প্রতীকী ছবি।
বছর চারেক আগে স্তন ক্যানসার ধরা পড়েছিল তাঁর। বাদ দিতে হয়েছিল একটি স্তন। চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, তিনি সুস্থ। তবে দশ বছর ওষুধ খেয়ে যেতে হবে। এখন সেই রোগিণীর প্রশ্ন, সংসারে যে ক্যানসার বাসা বেঁধেছে, তার ওষুধ কোথায়? ফলো-আপে আসা সেই রোগিণী সম্প্রতি তাঁর চিকিৎসককে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছেন, ‘আপনি আমায় দ্বিতীয় জীবন দিয়েছেন। এ বার আমার সংসার বাঁচান। স্বামীকে বোঝান যে, আমার সঙ্গে সহবাসে ওঁর ভয় বা সমস্যা নেই। না হলে দশ বছরের মেয়েটাকে নিয়ে হয়তো আমাকে একা পড়ে থাকতে হবে।’
“বিয়ের আগে বারো বছরের বন্ধুত্ব। সেখানে কি একটু মানবিক হওয়া যায় না? ক্যানসার হওয়াটা তো দোষের নয়। সঙ্গী, বন্ধু ও পরিজনেরা করুণা নয়, তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা দেখান। স্বাভাবিক ছন্দে এগোলে রোগের সঙ্গে লড়াই অর্ধেক হয়ে যাবে,” বলছিলেন ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়।
মেডিক্যাল রিপ্রেজ়েন্টেটিভের চাকরি নিয়ে মধ্য তিরিশের যুবক তখন স্বপ্নে বিভোর। জানা গেল, মুখে ক্যানসার। অস্ত্রোপচারে সুস্থ হলেন। শুধু কথায় সামান্য জড়তা। কিছু দিন পরে সেটাও ঠিক হয়ে যাবে, বলেছিলেন ডাক্তার। মানেননি সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার। ডাক্তারের চিঠিও খুলতে পারেনি সেই বন্ধ দরজা।
আরও পডুন: ‘টিকার মতোই শুধু আইন বাঁচায় না, তার প্রয়োগ বাঁচায়’
কিংবা সেই মেয়েটি। যাঁর বিয়ের বছর তিনেক পরে জরায়ুমুখে ক্যানসার ধরা পড়ায় বদলে গিয়েছিলেন কলেজের প্রিয় বন্ধুটি, যাঁর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। একাকী তরুণী আজও জানেন না, তাঁর অপরাধ কী!৭ নভেম্বর, শনিবার ছিল ‘জাতীয় ক্যানসার সচেতনতা দিবস’। বহু বছর ধরে এই দিনটি যে শুধু খাতায়-কলমেই পালিত হচ্ছে, উপরের ঘটনাগুলিই তার সাক্ষী।
এমন সামাজিক বঞ্চনা এবং উপেক্ষা দূর করতে সরকারের পদক্ষেপ জরুরি ছিল, বলছিলেন এক অর্থনীতিবিদ। তাঁর মতে, পূর্বসূরীদের মতোই এ বিষয়ে বর্তমান সরকারের অবহেলার দিকটি স্পষ্ট হয় ২০২০-’২১ অর্থবর্ষের কেন্দ্রীয় বাজেট দেখলে। সেখানে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ৬৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকার মধ্যে স্ট্রোক, কার্ডিয়োভাস্কুলার, ক্যানসার এবং ডায়াবিটিসের মতো রোগের প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে মিলিত বরাদ্দ ১৭৫ কোটি! অথচ, ওই চারটি রোগের প্রতিটি আলাদা গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্য। অর্থনীতিবিদেরা মানছেন, প্রায় ১৩৮ কোটি মানুষের দেশে এই বার্ষিক বরাদ্দ অতি নগণ্য।
চিকিৎসকদের মতে, ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা গড়তে এবং ছুঁতমার্গ কমাতে সরকারি প্রচার জরুরি ছিল। প্রস্তাব উঠেছে, সরকারি হাসপাতালে ক্যানসার বিভাগেই বিনামূল্যে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা হোক। ব্রেস্ট সার্জন তাপ্তি সেনের অভিজ্ঞতায়, “অনেক পরিজন ভীষণ সহানুভূতিশীল হন। বিভ্রান্ত পরিজনের সংখ্যাও যথেষ্ট। কাউন্সেলিং করে ও পাশে থাকার ভরসা জুগিয়ে এঁদের মনোবল বাড়াই। বহু ক্ষেত্রে কাজ হয়। সামাজিক সচেতনতারও প্রসার ঘটানো দরকার।”
কারণ, আজও সমাজের একটি বড় অংশের ধারণা, বাড়ির পুরুষই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁকে বাঁচাতেই হবে। আর মেয়েরা থাকেন অবহেলিতই। সেই সঙ্গে মেয়েরাও নিজেদের রোগ চেপে সমস্যা বাড়িয়ে তোলেন। ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, “জরায়ুমুখ, ইউটেরাস এবং স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত মহিলারা অনেকেই সংসারে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করেন। অথচ, সহবাসে বা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে কোনও বিপদ যে নেই, তা সঙ্গীকে বোঝানো, রোগীর মনোবল বাড়ানো এবং পরিজনদের সহানুভূতিশীল হওয়ার পাঠ দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সরকারি বা বেসরকারি, কোনও ক্ষেত্রেই কিছু হচ্ছে না। এই সদিচ্ছার অভাবেই রক্তের ক্যানসারের সরকারি চিকিৎসায় রাজ্যে এখনও ভরসা শুধু এন আর এস এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।’’ চিকিৎসকদের মতে, সামাজিক বঞ্চনার ব্যাধি সারাতে সরকারি পদক্ষেপ দৃঢ় না হলে বিশেষ দিন থেকে যাবে স্মৃতিতেই।