অ্যান্টিবডি পরীক্ষা কোভিড সংক্রমণের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। ছবি: শাটারস্টক।
তিন ধরনের মানুষ সাধারণত কোভিডের পরীক্ষা করাতে আসেন, (১) যাঁরা কোভিড রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন। (২) এমন জায়গা থেকে এসেছেন, যেখানে রোগ খুব বেশি হচ্ছে। (৩) যাঁদের নির্দিষ্ট কিছু উপসর্গ দেখা দিয়েছে, যেমন, জ্বর, গলা ব্যথা, শুকনো কাশি, ক্লান্তি, গা-হাত-পা-মাথাব্যথা, গা-ম্যাজম্যাজ, বুকে চাপ বা শ্বাসকষ্ট, ডায়ারিয়া, গা-বমি বা স্বাদ-গন্ধ না পাওয়া ইত্যাদি।
প্রথম দু-ক্ষেত্রে কোভিড সংক্রমণ হয়েছে কিনা জানতে আরটিপিসিআর নামের পরীক্ষা করা হয়। তৃতীয় ক্ষেত্রে উপসর্গের উপর নির্ভর করে চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেন যে প্রথমেই আরটিপিসিআর হবে না ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, টাইফয়েড, মূত্রে সংক্রমণ ইত্যাদি আছে কিনা তা দেখে নেওয়া হবে। সাধারণ ফ্লু হল কিনা খতিয়ে দেখা হবে তাও।
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দীর মতে, "যতই এখন কোভিডের বাড়াবাড়ি হোক না কেন, এই সমস্ত রোগের প্রকোপও কম কিছু নয়। তবে রোগী যদি কোভিড অধ্যুষিত এলাকা থেকে এসে থাকেন, সঙ্গে আরটিপিসিআর-ও করা হবে। সব নেগেটিভ এলে রোগীকে নজরদারিতে রেখে আবার ৫-৭ দিন পর আরটিপিসিআর করতে হতে পারে। তখনও নেগেটিভ এলে ও উপসর্গ দেখে যদি সন্দেহ হয়, সপ্তাহ তিনেক বাদে করা হবে টিবি-র পরীক্ষা।"
টেস্টের মাধ্যমেই বোঝা সম্ভব রোগী করোনা আক্রান্ত কি না। ফাইল ছবি।
আরও পড়ুন: প্রায় উপসর্গহীন বা সামান্য উপসর্গের করোনা আক্রান্তরা কী করবেন?
কোভিড সংক্রান্ত দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হল অ্যান্টিবডি টেস্ট । এটি আরটিপিসিআর-এর মতো করোনাভাইরাসকে হাতেনাতে ধরার পরীক্ষা নয়। জীবাণু ঢুকলে শরীরে যে সমস্ত প্রতিক্রিয়া হয় তা ধরা পড়ে এই পদ্ধতিতে। সাধারণ মানুষের মধ্যে সংক্রমণ কতটা বিস্তার পেয়েছে তা জানার পদ্ধতি এটি। এর রিপোর্ট পজিটিভ এলে আবার আরটিপিসিআর করে নিশ্চিত হতে হয় যে, কোভিড হয়েছে। বিভিন্ন কনটেনমেন্ট এলাকাতে এখন এই টেস্ট করা হচ্ছে। পুরসভা থেকে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের দল গিয়ে মোটামুটি উপসর্গহীন মানুষদের রক্তপরীক্ষা করে দেখছেন, তাঁদের কখনও সংক্রমণ হয়েছিল কিনা। বা তাঁরা তলে তলে ভুগছেন কিনা, যা থেকে অন্যদের মধ্যে রোগ ছড়াতে পারে। মহামারি নিয়ন্ত্রণে এ এক বড় পদক্ষেপ। গোষ্ঠী সংক্রমণ হয়েছে কিনা তা দেখারও মাধ্যম এই পরীক্ষা।
তৃতীয় পরীক্ষাটি হল র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট। অ্যান্টিজেন কথার অর্থ হল জীবাণু। এই পদ্ধতিতেও সরাসরি জীবাণুকে চিনে ফেলা যায়। এর কিছু সুবিধে ও কিছু অসুবিধে আছে। ১৫ই জুন আইসিএমআর পরীক্ষামূলকভাবে এই পরীক্ষা করার অনুমতি দিয়েছে।
এবার আসুন, দেখে নেওয়া যাক কোন পরীক্ষা কীভাবে হয়, তাদের ভাল-মন্দই বা কী।
আরটিপিসিআর কী এবং কেন
পুরো নাম রিয়েল টাইম রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমারেজ চেন রিয়্যাকশন। এই পদ্ধতিতে নাকের বা গলার গভীর থেকে কোষ নিয়ে পরীক্ষা করলে ভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা যায়। পরীক্ষা সম্পূর্ণ হতে কয়েক ঘণ্টা লাগে। এখনও পর্যন্ত কোভিডের কনফার্মেটরি টেস্ট এটাই।
