নারীর সঙ্গে ঋতুচক্রের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী। তার হাত ধরেই শরীরে প্রথম পরিবর্তন অনুভব করা, ‘বড়’ হওয়া, আবার নতুন প্রাণের আগমন ধ্বনি শোনা... অবিচ্ছেদ্য এক যোগাযোগ। অথচ এই চক্রটি সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা স্পষ্ট নয়। তা যদি ঠিক মতো জানা থাকে, গাইনিকলজিক্যাল অনেক সমস্যার আভাস কিন্তু আগে থেকে পাওয়া যায়।
গোড়ার কথা
আঠাশ দিনের সাইকেলে নারী শরীরের হরমোন জনিত যে পরিবর্তন হয়, তাকে পিরিয়ডস বা ঋতুচক্র বলা হয়। প্রতি মাসে এই সাইকেল চলতে থাকে। বহু মহিলারই একটা ভুল ধারণা আছে যে, এই রক্ত দূষিত। আসলে এই রক্ত শরীরের সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রক্ত। অ্যাডভান্সড ল্যাপরোস্কোপিক সার্জন অ্যান্ড ইনফার্টিলিটি স্পেশ্যালিস্ট ডা. অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘আমাদের কাছে বহু রোগী ফোন করে বলেন যে, ‘আমার কালচে রক্ত বেরোচ্ছে। তা কোনও খারাপ রক্ত নয় তো?’ ব্যাপারটা কী হয়, মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল যখন শুরু হয়, তখন জরায়ুর মুখ খুলে যায়। খুলে গেলে ফ্রেশ ব্লাড বা লাল রক্তই বেরোয়। কিন্তু অনেক সময়ে জরায়ুর মুখ বা সার্ভিক্স খুলতে পারে না। তখনই রক্ত ইউটেরাসে জমে কালচে বা বাদামি রঙের হয়ে যায়। দুটোই স্বাভাবিক, চিন্তার কিছু নেই। দু’-একদিন পর হয়তো জরায়ুর মুখ খুলে গেল, তখন ওই কালচে বা বাদামি রঙের রক্ত বেরিয়ে গেল।’’ ব্লিডিংয়ের পরিমাণ নিয়েও অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে। স্বাভাবিক ঋতুচক্রে ব্লিডিং হওয়া উচিত ৫ থেকে ৩৫ এমএল অবধি। তাই এক চামচও যদি ব্লিডিং হয়, সেটাও কিন্তু স্বাভাবিক।
কিছু সমস্যা ও সমাধান
পিরিয়ডস শুরু হওয়ার আগে মহিলাদের হোয়াইট ডিসচার্জ হয়। কখনও কখনও আবার ইচিং হতে দেখা যায়। এর কারণ কী? ডা. চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘সবটাই প্রকৃতির নিয়ম। হোয়াইট ডিসচার্জ বেরোয় পিরিয়ডস শুরু হওয়ার চোদ্দো দিনের মাথায়। ঠিক যখন ওভুলেশন হয়। হোয়াইট ডিসচার্জের কাজ ভ্যাজাইনাকে ময়শ্চারাইজ়ড রাখা। এই সিক্রেশন সাহায্য করে লুব্রিকেশনেও। তাই এই বিশেষ সময়টুকুতে ইন্টারকোর্স করলে সন্তান আসার সম্ভাবনা বেশি। ওভুলেশনের কারণে যে হরমোন জনিত পরিবর্তন হয়, তার কারণে ভ্যাজাইনা থেকে এই সিক্রেশন হয়। এ সময় কারও যদি ইচিং হয়, তা হলে কিন্তু ডাক্তার দেখানো দরকার।’’ পিরিয়ডসের চোদ্দো বা ষোলো দিনের মাথায় যে সাদা শ্রাব বার হয়, তাতে যদি কোনও দুর্গন্ধ না থাকে বা ইচিং না হয়, তা হলে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।
ঋতুচক্রের সময়ে কমবেশি ব্যথা সকলেরই হয়, তবে চিন্তার কারণ হয় যখন তা অত্যধিক হয়। জরায়ুর মুখ যখন অল্প খোলে তখন পিরিয়ডসের রক্ত সেখানে জমে থাকে। তার পর ইউটেরাস তা চেপে বার করার চেষ্টা করে সরু সার্ভিক্স দিয়ে। ফলে এই সময়ে ব্যথা হয়। সাধারণত এই ব্যথা জেনেটিক। খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাঁর মা বা মাসিরও হয়তো এই সমস্যা ছিল। ডা. চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘পিরিয়ডসের সময় একটা ব্যথা স্বাভাবিক ভাবে হতে পারে। তবে ইদানীং অ্যাডোলেসেন্টদের পিরিয়ডসেও আমরা বহু এন্ডোমেট্রিয়োসিস বা পলিপ, ফাইব্রয়েডের মতো কেস দেখতে পাচ্ছি। এ সব ক্ষেত্রেও খুব ব্যথা হয়। তাই ব্যথা হলে, পাঁচ-ছ’মাস যাবৎ সাধারণ পেনকিলার খাওয়ার পরেও যদি তা না কমে, তা হলে একবার ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।’’ অনেকেই বলেন, ব্যথার সময়ে হটওয়াটার ব্যাগ নিলে আরাম পাওয়া যায়। যদিও এর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
কতটা নিরাপদ এ সময়ে শারীরচর্চা করা?
