প্রতীকী ছবি।
বিমানবন্দরের গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে বেশ কিছু ক্ষণ বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে ছিল খন্না মোড়ের বাসিন্দা অসিস্টিক শিশু বছর দশেকের স্নেহা পাল। প্রথমটায় সমস্যা হয়নি। গোল বাধাল ৩০ মিনিট অপেক্ষার পরে। বিমানবন্দরের ঘোষণা শুনে তখন মাঝেমধ্যেই চমকে উঠছে সে। সঙ্গে হাত-পা ছুড়ে চিৎকার।
বিমানের জন্য আরও ২০ মিনিট অপেক্ষার পরে চেক-ইন কাউন্টারের দিকে এগনোর পালা। তত ক্ষণে হাবভাব সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে স্নেহার। পুলিশ চেকিং শুরু হতেই মায়ের হাত ছাড়িয়ে ছুটতে শুরু করল সে। বন্দুকধারী নিরাপত্তারক্ষীদের ফাঁক গলে মূল গেট পেরিয়ে সোজা গিয়ে দাঁড়াল ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের সামনে। সে বার আর গরমের ছুটিতে গোয়া বেড়াতে যাওয়া হয়নি স্নেহাদের। স্নেহার মা পেশায় স্কুল শিক্ষিকা সর্বাণী শনিবার বললেন, ‘‘আর কোথাও বিমানে যাই না। মেয়ে খুব ভয় পায়। ওদের জন্য কোনও সাহায্য পাওয়া যায় না। আমরা ঠিক করেছি, ট্রেনে
বা গাড়িতে করে যত দূর যাওয়া যায়, তত দূরই যাব!’’
একা স্নেহা নয়। অধিকাংশ অটিস্টিক শিশুর পরিবারের অভিজ্ঞতা একই রকম। অনেকেই জানাচ্ছেন, এমনিতেই অটিস্টিক বাচ্চাদের অচেনা পরিবেশে সমস্যা হয়। বেশি আওয়াজ, আলোয় বিরক্ত হয়ে যায় তারা। অচেনা ব্যক্তির চোখের দিকে তাকাতে, একসঙ্গে একাধিক নির্দেশ মেনে কাজ করার ক্ষেত্রেও সমস্যা হয় তাদের। তেমনই এক শিশুর মা বললেন, ‘‘বিমানবন্দরে প্রচুর চেকিং। সব সময়ে আমাদের বাচ্চারা অন্যদের মতো সব নির্দেশ মানতে পারে না। বিমানবন্দরের আওয়াজে ওদের খুব সমস্যা হয়।’’ আরও বড় সমস্যা হয় বিমানে ওঠার আগে দীর্ঘক্ষণের অপেক্ষায়।
দমদম পার্কের বাসিন্দা নীলাঞ্জনা রামবথু জানান, কোনওমতে বিমানবন্দরে অপেক্ষা করা গেলেও বিমান ওঠা-নামার সময়ে অটিস্টিক বাচ্চাদের সামলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। তাঁর অভিযোগ, অনেক সময়েই বিমান পরিষেবা সংস্থাগুলির কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যায় না। নীলাঞ্জনার কথায়, ‘‘আমার ছেলে, ভেঙ্কটেশ অটিস্টিক। কলকাতা থেকে চেন্নাই যাওয়ার পথে কলকাতা বিমানবন্দরে খুব সমস্যায় পড়েছিলাম। টেক অফের আগে ও কিছুতেই সিটবেল্ট বাঁধতে চাইছিল না। আমি জানি ওটা গুরুত্বপূর্ণ। সময় দিলে ওকে যে শান্ত করা সম্ভব, তা মানতেই চাইছিলেন না বিমানসেবিকারা। ওঁদের দাবি ছিল, বিমান থেকে দ্রুত নেমে যেতে হবে। অন্য যাত্রীদের সাহায্যে কোনও মতে সমস্যার সমাধান হয়েছিল।’’ জানালেন, আরও এক বার সমস্যা হয় কলকাতা থেকে দিল্লি যাওয়ার পথে। সে বার বিমানসেবিকারা ওষুধ খাইয়ে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার কথা বলেছিলেন। নীলাঞ্জনার কথায়, ‘‘ঘুম পাড়িয়ে নিয়ে যাব? প্রতিবাদ করেছিলাম। তবে স্বামী চাননি বলে অভিযোগ করিনি। ছেলেকে নিয়ে আর বিমানে উঠি না আমরা। হায়দরাবাদে বিমানবন্দরে বিশেষ শিশুদের জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে তো সে সবও নেই।’’ কলকাতা বিমানবন্দরের এক শীর্ষ আধিকারিক বললেন, ‘‘অন্ধদের জন্য নতুন কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। তবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য এখনই কোনও পরিকল্পনা নেই।’’ সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, ‘‘যাত্রীদের সমস্ত দায়-দায়িত্ব বিমান পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার। কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি আমরা।’’
তবে কি অটিস্টিক শিশুদের উড়ান-ভয় নিয়েই থাকতে হবে? আজ, সোমবার বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসে ছাত্রদের বিমানবন্দরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে কাজ করা দমদম পার্কের একটি স্কুল। লেকটাউন থানার তরফে বিমানবন্দর থানায় এ
বিষয়ে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এতে বিমানবন্দরের কর্মীরাও অটিস্টিক শিশুদের সঙ্গে কী ভাবে মিশতে হয়, তা শিখতে পারবেন বলে জানালেন ওই স্কুলের এক শিক্ষিকা। তাঁর কথায়, ‘‘বিমানবন্দর শুনেই ছেলে-মেয়েরা রাজি হচ্ছিল না। বিমানে ওঠানো হবে না শুনে সাহস পেয়েছে ওরা।’’