না। কাজেই এখনও পর্যন্ত যা জানা গিয়েছে তাতে রুটিন মাফিক এই ওষুধ দেওয়া যাবে না।
কী তাহলে দাঁড়াল ব্যাপারটা? ওষুধ বাজারে এল কি এল না? আসুন দেখে নিই, ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ সৌতিক পণ্ডা কী বলছেন।
চিকিৎসক পণ্ডা জানিয়েছেন, "ক্লোরোকুইনের মতো ম্যালেরিয়ার ওষুধের ভাইরাস মারারও ক্ষমতা রয়েছে, আমরা বহুদিন ধরেই জানি সে কথা। চিনে যখন আচমকা মহামারী লেগে গেল, তখন এই ওষুধ দেওয়া হয়েছে। কিছু উপকারও হয়েছে তাতে। তবে এখনও পর্যন্ত চিকিৎসার যে সমস্ত গাইডলাইন আমরা মেনে চলি, যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন, ইউরোপ ও নর্থ আমেরিকার যুগ্মভাবে তৈরি করা সারভাইভিং সেপসিস ক্যাম্পেন গাইডলাইন, তাদের কোথাও এর রুটিন ব্যবহারের কথা বলা নেই। আর সব থেকে বড় কথা, অন্যান্য অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ, লোপিনাভির ও রেটোনাভির কম্বিনেশনের সঙ্গে ক্লোরোকুইন দিলে বরং নানা রকম ক্ষতি হতে পারে।
এবার বলি অ্যাজিথ্রোমাইসিনের কথা। দু'টি কারণে এই ওষুধ আমরা মোটামুটি নিয়মিত দিই। প্রথমত, ভাইরাসের সঙ্গে অনেক সময় ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ থাকে। কখনও আবার আশঙ্কা থাকে সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের। সে সব ঠেকাতে এই ওষুধ দিতে হয়। দিতে হয় প্রদাহ কমানোর জন্যও।"
আরও পড়ুন: করোনা মোকাবিলার উপায় আগামী ১৫ দিন বাড়িতে থাকা
তা হলে, অ্যান্টিভাইরাল ওষুধের কোনও ভূমিকা নেই?
"ভূমিকা অবশ্যই আছে। তবে ওষুধ নেই এখনও পর্যন্ত।" জানিয়েছেন সৌতিক পান্ডা। "তবে নিউমোনিয়া নিয়ে রোগী ভর্তি হলে অ্যান্টিবায়োটিকের পাশাপাপাশি অসেলটামিভির নামে একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধও দিয়ে থাকি আমরা। তবে তা সাময়িক। সোয়াব টেস্টের রিপোর্টে করোনা প্রমাণিত হলে আবার তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ এটি সোয়াইন ফ্লু-র ওষুধ। করোনা ভাইরাস মারতে এর কোনও ভূমিকা নেই।"
সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা কি একেবারেই উপসর্গ ভিত্তিক?
"একদমই তাই ।" জানিয়েছেন সৌতিকবাবু। হালকা উপসর্গ, যেমন, জ্বর, শুকনো কাশি, গলা ব্যথা, ক্লান্তি, মাথা ব্যথা ইত্যাদি থাকলে চিকিৎসা বলত—
একলা ঘরে শুয়ে-বসে বিশ্রাম নেওয়া।
ঘরে বানানো হালকা খাবার খাওয়া।
জ্বর ও ব্যথা কমাতে প্যারাসিটামল, প্রয়োজন মতো দিনে ৩-৪ বার।
প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া।
হালকা গরম জল খাওয়া বারে বারে। দিনে ৩-৪ লিটার জল খেতে হবে।
প্রয়োজনে নুন-গরম জলে গার্গল করা।
উপসর্গের গতি-প্রকৃতির দিকে নজর রাখা। কষ্ট বাড়লে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া।
আরও পড়ুন: মাল্টিভিটামিন খেলেই কি করোনা-সংক্রমণ এড়ানো যাবে?
হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর রোগীর অবস্থা অনুযায়ী—
প্রয়োজন মতো অক্সিজেন দেওয়া হয়।
স্যালাইন চালানো হয় বুঝে-শুনে। বেশি দিয়ে ফেললে অনেক সময় ফুসফুসে জল জমে গিয়ে অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যেতে পারে।
অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়।
রোগীর খুব শ্বাসকষ্ট হলে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের প্রয়োজন হয়।
রোগীর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেলে, অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম হলে বা রোগী সেপটিক শকে চলে গেলে খুব হিসেব-নিকেশ করে স্টেরয়েড দিতে হতে পারে। নেহাত বাধ্য না হলে কিন্তু এই ওষুধ দেওয়া হয় না। দিলেও ৭২ ঘণ্টায় রোগীর অবস্থার কতটা উন্নতি হচ্ছে, তা দেখে আরও দিন দুয়েক চালানো যেতে পারে।