— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
একটা মন্থর ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে গেল তিথির মুখ। ইয়ারফোনে ম্যাডোনার কণ্ঠে তখন, ‘হোয়েন আই লুক অ্যারাউন্ড, বেবি ইউ জাস্ট কান্ট বি ফাউন্ড।’ বিষণ্ণ চোখে মোবাইলটার দিকে তাকাল সে, কোনও মেসেজ নেই। এই নিয়ে তিন দিন হল। অদ্ভুত ভাবে চুপ করে গিয়েছে শুভ্র। অথচ, তিন দিন আগেই শুভ্র তাকে ছাড়া চোখে অন্ধকার দেখছিল...
ঘটনা অপরিচিত নয়, ধরন অপরিচিত নয়। ‘তোমায় ভালবাসি না, আবার বোধহয় বাসি...’ বর্তমানে এই অদ্ভুত দোটানায় আবর্তিত হয় তিথি-শুভ্রর মতো অনেকের জীবনই। এর একটি গালভরা নামও রয়েছে, ‘ব্রেডক্রাম্বিং’। পাখির সামনে রুটির গুঁড়ো ছড়িয়ে তাকে যেমন আটকে রাখা যায়, তেমনই মিষ্টি কথায়, আলতো অনুভূতি ও মনোযোগে একটি মানুষকে আশা দেন এক জন। চলতে থাকে দিনের পর দিন আলাপ, তৈরি হয় নির্ভরতার জায়গা। তার পর হঠাৎ একদিন সব চুপ... বেশ কয়েক দিন সেই নৈঃশব্দ্যের পরে ফের একদিন কথা শুরু। ফের মনোযোগ, ফের অনুভূতির ছোঁয়া। এ পারের মানুষটি তখন বুঝে উঠতে পারছেন না সম্পর্কের ভবিতব্য আসলে কী। টানাপড়েনে মনোবল ক্রমশ ভাঙছে তাঁর। সেখান থেকেই অ্যাংজ়াইটি, ডিপ্রেশনের মতো মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে।
শুধু কি ‘ব্রেডক্রাম্বিং’? জেনারেশন জ়ি-এর সম্পর্কের ভাষায় রয়েছে ‘সিচুয়েশনশিপ’, ‘গোস্টিং’, ‘লাভ বম্বিং’-এর মতো রকমফের। অ্যাপের সাহায্যে আলাপ, তার পর দেখা-সাক্ষাৎ, কফি ডেটে যাওয়া... এগুলো খুব চটজলদি হতে থাকে বর্তমান প্রজন্মের জীবনে। সম্প্রতি এই বিষয়গুলি নিয়ে মুখ খুলেছেন অমিতাভ বচ্চনের নাতনি নব্যা নভেলি নন্দা। মা শ্বেতা নন্দা ও দিদিমা জয়া বচ্চনকে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন নতুন প্রজন্মের প্রেমের সংজ্ঞা। স্পষ্টতই দাবি করেছেন, ‘দো জিসম এক জান’ এখন আর অতটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেরিয়ারমুখী নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছেই সম্পর্ক এখন এক রহস্যময় সময়যাপন। সেখানেও রয়েছে রকমফের—
এর সঙ্গেই রয়েছে ‘ব্রেডক্রাম্বিং’। আসলে, ‘ব্রেডক্রাম্বিং’ এমন এক খুড়োর কল যাতে মন্ডা মিঠাই একেবারেই মুখে এসে পড়ে না। দৌড়নোই সার হয়। সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত এমন কৌশল, যাতে মনে হয় মানুষটি সম্পর্ক নিয়ে ভীষণ আন্তরিক। কিন্তু আদতে পুরোটাই ছল। সময়ে সময়ে প্রকট হয়ে আসে ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’র মনোভাব। এই ধরনের মানসিকতার মানুষ বেশির ভাগই ভার্চুয়াল আলাপচারিতায় আগ্রহী।
এর কারণ কী?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবীর মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “ব্রেডক্রাম্বিং-এর কারণকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। একটা হল অনিচ্ছাকৃত— ব্যক্তিগত আঘাত বা ট্রমার কারণে কমিট করতে না চাওয়া। তিনি হয়তো চাইছেন না ব্রেডক্রাম্বিং করতে, কিন্তু তাঁর ফোবিয়া বা পূর্ব অভিজ্ঞতার ক্ষত তাঁকে বাধ্য করছে। নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ নেই। অনেক ক্ষেত্রে বড় হওয়ার পরিবেশ, বাবা-মায়ের সম্পর্কের মাত্রা এই বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করে। দ্বিতীয়টি হল নিজের সুবিধের জন্য কাউকে ইচ্ছাকৃত নিয়ন্ত্রণ করা। সেখান থেকেই কখনও মধুর আলাপ, কখনও নৈঃশব্দ্য। এই টক্সিক ম্যানিপুলেশন বিষয়টি ওই ব্যক্তির চারিত্রিক গঠন।”
কিন্তু কেন এই ইচ্ছাকৃত নিয়ন্ত্রণ?
