টেস্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে আরও, নিদান চিকিৎসকদের। ছবি: পিটিআই
করোনা নিয়ে আতঙ্কের মধ্যেই গ্রাস করছে অনিশ্চয়তাও। এরই মধ্যে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ একটি সেরোপ্রিভ্যালেন্স স্টাডি করেছিল বেসরকারি বেশ কয়েকটি গবেষণাগারের মাধ্যমে।সেখানে দেখা গিয়েছে, প্রায় এক কোটি ভারতীয় আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়।
এই সংখ্যাটা শুনে খারাপ লাগলেও এর একটা অন্যতম ইতিবাচক দিক রয়েছে।সেটি হল এঁদের মধ্যে বেশিরভাগেরই মৃদু বা অতি সামান্য উপসর্গ ছিল। এঁদের মধ্যে বেশিরভাগই সুস্থ হয়ে ফিরে গিয়েছেন। আইসিএমআর ওই স্টাডির ক্ষেত্রে জানিয়েছিল, প্রতি হাজার জনে এ ক্ষেত্রে মাত্র এক জনের মৃত্যু হয়েছে। শতাংশের ভিত্তিতে দেখলে ০.১ শতাংশ বা তার চেয়েও কম। যদিও স্টাডিটির মধ্যে নথিভুক্ত করা হয়নি বা গণনায় ধরা হয়নি এমন কেস ছিল না। তবুও এটা একটা আশাব্যঞ্জক দিক। লকডাউন, হার্ড ইমিউনিটি, বাইরে বেরোন, করোনা পরবর্তীতে প্রতিবেশীর হাতে হেনস্থা— প্রতিটি বিষয়ে মানুষ সংশয়ে রয়েছে। এই লড়াইয়ে তবুও টিকে থাকতে হবেই। মহামারির বিরুদ্ধে এই কঠিন সময়কে কীভাবে পেরিয়ে যাবে মানুষ?
এই লকডাউনের কি কোনও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে?
লকডাউন করলে সংক্রমণটা খানিকটা আয়ত্তের মধ্যে থাকবে বলে বিশ্বাস করা হয়। কিন্তু লকডাউন প্রকৃত অর্থে কার্যকর হওয়া প্রয়োজন। সংক্রামক ব্যাধি চিকিৎসক অমিতাভ নন্দী বলেন, লকডাউনের মধ্যেও মিষ্টির দোকান খুলে দেওয়া হয়েছিল। গোড়া থেকেই সামাজিক ইভেন্ট হিসেবে লকডাউন করা উচিত ছিল। কারণ, মানুষ আইন ভেঙেছে। এমনকি, প্রশাসনিক স্তরের সিদ্ধান্তে নানা ক্ষেত্র ছাড় পেয়েছিল লকডাউনের থেকে। সেটা ঠিক হয়নি। লকডাউন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে করা যাবে না, ভাবতে হবে মানুষের কথা। প্রথমদিকের লকডাউনে বিজ্ঞানের দিকটি কম গুরুত্ব পেয়েছিল। ওই ‘সোকলড লকডাউন’–এর কারণেই সংখ্যাটা বেড়েছে। প্রতিটি মানুষ এক। তাই লকডাউনের সিদ্ধান্তটাও তেমনভাবেই নেওয়া উচিত ছিল।
ভ্যাকসিনের আগেও 'হার্ড ইমিউনিটি' তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ছবি: পিটিআই
আরও পড়ুন: জ্বর না হয়েও করোনা আক্রান্ত অনেকেই, এ সব বিষয়ে সতর্ক হতে বলছেন চিকিৎসকরা
অ্যান্টিবডি কি তৈরি হচ্ছে?
অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের অজান্তেই। একটা সময় আসবে, যখন অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যাবে। ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি হবে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি রোগের ক্ষেত্রে ঝুঁকি থেকেই যায়, এমনটাই বললেন জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী। রাজ্যবাসীর যে প্রবণতা রয়েছে, সেটা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফে পাকিস্তানকে বলা হয়েছিল, ১৫ দিন লকডাউন, ১৫ দিন খোলা— এভাবে ইন্টারমিটেন্ট প্রক্রিয়া বজায় রাখতে। কারণ ভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪ দিন, অর্থাৎ তার দ্বিগুণ সময় ২৮ দিন লকডাউন করা জরুরি। কিন্তু তার নানা দিক রয়েছে।
লকডাউন সম্পূর্ণ তুলে দিলে সংক্রমণ বাড়বেই। ছবি: পিটিআই
দেশে, বিশেষ করে রাজ্যে টেস্টের সংখ্যা কি বাড়াতে হবে?
