উপস্থিতি গোপন করেছে করোনাভাইরাসও। ফাইল ছবি।
ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ায় রক্ষে নেই, করোনা দোসর! অর্থাৎ, ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ায় অনেক ক্ষেত্রে উপসর্গ না থাকায় রোগ ধরা পড়ছে না। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে উপসর্গহীন করোনাও।
তিনটিই আদতে জ্বর। ম্যালেরিয়ার প্রধান উপসর্গ জ্বরের সঙ্গে কাঁপুনি এবং জ্বরের দ্রুত ওঠানামা। ডেঙ্গিতে জ্বর হঠাৎ বেড়ে যায়। সঙ্গে গাঁটে, পেশিতে, চোখের পিছনে ব্যথা আর গায়ে লালচে দাগ। করোনার ক্ষেত্রে জ্বরের সঙ্গী হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট। পরে নিউমোনিয়া। তিনটি জ্বরের মধ্যে একমাত্র ম্যালেরিয়ার নির্দিষ্ট ওষুধ আছে। তার মধ্যে অনেক ওষুধ বহু ব্যবহারে বা অপব্যবহারে আর ম্যালেরিয়ার জীবাণুকে মারতে পারে না। ঠিক যেমন হয়েছে টিবির ওষুধের ক্ষেত্রে।
ডেঙ্গি আর কোভিড-১৯ নিরাময়ে নির্দিষ্ট ওষুধ নেই। এ সব ক্ষেত্রে উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা করতে হয়। কিন্তু রোগীর শরীরে পুঁথিতে লেখা উপসর্গ (ক্লাসিক্যাল সিম্পটম) না থাকলে উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। চিকিৎসক কীসের ভিত্তিতে রক্ত বা লালারসের পরীক্ষা করাতে বলবেন, সেটাই হয়ে দাঁড়ায় সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
আরও পড়ুন: করোনা সারলেও বাড়ছে অন্য রোগের ঝুঁকি, সুস্থ থাকতে কী কী করবেন
উপসর্গহীন কোনও অতিপরিচিত রোগ যে কী কাণ্ড করতে পারে, তা কলকাতাবাসী টের পেয়েছিলেন নয়ের দশকের মাঝামাঝি (১৯৯৫-’৯৬)। কলকাতায় তখন দাপাচ্ছে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া। তখনই হানা দিল এমন এক জ্বর, যা বেশ কিছু মৃত্যু ডেকে আনল। দেখা গেল, রোগীর জ্বর আছে। কিন্তু কাঁপুনি নেই। জ্বর কমছে না কিছুতেই। এক সময় মূত্রের রং কালো হয়ে গেল। মাথায় অসম্ভব ব্যথা। ক্রমেই ঝিমিয়ে পড়ছেন রোগীরা। শহরের তাবড় চিকিৎসকেরা অনেক পরীক্ষা করেও কিছু পাননি। শেষপর্যন্ত এক চিকিৎসক ম্যালেরিয়ার খোঁজার রক্তপরীক্ষা করালেন। সবচেয়ে কম খরচের ওই পরীক্ষায় দেখা গেল, রোগীর শরীরে বাসা বেঁধেছে প্লাজমোডিয়াম ফ্যালসিপেরাম। ম্যালেরিয়ার জীবাণু।
কিন্তু বইয়ে ম্যালেরিয়ার এমন উপসর্গের কথা চিকিৎসকেরা কখনও পড়েননি। দেখা গেল সেটিও এক ধরনের ম্যালেরিয়া। নাম ‘সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া’। কলকাতায় বেশ কয়েকজন আক্রান্তকে পাওয়াও গেল। অনেকের মৃত্যু হয়েছে রোগ ধরা পড়ার আগেই। অনেকের রোগ ধরা পড়েছে একেবারে শেষ সময়ে। তখন ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়ার ওষুধের কোর্স শেষ করানো হয়নি। যেখানে একটু তাড়াতাড়ি রোগ ধরা পড়েছে, সেখানে ধীরে ধীরে রোগী ভাল হয়ে উঠেছেন।
আরও পড়ুন:কোভিড রোগীর নেগেটিভ রিপোর্ট আসা মানেই কিন্তু সুস্থতা নয়
ডেঙ্গির মরসুমে সকলের রক্ত পরীক্ষার সুপারিশ করছে হু। ফাইল ছবি।
স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রোটোজুওলজি ল্যাবরেটরিতে ওই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের তথ্য নিয়ে তখন শুরু হয়েছে সমীক্ষা। বিজ্ঞানীরা ওই রোগের উৎস বার করতে চাইছিলেন। দেখা গেল, ওই রোগে আক্রান্তদের শতকরা ৯০ ভাগ ডুয়ার্স, ওড়িশা বা অসমের জঙ্গল ঘুরে এসে অসুস্থ হয়েছেন। রোগটিকে চিহ্নিত করা হল ‘ফরেস্ট ম্যালেরিয়া’ হিসেবে। স্বাস্থ্য দফতর নির্দেশিকা জারি করে জানিয়ে দিল, জঙ্গল ঘুরে এসে অসুস্থ বোধ করলেই ম্যালেরিয়ার জন্য রক্তপরীক্ষা করানো বাধ্যতামূলক।