ডা. মুখোপাধ্যায় জানালেন, “প্রথমেই বলব ‘অ্যাটেনশন-সিকিং’-এর কথা। সঙ্গে বৈধতা তথা ভ্যালিডেশন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও রয়েছে। মানুষ বরাবর অন্যের মনোযোগ পেতে পছন্দ করে। সমাজমাধ্যমের যুগে সেই আকাঙ্ক্ষা আরও বেড়েছে। সেখান থেকে ক্রমাগত এক জনের মনোযোগ পাওয়ার জন্য এই অছিলা। এ ক্ষেত্রে যিনি ‘ব্রেডক্রাম্ব’ করছেন তাঁর মনে হয়, অন্যের কাছ থেকে মনোযোগ বা বৈধতা না পেলে তাঁর আত্মবিশ্বাস আঘাত খাবে। আর যাঁদের কিছু কিছু পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার রয়েছে, তাঁরা অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করে তৃপ্তি পান। তাঁদের মনে হয়, সম্পর্কে এই আচরণ করে তিনি এগিয়ে রয়েছেন।”
কিছু বিশেষ ধরনের পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে এই আচরণ দেখা যায়। যেমন, নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার, অ্যান্টিসোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা দেখা যায়। স্পষ্ট করে বললে, নিজেকে ক্ষমতার মধ্যে রাখতে বা ক্ষমতা জাহির করতে যারা ভালবাসে তাদের মধ্যেই দেখা যায় অন্য মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা। এর সঙ্গে রয়েছে আত্মবিশ্বাস কম হওয়ার ব্যাপারটাও। হঠাৎ হঠাৎ শীতল হয়ে যাওয়ার পিছনে কাজ করে ক্ষমতাশীল হওয়ার লোভ এবং আত্মবিশ্বাস কম হওয়া। সঙ্গতে কমিটমেন্ট ফোবিয়া। অর্থাৎ, এটা মনে হওয়া যে আমি যদি এই সম্পর্কে রাজি হয়ে যাই, তা হলে আমাকে বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। আমি দায়িত্বটা নিতে চাইছি না। কিন্তু মনোযোগ পেতে ভাল লাগছে। আমাকে যে কেউ চায়, এই বিষয়টা ভেবেই ফুরফুরে মনে দিন কেটে যাচ্ছে। তাই, আমার দায়িত্বহীনতায় কেউ বিরক্ত হয়ে সরে যেতে চাইলে তখন তাকে মিষ্টি কথায় ফিরিয়ে আনছি নিজের কাছে।
ডা. মুখোপাধ্যায় জানালেন, “বিহেভিয়োরাল সায়েন্সের পরিভাষায় একে বলা হয় ইন্টারমিটেন্ট রিইনফোর্সমেন্ট। জুয়া খেলায় সব সময় জেতা যায় না, কিন্তু জেতার মোহে বার বার খেলা হয়। সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এটা কাজ করে।”
পাশাপাশি তিনি আরও জানালেন, যদি এমন হয় যে দু’জনেই সিরিয়াস কোনও সম্পর্কে যেতে রাজি না হন, তাদের ক্ষেত্রে এই আছি, এই নেই সম্পর্ক খুব একটা ক্ষতি করে না। কিন্তু এক জন সম্পর্কে যেতে চান, আর এক জন ভান করছেন, সেখানে সম্পর্ক না এগোনোই ভাল।
‘ব্রেডক্রাম্বিংয়ের’ শিকার হলে কী ভাবে বুঝবেন?
