মেয়ে তুতুলের সঙ্গে অনন্যার খুব ভাব। স্কুলের প্রজেক্ট থেকে একসঙ্গে নতুন রান্না করা... সবেতেই মা ও মেয়ের জুটি এক নম্বরে! অনন্যার অফিসের কাজ নিয়েও তুতুলের বিভিন্ন বক্তব্য থাকে। এই যেমন অনন্যা ফোনে কাউকে ‘ডিএম করে দিচ্ছি’ বললেই তুতুল বিজ্ঞের মতো মাকে বোঝায়, “ওটা পার্সোনাল মেসেজ মা, ডিএম এখন কেউ বলে না।”
ওয়ার্ক ফ্রম হোমের দৌলতে অনন্যা এখন মেয়ের সঙ্গেই সারাদিন থাকতে পারেন। তুতুলেরও অনলাইন স্কুল, ক্লাস সেভেন হল তার। কিন্তু মাসখানেক যাবৎ তুতুল একটু বেশিই নিজের মতো থাকে। অনন্যা যেন মেয়ের মনের তল পাচ্ছেন না। হঠাৎ করে যেন বড় হয়ে যাচ্ছে তুতুল, সেই বড় হওয়াটা অনন্যা ঠিক ধরতে পারছেন না।
তুতুল আর অনন্যার মধ্যে দূরত্বের অন্যতম কারণ প্রজন্মগত ফারাক বা জেনারেশন গ্যাপ, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে প্রবীণ ও নবীনদের সম্পর্কের আঙ্গিক নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে।
জেনারেশন গ্যাপের এ কাল-সে কাল
সে কাল: ফিরে তাকানো যাক নব্বইয়ের দশকে যাঁদের জন্ম, কিশোর বয়সে তাঁদের সঙ্গে আগের প্রজন্মের ‘গ্যাপ’-এর দিকে। অভিভাবকদের প্রজন্ম তখন বিশ্বাস রেখেছিলেন অভিজ্ঞতা, চেনা ছকে বাঁধা পথের উপরে। অন্য দিকে, ‘আঠারো বছর বয়সি’রা তখন বেছে নিয়েছিল প্রতি পদক্ষেপে ঝুঁকি ও নতুন পথের অন্বেষণের আনন্দ। উত্তপ্ত সংঘাত লেগেছিল সেখানেই! বয়সজনিত পার্থক্যের জন্যই অভিভাবকদের তখন মনে হত, পরের প্রজন্মকে ভুলের থেকে রক্ষা করতে রক্ষণশীলতাই ঠিক পথ। শব্দটির মধ্যেই তো ‘রক্ষা’ ব্যাপারটি রয়েছে! তাই এ ভাবেই নতুন প্রজন্মকে শেখানো যাবে জীবনের পাঠ। এ দিকে, সেই রক্ষণশীলতা নতুন প্রজন্মের দমবন্ধ করে দিত এক-এক সময়ে। ফলে তীব্র হত পারস্পরিক সংঘর্ষ, গভীর হত ফাটল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুরন্ত ঈগল’ উপন্যাসে বয়োজ্যেষ্ঠ স্যাভেলি প্যানভ যুবক ইভাস্কোকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলেছিল, “যে সব ঈগল কখনো আগুনে পড়েনি, তারা মুরগিরও অধম।” ইভাস্কোর রণকৌশল ও পরিকল্পনার উপরে বিন্দুমাত্র আস্থা ছিল না তার। পাল্টা, ইভাস্কোও বিশ্বাস করতে পারেনি প্যানভকে।
n এ কাল: এ বার ফিরে আসা যাক বর্তমান প্রজন্মের মা-বাবা ও তাঁদের সন্তানদের সম্পর্কের কথায়। এখন বাবা-মায়েরা যত না অভিভাবক, তার চেয়েও বেশি বন্ধু। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষের কথায়, ‘‘এই পরিবর্তন অত্যন্ত ইতিবাচক। এর কারণ আগে যৌথ পরিবারে বাবা মায়ের সঙ্গে-সঙ্গে একটি শিশুর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠত পিসি, কাকা বা মামাদের ভূমিকা। তাঁরাই হয়ে উঠতেন বন্ধু। কখনও কখনও সেই তালিকায় যুক্ত হতেন পাড়ার পিসি বা দাদাও। ফলে বাবা মায়েদের মধ্যে একটা অভিভাবক-সুলভ গাম্ভীর্য সব সময়েই থেকে যেত। কিন্তু এখন এই অণুপরিবারের যুগে পরিবারের কাঠামোই পাল্টে গিয়েছে। কোথাও গিয়ে কয়েক দশক আগের অথরিটারিয়ান পেরেন্টিংয়ের জায়গায় বাবা-মা হয়ে উঠছেন মেন্টর। ভরসা রাখছেন অথরেটেটিভ পেরেন্টিংয়ে।’’ ফলে, সন্তানের সঙ্গে যেমন সু-সম্পর্ক বজায় থাকছে, তেমনই সন্তানের সার্বিক বিকাশের দিকে নজর দিতে পারছেন তাঁরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও কালের নিয়মে তৈরি হচ্ছে ফারাক। অনন্যার মতো আরও অনেক বাবা ও মা বুঝতে পারছেন না, ক’দিন আগেও সব কথা খুলে বলা ছেলে বা মেয়ে গুটিয়ে কেন যাচ্ছে। পায়েল বললেন, ‘‘যেহেতু এখন বাবা-মা ও সন্তানের সম্পর্ক অনেক সহজ ও খোলামেলা, কোথাও গিয়ে সন্তানের উপরে বাবা-মায়ের অতিরিক্ত অধিকারবোধ তৈরি হয়ে যাচ্ছে। তাঁদের মনে হচ্ছে, ‘আমি তো বন্ধুই। আমি তো বকব না। তা হলে সব কিছু আমাকে বলবে না কেন!’ এই অধিকারবোধ জন্ম দিচ্ছে অযাচিত কৌতূহল ও হেলিকপ্টার পেরেন্টিংয়ের। সেখান থেকেই সন্তানের সঙ্গে শুরু হচ্ছে একটা ঠান্ডা লড়াই।’’ যে লড়াইয়ে বাবা-মায়ের সামনে সন্তান একেবারে চুপ করে যাচ্ছে। একসঙ্গে বসে ডিনার সারলেও সন্তান মুখ গুঁজে রয়েছে ফোনে অথবা পছন্দের গ্রাফিক নভেলে।
বর্তমানে জেনারেশন গ্যাপের কারণগুলি কী কী?
প্রযুক্তির ব্যবহার ও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন:
এখনকার শিশু-কিশোরদের হাতের মুঠোয় বিশ্ব! তারা যেমন স্মার্ট, তেমনই বয়স অনুপাতে পরিণত। প্রযুক্তির ব্যবহারে কোনও কোনও ক্ষেত্রে তারা বাবা-মায়ের চেয়েও এগিয়ে। আর ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ব্যবহারের হাত ধরেই সূক্ষ্ম ভাবে পাল্টে যাচ্ছে আমাদের চারপাশের সমাজ ও সংস্কৃতি। কথোপকথনে প্রবেশ করছে ‘ট্রোল’, ‘বিটিএস আর্মি’-র মতো শব্দ। ইউটিউবের সাহায্যে জেনে ফেলছে তারা হরেক বিষয়। লেখাপড়াও চলছে অনলাইনে। ফলে সেই প্রযুক্তির হাত ধরে বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যে তৈরি হচ্ছে একটা প্রচ্ছন্ন ফারাক! ১৭ বছরের কিশোর রেডিটের মিম দেখে হেসে কুটিপাটি হচ্ছে, বাবা-মা
তখনও হয়তো বুঝে উঠতে পারেননি মিম জিনিসটিতে এত হাসার কী আছে? পায়েলের মতে, এই
প্রযুক্তির ফলে যে জেনারেশন গ্যাপ তৈরি হয়েছে তাতে ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দাদু-ঠাকুমার
সঙ্গে নাতি-নাতনিদের সম্পর্ক। দুটো জগৎ ভীষণ ভাবেই আলাদা হয়ে গিয়েছে।
ভাবনাচিন্তার পার্থক্য ও বোঝাপড়ার অভাব:
একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের সমাজ সতত বহমান ও পরিবর্তনশীল। ফলে, একটা সময়ের পর সামাজিক চিন্তাধারায় ও সংস্কৃতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবেই। সেই পরিবর্তনের হাওয়ায় তৈরি হবে জেনারেশন গ্যাপ। এই বিষয়টা বাবা-মায়ের কাছে যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তা হলে সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় না। আমরা যে সময়ে বড় হয়ে উঠেছি, তখনকার মূল্যবোধের সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই পরবর্তী প্রজন্মের মূল্যবোধের ফারাক থাকবে... এটাই ভাবনায় আসে না অনেক ক্ষেত্রে। সেখান থেকেই সন্তান ও বাবা-মায়ের সুষ্ঠু বন্ডিং নড়বড়ে হতে শুরু করে।