লকডাউনের মূল উদ্দেশ্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে মজবুত করা। সেটা এখানে পুরোপুরি হচ্ছে না বলেও উল্লেখ করেন সুবর্ণবাবু। তাঁর কথায়, আরও বেশি টেস্ট করা জরুরি। প্রতি ১০ লক্ষে দেশে টেস্টের সংখ্যা ১২ হাজারের একটু বেশি। ব্রাজিলে তা ৬০ হাজার, আমেরিকায় এক লাখ দশ হাজার। রাজ্য ধরলে টেস্টের পরিমাণ তো আরও কম। তাই সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে যা পজিটিভ কেস দেখা যাচ্ছে, তা আসলে হিমশৈলের চূড়ার মতো। গোষ্ঠীতে অনেকেরই হয়েছে, কিন্তু টেস্ট না হওয়ার কারণে তিনি জানেন না। তাই সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
অল্প বয়সি কারও মৃত্যুতে আতঙ্ক নয়
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজির বিজ্ঞানী, ইমিউনোলজিস্ট দীপ্যমান গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, করোনায় কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যু ঘটলেও সুস্থতার হার অনেক বেশি। ‘হার্ড ইমিউনিটি’-র কথা মাথায় রেখে তাই লকডাউনের সিদ্ধান্তও নিতে হবে ভারসাম্য অনুযায়ী। লকডাউন পুরোপুরি তুলে দিলে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হতে পারে, এটা যেমন ঠিক, তেমনই অনেক মানুষের মধ্যেই আস্তে আস্তে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি হয়ে যাবে। আবার লকডাউন সম্পূর্ণরূপে বলবৎ থাকলে আক্রান্তের সংখ্যা কমলেও অন্যদিকে আর্থিক ক্ষতি হবে। দিনমজুর-সহ আরও অনেকেই অসুবিধায় পড়বেন। অনাহারে মৃত্যু হবে মানুষের। লকডাউন নিয়ে সম্প্রতি যে সিদ্ধান্ত সরকারের তরফে নেওয়া হয়েছে, এতে খানিকটা হলেও আক্রান্ত কমবে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর চাপ কমবে। তাই পুরোপুরি ভারসাম্য বজায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ইমিউনিটি নিয়ে নানারকম ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে, সে বিষয়েও সতর্ক হতে বলেন দীপ্যমানবাবু।
অ্যান্টিবডির অনুপস্থিতি মানে সুরক্ষা নেই, এমনটা একেবারেই নয়। কারণ প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয় অ্যান্টিবডি এবং টি সেল এবং উভয়েই। তবে ভ্যাকসিন তৈরির আগেই হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হবে, এমনটাই আশ্বাস দিয়েছেন দীপ্যমানবাবু।
অল্প বয়সের কোনও ব্যক্তির করোনায় মৃত্যু হয়েছে মানেই বাকিদের সঙ্গে তা হবে এমনটা কখনওই নয়। কারও ক্ষেত্রে হয়তো কো-মর্বিডিটি ছিল। কারও ক্ষেত্রে চিকিৎসা শুরু হয়নি। তাই আতঙ্কিত হওয়ার বদলে সতর্ক থাকতেই বলেন এই ইমিউনোলজিস্ট।
যদিও আইআইএসইআর, মোহালির ভাইরোলজিস্ট ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত, হার্ড ইমিউনিটি সবার ক্ষেত্রে তৈরি না-ও হতে পারে। প্রতিটি ভাইরাসের চরিত্র আলাদা। কো-মর্বিডিটি থাকার কারণে রোগ প্রতিরোধের বদলে সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়তে পারে। 'হার্ড ইমিউনিটি'-র ভাবনা তখনই আসে, যখন গোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষই সুস্থ। মৃত্যুর হারও বাড়ছে কো-মর্বিড ফ্যাক্টরের কারণেই। বয়স্ক মানুষ এবং অসুস্থ বাচ্চাদেরও মৃত্যু হয়েছে। তাই জনগোষ্ঠীর কথা ভেবেই সার্বিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আরও পড়ুন: শুধু বিষম লেগেই বছরে মৃত্যু লক্ষাধিক মানুষের, কাদের ঝুঁকি বেশি
সাধারণ মানুষ কী করবেন?