পরের বছর কলকাতায় ম্যালেরিয়া এমন ত্রাসের সৃষ্টি করল যে, জ্বর হলেই রক্তপরীক্ষার নির্দেশ জারি হল। এখন ডেঙ্গি থেকে বাঁচতেও কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকার মানুষের ক্ষেত্রে যেটা একমাত্র রক্ষাকবচ। কারণ, ম্যালেরিয়ার মতো উপসর্গহীন ডেঙ্গির প্রকোপেও ইদানিং ভুগতে হচ্ছে কলকাতা-সহ রাজ্যের মানুষকে। চিকিৎসকেরা রোগ চিনতে না পারায় মৃত্যুও হচ্ছে। কলকাতার এক চিকিৎসকের মন্তব্য, ‘‘ডেঙ্গির অন্যতম উপসর্গ জ্বর, পেশিতে ব্যথা, চোখের পিছনে ব্যথা, গায়ে লালচে দাগ। সিভিয়ার ডেঙ্গির ক্ষেত্রে তলপেটে ব্যথা, মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ, মলের সঙ্গে রক্তক্ষরণ উপসর্গ হিসেবে বলা আছে। কিন্তু জ্বরের সঙ্গে লাগাতার পেটখারাপ এবং আন্ত্রিকও যে ডেঙ্গির উপসর্গ হতে পারে, তা কী ভাবে জানব? তাই প্রথম প্রথম আমরা কিছূই বুঝতে পারিনি। অজানা জ্বর হিসেবেই চিকিৎসা করেছি। অনেক ক্ষেত্রে আসল রোগটা জানতে না পারায় যথাযথ চিকিৎসা হয়নি। অনেকে মারাও গিয়েছেন।’’
আরও পড়ুন:“করোনা আবহে বাজি পোড়ানো বিষপানের চেয়েও ভয়াবহ”
ডেঙ্গির ক্ষেত্রে উপসর্গহীনতার আশঙ্কা আরও বেশি বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, ডেঙ্গিতে সংক্রমিতদের শতকরা ৮০ ভাগের উপসর্গ খুবই মৃদু অথবা উপসর্গহীন।
মশার কামড়ে হওয়া ডেঙ্গি সংক্রমণও বাড়ছে দ্রুত। ফাইল ছবি।
মার্চ মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে হু বলেছে, ২০০০ সাল থেকে দ্রুত বাড়ছে ডেঙ্গি সংক্রমণ । পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যু। ২০১৯ সালে বিশ্বে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গিয়েছে। হু-র উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে উপসর্গহীন ডেঙ্গি। ডেঙ্গি অধ্যুষিত এলাকায় তাই মশানিধনের পাশাপাশি ডেঙ্গির মরসুমে সকলের রক্ত পরীক্ষার সুপারিশ করছে হু।
উপস্থিতি গোপন করেছে করোনাভাইরাসও। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) জানিয়েছে, এ দেশে কোভিড-১৯ ভাইরাসে যাঁরা সংক্রমিত হয়েছেন তাঁদের শতকরা ৭০ জনের রোগের কোনও উপসর্গ ছিল না। তাই করোনা রুখতে বেশি বেশি লালারস ও রক্তপরীক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। যাতে যাঁরা করোনার উপসর্গহীন, তাঁদের দেহের জীবাণুও ধরা পড়ে।
আরও পড়ুন:উৎসবের মরসুমে বাড়িতে ধূপ-ধুনো? কোভিড আবহে ফল হতে পারে মারাত্মক
জনস্বাস্থ্যের পক্ষে উপসর্গহীন সংক্রামক রোগ এক গুরুতর সমস্যা। আসলে উপসর্গহীন ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি ও কোভিড-১৯ রোগীদের অনেকের ক্ষেত্রে রোগ কোনওদিন ধরাই পড়ে না। অর্থাৎ, আজীবন ওই জীবাণু শরীরে বয়ে বেড়ান ওইসব ব্যক্তি। ‘অনুকূল’ পরিস্থিতিতে সেই জীবাণু অন্য অনেককে অসুস্থ করতে পারে। এ সব ক্ষেত্রে আক্রান্ত এলাকার প্রতিটি মানুষের রক্ত বা লালারস পরীক্ষা করানোই সব থেকে ভাল রক্ষাকবচ। পরীক্ষার খরচ বিপুল। তার জন্য দরকার যথাযথ পরিকাঠামোও। যেটা উন্নয়নশীল দেশগুলির পক্ষে করা অসম্ভব। মনে রাখতে হবে, তিনটি জ্বরেরই কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও প্রতিষেধক নেই। সবই পরীক্ষানিরীক্ষার স্তরে আছে মাত্র!