বাবা-মায়ের অতিরিক্ত কৌতূহল:
‘কে ফোন করেছিল রে? কার সঙ্গে বেরোবি? তোর বন্ধু ঋত্বিকার বয়ফ্রেন্ড আছে না?’... এ রকম আরও অজস্র প্রশ্ন বন্ধু হিসেবেই হয়তো আপনি করছেন, কিন্তু একটা সময়ের পর আপনার সন্তান মনে করছে,
আপনি তার ব্যক্তিগত পরিসরকে সম্মান করছেন না। কখনও-কখনও আবার এই প্রশ্নের মধ্যে লুকিয়ে থাকে
প্রচ্ছন্ন জাজমেন্ট ও নিষেধাজ্ঞা। সংবেদনশীল কিশোর-কিশোরীটি সেটি বুঝতে পারে... দূরত্ব বাড়িয়ে নেয় ধীরে-ধীরে।
নিজের ইচ্ছে চাপিয়ে দেওয়া:
সন্তান জন্মের পর থেকেই বাবা-মায়ের মনে একটা ছাঁচ তৈরি হয় তার বড় হয়ে ওঠার। তার স্পষ্ট উদাহরণ দেখা যায়, ‘জেনারেশন আমি’ ছবিটির অপু ও তাকে ঘিরে তার বাবা-মায়ের আশা আকাঙ্ক্ষায়। একটা বয়সের পর সন্তান যখন নিজের মতো করে কেরিয়ার বা লেখাপড়ার সিদ্ধান্ত নিতে চায়... বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাবা-মা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বকুনি দিয়ে বা বুঝিয়ে
তারা সন্তানকে ফিরিয়ে আনতে চান তাঁদের পথেই। ফলে, সন্তানের মধ্যে তৈরি হয় অসন্তোষ, দূরত্বও বাড়ে
সে ভাবেই।
জেনারেশন গ্যাপ কমানোর উপায়?
খোলা মনে ভাবনা-চিন্তা করুন: বাবা-মায়ের ধারণা থাকে যে, তাঁরা যেহেতু তাঁদের সন্তান এখন যে বয়সে আছে সেই বয়সটি পার হয়ে এসেছেন, তাই তাঁরা জানেন সন্তান কী ভাবছে বা কী ভাবতে পারে। এই একপেশে চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। আপনার ও সন্তানের কৈশোরের মধ্যে পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় এক দশক। সুতরাং, খোলা মনে ভাবনা চিন্তা করুন।
কথা বলুন, শুনুন ও বোঝার চেষ্টা করুন: সন্তানকে কথা বলতে দিন। কথার শুরুতেই নিজের মতামত চাপিয়ে দেবেন না। মন দিয়ে তার কথা শুনুন, বোঝার চেষ্টা করুন সে ঠিক কী ভাবে ভাবনা-চিন্তা করে। তার পর নিজের মতামত জানান। মনে রাখবেন, আলোচনার মাধ্যমে একটা মাঝামাঝি জায়গায় আসতে পারলেই ধীরে ধীরে আপনার সঙ্গে সন্তানের বোঝাপড়া ঠিক হবে। ছেলে বা মেয়ের আচরণে আপনার খারাপ লাগলে, সেটাও ওকে বুঝিয়ে দিন। একই সঙ্গে, ওর খারাপ আচরণের উৎস খোঁজার চেষ্টা করুন।
প্রকাশ করুন ভালবাসা: সন্তানকে বোঝানো জরুরি যে, আপনি তাকে নিঃশর্ত ভাবে ভালবাসেন। ভালবাসা কিন্তু যে কোনও সময়ে সম্পর্কে তৈরি হওয়া দূরত্ব কমিয়ে আনতে পারে। তবে, খেয়াল রাখবেন তা যেন অপ্রয়োজনীয় প্রশ্রয় না হয়ে যায়।
জেনারেশন গ্যাপ অবশ্যম্ভাবী ও পরিবর্তনশীল। কিন্তু আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তি দিয়ে ভাবলেই সম্পর্কে এটি আর প্রভাব ফেলতে পারবে না।