প্রতিদিন বারুইপুরের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ভ্যান চালিয়ে যাদবপুর, বাঘাযতীন-সহ কয়েকটি এলাকায় সব্জি বিক্রি করছেন বিজু দাভে। লকডাউনের তারিখ নিয়ে সংশয় রয়েছে তাঁর। কবে বিক্রি করলে সমস্যায় পড়তে হবে, কবে নয়, বুঝতে পারছেন না তিনি। সব্জি বিক্রি না করলে খেতে পাবেন না বিজু, এদিকে রোগের ভয়ও রয়েছে। বিজ্ঞাপন সংস্থার শুটিংয়ের জন্য বেরতে হচ্ছে মৈনাককে। অনুমতিসাপেক্ষে শুটিং শুরু করলেও আতঙ্কটা রয়েছে। সবাই যে শুটিংয়ের কাজে সাহায্য করছেন এমনটাও নয়। ফ্রি ল্যান্স কাজ করেন মৈনাক। কলকাতা শহরে বাড়ি ভাড়া দিতে হয় থাকার জন্য। তাই কাজ করতে হবে তাঁকেও, কিন্তু প্রতি মুহূর্তে একটা আতঙ্ক, মানসিক অবসাদ কাজ করছে।
কেন এমন হচ্ছে? কোন ধরনের মানসিক সমস্যা গ্রাস করছে?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেবাশিস রায়ের মত, কোভিড নিয়ে অনেক সংশয় রয়েছে। প্রামাণ্য চিকিৎসাও খুব একটা শুরু হয়েছে তা নয়। প্রথমদিকে লকডাউনে অপরিচিত পরিবেশ থাকলেও আস্তে আস্তে মানুষ তা মানিয়ে নিতে শুরু করেছে ওই যাপনে। দীর্ঘকালীন সময় হলে অনেকেই ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেন। কেউ কেউ পারছেন না অভ্যস্ত হতে।তাই অবসাদ, ধূমপান, অতিরিক্ত মদ্যপান বেড়েছে যা এই সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক। এ দিকে অর্থনৈতিক টানাপড়েনের কারণেও অবসাদ গ্রাস করছে। তাই সহানুভূতি, পাশে থাকা, এগুলি এখন সব থেকে জরুরি।
জনগোষ্ঠীকে গুরুত্ব দিয়েই যে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ছবি:পিটিআই
বর্তমানে যে লকডাউন চলছে, তা নিয়ে মানুষ তুলনামূলক কম বিচলিত, কারণ পরিকল্পনার সময় থাকছে, মানুষ অনেকটা ধাতস্থও হচ্ছে। কিন্তু রোগটির বিষয়ে যে দীর্ঘায়িত আতঙ্ক, তা মানুষকে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন করছে। রোগ হয়ে সেরে গেলেও আনুষঙ্গিক হেনস্থাগুলি রয়েছে, এমনটাই জানালেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাড়া-প্রতিবেশীরা কী আচরণ করবেন বা একই আবাসনে হলে সেই আবাসনে কি থাকতে দেবে, এই ভাবনাগুলি আসছে। স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর সুবিধা কি মিলবে, আদৌ কতটা মিলবে, এই নিয়েও মানুষ চিন্তিত, এগুলি অনেক বেশি ভয়াবহতা তৈরি করেছে, জানান অনুত্তমা। মানুষ ধাতস্থ হচ্ছে ঠিকই কিন্তু অসুখ পরবর্তী বিপন্নতা সম্পর্কে সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। নিশ্চয়তার ছবিও মিলছে না।
মহামারির সময়ে পরস্পরের পাশে থাকাটা আরও অনেক বেশি জরুরি বলেই মনে করেন দেবাশিসবাবু। চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভারসাম্য বজায় রেখেই রাজ্যকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে লকডাউনের। ভ্যাকসিন, গোষ্ঠীবদ্ধ রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বা হার্ড ইমিউনিটি— প্রতিটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে সচল রাখার চেষ্টা করতে হবে অর্থনীতিকেও। ‘ট্রেস, টেস্ট, আইসোলেট’ নীতি নিতে হবে। মানবিকতার সঙ্গে প্রতিটি বিষয়কে দেখতে হবে। সংক্রামক ব্যাধি চিকিৎসক অমিতাভ নন্দী বললেন, ''স্বাস্থ্য পরিকাঠামো প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে যাতে সমানভাবে বণ্টন হয়, সেটাই দেখতে হবে। কারণ মানুষের অধিকারের মধ্যে পড়ে এটি। যে কোনও মহামারির ক্ষেত্রেই চিকিৎসা পরিষেবায় সমতা থাকা জরুরি।''
আরও পড়ুন: বাঁচবে সময়, খেতেও দারুণ, করোনা আবহে বাড়ির খাবার হোক এ রকম
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।)
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)