অমিতাভ নন্দী জানিয়েছেন, "আরটিপিসিআর সরাসরি ভাইরাসকে চিহ্ণিত করে। কাজেই সে যদি বলে ভাইরাস আছে, তো আছে। কিন্তু নেই বললেই যে নেই, এমন সব সময় নয়। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের যদি সন্দেহ থাকে ৫-৭ দিনের মাথায় আবার পরীক্ষা করা হয়।"
সংক্রমণের এক সপ্তাহের মধ্যে করলে লালারসে জীবাণু বেশি পাওয়া যায়। ছবি: শাটারস্টক
কীভাবে হয় পরীক্ষা
ভাইরাসের আরএনএ-কে রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পদ্ধতিতে ডিএনএ-তে পরিণত করে নিতে হয়। এর পর তাতে বিশেষ এনজাইম ও রিএজেন্ট মিশিয়ে এমন পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যাতে পলিমারেজ চেন রিয়্যাকশন হয়ে ডিএনএ বড় হতে হতে এমন মাপে পৌঁছায় যে তার নির্দিষ্ট প্যাটার্ন দেখে রোগ ধরা যায়।
আরও পড়ুন: বাড়ি বাড়ি পরীক্ষা, সচেতনতা, কড়া লকডাউন, তবেই রাজ্যে নিয়ন্ত্রণে আসবে করোনা
পরীক্ষা কি শুধুই লালারসে
নাকের বা গলার গভীরের কোষ, লালারস বা কফ নিয়ে পরীক্ষা করা যায়। সংক্রমণের এক সপ্তাহের মধ্যে করলে লালারসে জীবাণু বেশি পাওয়া যায়। দ্বিতীয় সপ্তাহ সংক্রমণ ফুসফুসে পৌঁছে গেলে কফে বেশি জীবাণু থাকে।
ট্রু-ন্যাট কী
ট্রু-ন্যাট হল ছোট ব্যাটারি-চালিত যন্ত্র। করোনা সংক্রমণ হয়েছে কিনা তা জানিয়ে দেয় আধঘন্টা থেকে একঘণ্টার মধ্যে। আরটিপিসিআর-এর জন্য যেমন প্রচুর ট্রেনিং দিয়ে টেকনিসিয়ান তৈরি করতে হয়, এ ক্ষেত্রে সে ব্যাপার নেই। নাক ও গলার গভীর থেকে সঠিকভাবে কোষ সংগ্রহ করতে পারলে বাকিটুকু যন্ত্রই করে দেয়। বিরাট কোনও সেটআপ লাগে না। যে সব ল্যাবে ড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট টিবি বা এডস-এর পরীক্ষা হয়, সেখানেই হয়ে যায়।
এতে একেক বারে ৩২-৪৮টা নমুনা পরীক্ষা করা যায়। একই সঙ্গে দেওয়া যায় টিবি, এইচআইভি ও কোভিডের নমুনা। কোভিডের বাড়াবাড়ি শুরু হওয়ার পর তাই গত ১০ই এপ্রিল এই টেস্টের অনুমতি দেয় আইসিএমআর।
এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা করলে চট করে রিপোর্ট জানা যায়। খরচও কম হয়। তবে রিপোর্ট পজিটিভ হলে আরটিপিসিআর করে তা কনফার্ম করতে হয়।
র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট
কোনও ক্ষতিকর বস্তু প্রবেশ করলে, তা সে জীবাণু হোক কি বিষ কি অন্যকিছু, শরীরের প্রতিরোধী ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে তাকে ধবংস করতে। সে সময় যে সমস্ত যোদ্ধা তৈরি হয় রক্তে, তাদেরই বলে অ্যান্টিবডি। এরা হল এক ধরণের প্রোটিন, যার নাম ইমিউনোগ্লোবিউলিন বা আইজি।
সবার প্রথমে যুদ্ধে নামে ইমিউনোগ্লোবিউলিন-এম বা আইজিএম। প্রাথমিকভাবে জীবাণুদের আটকানোর চেষ্টা করে সে। কিন্তু কোনওভাবেই তাদের সঙ্গে এঁটে উঠতে না পারলে কিছুদিন পর কাজে নামে আরও শক্তিশালী কিছু যোদ্ধা, যাদের মধ্যে অন্যতম হল ইমিউনোগ্লোবিউলিন-জি বা আইজিজি। তখন ব্যাকসিটে চলে যায় প্রথম দিকের যোদ্ধা তথা আইজিএম। আইজিজি জিতে গেলে রোগ সারে। এবং এরা দীর্ঘদিন, কখনও জীবনভর থেকে যায় রক্তে। রক্ত পরীক্ষায় এদের পাওয়া গেলে বোঝা যায় জীবাণু শরীরে ঢুকেছিল, তাতে হয় আক্রান্ত সেরে গেছেন, নয়তো এখনও ভুগছেন।
আরও পড়ুন: আসল এন৯৫ চিনবেন কী করে? সংশয় হলে কী করবেন?
