এক দিকে বাইরে বেরোনোর জো নেই, অন্য দিকে ফোনের এক ক্লিকেই দোরগোড়ায় হাজির হচ্ছে মুখরোচক জাঙ্ক ফুড। আর তার সঙ্গে রয়েছে স্ট্রেস, টেনশন, অ্যাংজ়াইটি। সব মিলিয়ে শরীর তো শোধ তুলবেই। প্রত্যেকের শরীরে রয়েছে অজস্র ধমনী। অতিমারির সূচনালগ্ন থেকে বাড়িতে বসে শরীরে যেমন মেদ জমছে, তেমনই আর্টারিতেও জমছে ফ্যাট, কোলেস্টেরল, যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলা হয় অ্যাথেরোসক্লেরোসিস। সাধারণত এই প্রক্রিয়া জন্মের সময় থেকেই শুরু হয়ে যায়, আর এই অ্যাথেরোসক্লেরোসিসের জটিলতা থেকে হতে পারে প্রাণঘাতী রোগ। সেডেন্টারি লাইফস্টাইল, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও তামাকজাতীয় নেশার জন্য এ রোগ বাড়ছে ক্রমশ। মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষেই আক্রান্ত হতে পারেন এ রোগে। অনেক ক্ষেত্রেই এর জটিলতার আঁচও পান না রোগীরা। স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক হলে তবে বোঝা যায়। তা হলে উপায় কী? জেনে নিন বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন...
অ্যাথেরোসক্লেরোসিস হওয়ার কারণ কী?
কার্ডিয়োলজিস্ট ডা. কৌশিক চাকী বললেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে ধমনীর দেওয়ালের মধ্যে চর্বি, কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য পদার্থ জমতে থাকে। এই বিল্ডআপটিকে বলে প্লাক। এর ফলে ধমনী সংকীর্ণ হয়ে রক্তপ্রবাহকে বাধা দিতে পারে।’’ এই ব্লকেজ থেকেই স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা থাকে।
এই প্লাক স্টেবল ও আনস্টেবল দু’রকমের হতে পারে। আনস্টেবল প্লাক বেশি ক্ষতিকর, কারণ তা হঠাৎই ফেটে গিয়ে রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে রক্তের গতি শ্লথ হয়ে আসে বা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে।
অ্যাথেরোসক্লেরোসিস হওয়ার পিছনে অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে। তাই রোগ নির্ণয়ের জন্য আগে রোগীর মেডিক্যাল হিস্ট্রি দেখা হয়। রোগীর ডায়াবিটিস, হাই ব্লাড প্রেশার, কোলেস্টেরল আছে কি না দেখতে হবে। জেনেটিক ব্যাকগ্রাউন্ডও গুরুত্বপূর্ণ। রোগীর পরিবারে কারও যদি কম বয়সে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হওয়ার ঘটনা ঘটে থাকে, তা হলে সাবধান হতে হবে। ধূমপানও অন্যতম ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া থাকছে স্ট্রেস, ফুড হ্যাবিট। ওবেসিটিও রিস্ক ফ্যাক্টর। অতিমারিতে প্রত্যেকের জীবনেই স্ট্রেস বেড়েছে, কমেছে শরীরের মুভমেন্ট। এ দিকে বাড়িতে বসে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভাজাভুজি খাওয়া। এ সবই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে মদত জোগাচ্ছে এই রোগকে।
শুধু বয়স্কদের নয়, কম বয়স থেকেই বাড়ছে এ রোগ
পুরুষ-মহিলা বিভিন্ন বয়সে এ রোগের শিকার হতে পারেন। কার্ডিয়োলজিস্ট ডা. সুনীলবরণ রায় বললেন, ‘‘পুরুষদের ৩৫ থেকে ৪৫-এর মধ্যে এ রোগ দেখা দিতে পারে। মহিলাদের ক্ষেত্রে ১২-৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত নিরাপদ পর্ব হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। এ সময়ে ইস্ট্রোজেনের ক্ষরণ বেশি হয় শরীরে, যা কার্ডিয়োপ্রোটেক্টিভ। কিন্তু মেনোপজ়ের পর থেকে মহিলাদের মধ্যে এই রোগের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তবে ইদানীং মেনোপজ়ের আগেই মহিলাদের শরীরে এ রোগের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। তার কারণ ফুড হ্যাবিট, স্ট্রেস, ধূমপানের অভ্যেস এবং জেনেটিক কারণ। এই রিস্ক ফ্যাক্টরের জন্যই কম বয়সেও স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে।’’