এক্সারসাইজ় করার ফলে পেলভিসে রক্ত চলাচল বেড়ে যায়। যাঁরা পিরিয়ডস চলাকালীন এক্সারসাইজ় করেন, তাঁদের ব্লিডিং বেশি হয়। ক্লান্ত লাগে। তাই ডাক্তারদের পরামর্শ, এ সময়ে হালকা শারীরচর্চা করুন। হেভি ওয়েট ট্রেনিং বা অ্যাবসের এক্সারসাইজ়, ট্রেডমিলে হাঁটা, সাইক্লিং এড়িয়ে চলাই ভাল।
পিউবার্টির বয়স কি এগিয়ে এসেছে?
সাধারণত আট থেকে চোদ্দো বছর বয়সের মধ্যে পিউবার্টি বা বয়ঃসন্ধির সূচনা হয়, যেটা স্বাভাবিক। তবে পশ্চিমি দেশে প্রথম পিউবার্টির বয়স এগিয়ে আসতে দেখা গিয়েছে। এ কারণ ব্যাখ্যায় ডা. চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘এখন বাচ্চাদের পুষ্টির মাত্রা উন্নততর হয়েছে। মেয়েরা এক্সারসাইজ়ও করে বেশি। ফলে ইস্ট্রোজেন প্রোডাকশন ভাল হয়। পুষ্টির কারণেই দেখা যাচ্ছে পিউবার্টি এগিয়ে এসেছে। আগে যে বয়সটা ছিল এগারো থেকে বারো, এখন সেটা দেখা যাচ্ছে ন’ থেকে দশ বছরে এসে পৌঁছেছে।’’
ইদানীং কালে মহিলাদের মেনোপজ়ও কিন্তু এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশে মেনোপজ়ের বয়স মোটামুটি ৪৯ থেকে ৫১ বছরের মধ্যে। যদিও এখন অনেকের ৪৫ বছরের আগেই মেনোপজ় হতে দেখা যাচ্ছে। ‘‘তার বড় কারণ ধূমপান। এর কারণে বহু মহিলার প্রি ম্যাচিয়োর মেনোপজ় হচ্ছে। ধূমপানের কারণে ওভুলেশন এবং ইস্ট্রোজেন উৎপাদনে, এমনকি সন্তানের জন্ম দিতেও সমস্যা হয়। আর এই ব্যাপারটা কিছুটা জেনেটিক বটে। মায়ের হয়তো তাড়াতাড়ি মেনোপজ় হয়েছে, তাই মেয়ের ক্ষেত্রেও তা হতে দেখা গিয়েছে,’’ বললেন ডা. চট্টোপাধ্যায়। এ সবের সঙ্গে মেনোপজ় এগিয়ে আসার আরও একটা সাধারণ কারণ হল জীবনযাত্রায় পরিবর্তন। ঠিকমতো এক্সারসাইজ় না করা, রোদে না বেরোনোর ফলে ভিটামিন ডি-র অভাব, অটো ইমিউন রোগ, থাইরয়েড... এ রকম কারণেও প্রিম্যাচিয়োর মেনোপজ় হতে দেখা যাচ্ছে। তা ছাড়া, ফার্টিলিটি ট্রিটমেন্টের কারণেও মেনোপজ় এগিয়ে আসে অনেক সময়।
তাই সুস্থ থাকার প্রাথমিক নিয়মগুলো অবশ্যই মেনে চলুন। নিয়মিত শারীরচর্চা, পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া এবং শরীর সম্পর্কে সচেতনতা... তা হলে সুস্থ থাকবেন আপনি এবং ভাল থাকবে আপনাকে জড়িয়ে থাকা আপনজনেরা।