টেস্টের ভাল-মন্দ
সহজে ও কম খরচে করা যায়। জানা যায়, ক'জনের মধ্যে রোগ ছড়িয়েছে, গোষ্ঠি সংক্রমণ হয়েছে কিনা, মহামারি ছড়াচ্ছে কি না এবং তার প্রকোপ কমছে কি না। "তবে এটি ইনডাইরেক্ট টেষ্ট। জীবাণু হাতেনাতে ধরার পরীক্ষা নয়। জীবাণু ঢোকার ফলে শরীরে আইজিজি, আইজিএম নামের যে সব যোদ্ধারা তৈরি হয়েছে, তাদের উপস্থিতি প্রমাণ করার পরীক্ষা। ফলে যতক্ষণ না অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে, বিশেষ করে আইজিজি, পরীক্ষা করে লাভ নেই। আবার আগে যদি অন্য ভাইরাস দিয়ে সংক্রামিত হয়ে থাকেন, বিশেষ করে করোনাভাইরাস গোত্রের অন্য কোনও ভাইরাস দিয়ে, সে বাবদ যে আইজিজি রক্তে থেকে গেছে, তার কারণেও রিপোর্ট পজিটিভ আসতে পারে। কাজেই একবার পরীক্ষা করেই কোভিড হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। রিপোর্ট পজিটিভ এলে আরটিপিসিআর করে দেখে নিতে হয় সত্যিই রোগ হয়েছে কিনা", জানালেন অমিতাভ নন্দী।
কীভাবে হয় পরীক্ষা
কার্ডের মাধ্যমে ও এলাইজা পদ্ধতিতে। কার্ডে করলে ব্যাপারটা খুব সহজ, কার্ডের উপর দু-ফোঁটা রক্ত ফেলে দিলেই হাতে হাতে ফল। যে কোনও জায়গায় করা যায়। খরচ কম। অ্যান্টিবডি পজিটিভ না নেগেটিভ, তা-ও বোঝা যায়।
এলাইজা টেস্ট সেই তুলনায় অনেক উন্নত। এই টেস্টে রিপোর্ট পজিটিভ আসা মানে রোগটা কোভিড-ই। রক্তে অ্যান্টিবডির পরিমাণও মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়।
র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট
র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টে নাকের গভীর থেকে কোষ নিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষা করে ফেলা হয়। ছোট সেটআপেই কাজ হয়ে যায়। রিপোর্ট পাওয়া যায় আধ ঘণ্টায়। সে রিপোর্ট পজিটিভ এলে রোগ নিশ্চিত। নেগেটিভ এলে আবার পরীক্ষা করতে হয়, কারণ এই টেস্টে অনেক সময়ই ফলস নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যবহারের জন্য আইসিএমআর গত ১৫ই জুন এই পদ্ধতিতে সিলমোহর লাগিয়েছেন।
র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা হয় নাকের গভীর থেকে কোষ নিয়ে। ছবি: শাটারস্টক
কাদের করা হয়
• হটস্পট এলাকার মানুষ, বিশেষ করে যাঁরা কোভিড রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন।
• অসুখ ও বয়সের কারণে যাঁদের সংক্রমণ হওয়ার বা হলে জটিলতার আশঙ্কা বেশি।
• ফ্লু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ও কোভিড হতে পারে বলে মনে হচ্ছে।
• রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম আছে, এমন মানুষ যদি হাসপাতালে ভর্তি থাকেন।
• ডায়ালিসিস, নাক-কান-গলা-স্নায়ু বা মুখের অপারেশন বা ব্রঙ্কোস্কোপির আগে।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)