রোগের উপসর্গ
কিছু ক্ষেত্রে উপসর্গ বোঝা যায়, কিছু ক্ষেত্রে যায় না। বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, বুকে জ্বালা, হঠাৎ করে কথা জড়িয়ে যাওয়া, জ্ঞান হারানোর মতো কিছু লক্ষণ দেখা দেয়। ডা. চাকীর কথায়, ‘‘বাঁ হাতে ব্যথা বা চোয়ালে ব্যথা ছড়িয়ে পড়লে, হঠাৎ অতিরিক্ত ঘাম হলেও সতর্ক হন। ব্যথা হাত থেকে পিঠের দিকে ছড়াতে পারে। অনেক সময়ে হাত দু’দিকে সোজা করে তুলতে গেলে দেখা যায়, একটা হাত উপরে উঠছে না, বা বেঁকে যাচ্ছে। বুকে ব্যথার মতো লক্ষণও দেখা যায়। কিন্তু বাঙালিদের আজন্মকাল গ্যাস-অম্বলের রোগ। ফলে বুকে ব্যথা, বুক জ্বালা হলে প্রায় সকলেই গ্যাসের ব্যথা ধরে নেন। আসল রোগ চাপা পড়ে যায়। এক বার হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হলে ঠিক কারণ সামনে আসে। অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে বাঁচানো যায় না। তাই এ রোগের চিকিৎসা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুরু করতে হবে। আর মনে রাখতে হবে, সব বুকের ব্যথা কিন্তু গ্যাসের ব্যথা নয়।’’
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা
বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি হলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সুগার, লিপিড প্রোফাইলের মতো কিছু রক্তপরীক্ষা করতে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ইসিজি, ইকোকার্ডিয়োগ্রাম, ট্রেডমিল টেস্টও করতে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে, রোগীর শারীরিক অবস্থা যদি আশঙ্কাজনক হয়, তা হলে ট্রেডমিল টেস্ট করা উচিত নয়। কারণ ট্রেডমিল টেস্ট করতে গিয়েও অনেক সময়ে অ্যাটাক হতে পারে। সে সময়ে যেহেতু হঠাৎ শরীরের গতি বেড়ে যায়, রক্ত চলাচলও বেড়ে যায়। এর মধ্যে আর্টারিতে যদি ব্লক থাকে, তা হলে স্ট্রোক বা অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। ‘‘সে ক্ষেত্রে হার্টের সমস্যা সন্দেহ হলে সিটি স্ক্যান করে হার্টের ধমনীতে ব্লকেজ আছে কি না, দেখা যেতে পারে। এর সঙ্গে ক্যালশিয়াম স্কোরিংয়ের মাধ্যমে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি নির্ধারণ করা যায়। হার্ট ব্লক হয়ে অ্যাটাক হলে অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি করালে সুফল পাওয়া যায়। তবে তা যত শীঘ্র সম্ভব করতে হবে। হার্ট ও ব্রেনের মাসল যদি একবার ড্যামেজ হয়ে যায়, তা হলে তা আর ঠিক হয় না,’’ বললেন ডা. চাকী।
জীবনযাপনে বদলই ওষুধ
এ রোগের দাওয়াই কিছুটা হলেও আমাদের হাতে। জেনেটিক কারণ থাকলে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু ডায়েট ও শারীরচর্চার মতো বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। শরীরের প্রয়োজন অনুসারে খেতে হবে, জিভের চাহিদা অনুযায়ী নয়। জাঙ্ক ফুড, সফট ড্রিঙ্ক এড়িয়ে চলুন। স্যালাড ও ফাইবারযুক্ত খাবার খান। ডালিয়া, ওটস উপকারী। ভোর বেলা হাঁটতে বেরোতে পারেন বা সাইক্লিং করুন। রাস্তায় বেরোতে না চাইলে রোজ বাড়ির ছাদে অন্ততপক্ষে আধ ঘণ্টা হাঁটার অভ্যেস গড়ে তুলুন। ধূমপানের বদভ্যেস থাকলে, সেটিও ছাড়তে হবে। আর একটা বিষয়, অনলাইন জীবনে স্ট্রেস বাড়ছে। তাই দিনের একটা সময়ে ফোন, ল্যাপটপ সরিয়ে পরিবারের মানুষের সঙ্গে গল্পগুজব করুন, বাগান করুন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে আড্ডা দিন। মন ভাল থাকবে, শরীরও। আর চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ খেতে হবে নিয়মিত।
সেডেন্টারি লাইফস্টাইল আমাদেরই তৈরি করা, যার মূল্য দিতে হচ্ছে অজস্র রোগভোগে। তাই জীবনযাপন বদলে দেখুন, সুস্থ থাকাও কিন্তু খুব কঠিন নয়।