দু’টি মানুষের মধ্যে এক জন হঠাৎ কাছে, হঠাৎ দূরে। অপর জন তার মনের তল বোঝে না। এই অপর জন যদি বিরক্ত হয়ে সরে আসতে চায়, সেটা টের পেয়ে কাছে-দূরের মানুষটি ভীষণ ভাল ব্যবহার করতে শুরু করে। কখনও ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং, কখনও গভীর অনুভূতির দোহাই দিয়ে আটকে রাখার চেষ্টা করে। সেই সময় হয়তো ‘মায়ের শরীর কেমন আছে’ জাতীয় প্রশ্ন করেও মন জয় করতে চায়। ফলে, অপর জনের বিরক্তি কমে আসে, সে মনে করে সব ঠিক আছে।
ব্রেডক্রাম্বিং কর্মক্ষেত্রে, পারিবারিক জীবন বা বন্ধুদের মধ্যেও দেখা যায়। কর্মক্ষেত্রে কেউ হয়তো বিরক্ত হয়ে চাকরি ছাড়ার কথা ভাবেন, সেই মুহূর্তে ফের প্রতিশ্রুতি, কিন্তু আদতে কিছুই হয় না। পরিবারে বা বন্ধুদের মধ্যেও প্রয়োজনের তাগিদে মধুর ব্যবহার, প্রচুর কথা বলা আর প্রয়োজন ফুরোলেই ‘চিনি না’ এই আচরণ বার বার দেখা যায়।
কী ভাবে সামলাবেন?
প্রিয় মানুষটির এই প্রবণতা দেখলেই প্রথমে নিজের কাছে স্পষ্ট হোন আপনি কী চান। তার পরে তাঁকে জিজ্ঞাসা করুন তিনি কী চান। তাতে কাজ না হলে, সম্পর্কটি থেকে সরে আসতে হবে। ভেঙে পড়লে আত্মবিশ্বাস ও মনোবল বাড়াতে মনোবিদের সাহায্য নিতে পারেন। যিনি ব্রেডক্রাম্বিং করছেন তাঁকেও বোঝানো প্রয়োজন, তিনি এই আছি-নেই-এর নেশায় মজে স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। তাঁরও আসলে কাউন্সেলিং প্রয়োজন। না হলে কাছে-দূরের খেলা থেকে বেরিয়ে, কখনও সুস্থ সম্পর্কের দায়িত্ব নিতে পারবেন না।
আর যিনি এ ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছেন, তাঁদের ব্রেডক্রাম্বিং জাতীয় সম্পর্ক থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ হল আত্মবিশ্বাস তথা সেলফ ওয়ার্থ সুদৃঢ় করা। সমাজমাধ্যমের দৌলতে এই প্রবণতা এখন বেড়েছে জেনারেশন জ়ি-র মধ্যে। জানা-অজানার ধোঁয়াশার মাঝের জায়গাতেই তৈরি হচ্ছে সম্পর্কের খুড়োর কল।
মনে রাখতে হবে
নিজের প্রয়োজনে সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করতে চান এমন মানুষকে প্রশ্রয় দেবেন না।
প্রেম-ভাললাগার পাশাপাশি "ব্রেডক্রাম্বিং" দেখা যায় কর্মক্ষেত্রে, বন্ধুদের মধ্যে, এমনকি পরিবারেও। তাই সব ক্ষেত্রেই সতর্ক থাকুন।
আর একটা জিনিসও বুঝতে হবে, আপনি নিজেই ব্রেডক্রাম্বিং করছেন না তো? করলে সেটা কেন করছেন? নিজেকে বোঝার জন্য প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করাতে পারেন।
মডেল: অভীপ্সা খন্না, দেবদীপ চট্টোপাধ্যায়, সোমরাজ মাইিতি, আয়ুশী তালুকদার; মেকআপ: অভিজিৎ কয়াল (অভীপ্সা, দেবদীপ); ছবি: অমিত দাস; লোকেশন: দ্য পার্ক হোটেল