ছবি: জয়দীপ মণ্ডল
মা কর্মরত হলে বাচ্চা যত্ন পায় না, এমন ভাবনাকে মনে স্থান দেবেন না। মায়ের কর্মজগৎও সন্তানকে অনুপ্রেরণা জোগায়। কাজগুলো পরিকল্পনা করে গুছিয়ে নিন। দু’দিকেই সময় পাবেন
পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকেই তো মায়েরা কর্মরত। কখনও তিনি বাড়িতে দিবারাত্র খেটে চলেছেন, কখনও বা ঘরে-বাইরে একসঙ্গে সামলে চলেছেন। তবে আধুনিক অর্থনীতিতে মায়েদের বাইরের কাজে অনেকটা সময়, শ্রম, মেধা দিতে হচ্ছে। তেমনই এক-একটা ছুটন্ত দিনের শেষে, একজন কর্মরত মা যখন বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেওয়ার অবকাশ পান, তাঁর দেহ-মনে অনেক সময়েই অপরাধবোধ ভারী হয়ে বসে। তাঁর মনে হয়, অফিসের কাজ করতে গিয়ে, হয়তো সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারলেন না। বিকেলে পার্কে দোলনা চাপার বায়না করেছিল মেয়েটা, সময়ে কাজ শেষ করে বেরোতে পারলেন না। কিংবা ছেলে অঙ্কে কম নম্বর পেল, বকতে গিয়ে মনে পড়ে, এই সমীকরণটা দু’বার বুঝিয়ে দিলে হয়তো এমনটা হত না। রিল্যাক্স করার জন্য সিনেমা দেখতে বসলেও মনে হয়, এটুকু সময় বাচ্চাটাকে দিলেই ভাল হত। এমন অজস্র অনুতাপের নুড়ি পাথরে বারবার ধাক্কা খেতে খেতে চলতে থাকে বহু কর্মরত মায়ের জীবন। ব্যাহত হয় তাঁদের জীবনের ছন্দ, স্বাভাবিক গতি। আবার বিপরীত উদ্বেগেও থমকে যান অনেকে। ‘সন্তানের যত্নে কেরিয়ারে পিছিয়ে পড়ছি না তো?’ এই হতাশাও গ্রাস করে। তবে বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, এই অপরাধবোধ আদতে সময় নষ্টেরই নামান্তর। এমনটা চলতে দিলে অবসাদ গ্রাস করতে পারে, নিজের জীবনের মান ক্ষুণ্ণ হতে পারে, তখন আখেরে সন্তানেরই ক্ষতি। অতএব আপনার চারপাশে এই পাপবোধের আঁধার গাঢ় হতে দেবেন না।
নিজের উপরে আস্থা থাকুক
এই অপরাধবোধ যদি আপনার মনে বার বার ফিরে আসে, তবে তা আপনার চরিত্রের কোনও খুঁত নয়, বরং আপনার সংবেদনশীলতাকেই ফুটিয়ে তোলে। এর অর্থ, সন্তানের ভাল-মন্দের দিকে যথেষ্ট খেয়াল আছে আপনার। সেই খেয়াল থাকলে, আপনি নিশ্চয়ই সাধ্যমতো ওর দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন। ফলে, নিজের উপরে ভরসা রাখুন। এই ভরসাই কর্মক্ষেত্র আর সন্তানপালন, দু’জায়গায় আপনার প্রাণশক্তি অনেক বাড়িয়ে দেবে।
সন্তানের সঙ্গে যে আপনি সারাক্ষণ থাকতে পারছেন না, তার জন্য আপনি দোষী নন। আপনার কাজের প্রকৃতি বা পরিস্থিতির জন্য আপনাকে কেরিয়ার ও সংসার-সন্তানের সঙ্গে সাম্য বজায় রেখে চলতে হচ্ছে। আর আপনি কেরিয়ারে মন দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছেন, তাতে তো প্রকারান্তরে সন্তানের ভবিষ্যৎটিই সুরক্ষিত থাকছে। উল্টো দিকে, এমনও তো দেখা যায় যে, সন্তান বা সংসারকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে নিজের শখ, জীবনের লক্ষ্য জলাঞ্জলি দিয়েছেন, এখন চরম অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছেন। এ রকম পরিবারে কিন্তু সন্তানলালনের উপযুক্ত পরিবেশ না-ও থাকতে পারে। আবার আপনি যদি কর্মক্ষেত্রে বা জীবন নিয়ে তৃপ্ত থাকেন, তবে সেই সুস্থ পরিবেশের সংস্পর্শ সন্তানও পাবে।
নিজেই নিজের নিয়ম বানান
আমি বোধহয় ‘খারাপ মা’— এমনটা মনে হচ্ছে কেন? আপনি কি কাউকে দেখে আদর্শ মাতৃত্বের কোনও ছবি মনে মনে এঁকে নিচ্ছেন এবং সেই ছবির সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারছেন না? তা হলে, আপনাকে বিশেষজ্ঞরা নিজের মতো করে মাতৃত্ব উপভোগের পরামর্শ দেবেন। আপনি কী করেন, কী ভাল লাগে, বাচ্চাদের পছন্দ ও প্রয়োজনীয়তা কী কী— সেগুলির উপরে ভিত্তি করে নিজেদের জীবনের নিয়ম নিজেরা স্থির করুন। স্থান, কাল, পাত্র ভেদে প্রতিটি মানুষ ও পরিবারের জীবনযাপনের প্রকৃতি ভিন্ন হয়। আলাদা ভাবে, আলাদা উপায়ে, নিজের শিক্ষা, সুবিধে ও বিবেচনাবোধ অনুযায়ী অভিভাবকেরা সন্তানকে বড় করে তোলেন। তার মানে এই নয় যে, একটি প্রক্রিয়ার চেয়ে অন্যটি ভাল বা মন্দ। কেউ কি তাঁর নিজের বা অন্যের সন্তানলালনের পাশাপাশি আপনার অভিভাবকত্বকে রেখে তুলনা করছেন? তার ফলে স্ট্রেস হলে, সেই মানুষটির সংস্পর্শ পরিহার করাই ভাল।
ছোটদের স্কুলজীবনে ছোটখাটো ওঠাপড়া লেগেই থাকবে। তার জন্য নিজেকে দায়ী না করে বৃহত্তর ফলাফলের দিকে তাকান। আপনি অফিসের তাড়াহুড়োর মধ্যে একদিন ওর স্কুলের একটা খাতা বা স্কেল দিতে ভুলে গেলে সন্তান একটু সমস্যায় পড়বে বটে। তার জন্য ও বাড়ি এসে মুখ ভার করলেও আজীবন তো এমনই থাকবে না। তেমনই আপনি কোনও বিষয় গুলিয়ে খাইয়ে দিতে পারেননি বলে ও যদি দু’-চার নম্বর কম পায়, তাতে তো ওর জীবনে বিরাট বদল কিছু আসবে না। বরং ও স্বাবলম্বী হতে শিখবে। নিজের স্কেল বা দরকারি খাতাটা পরের দিন নিজেই ব্যাগে ভরবে। ওর সঙ্গে নিজের সম্পর্কের বাঁধন মজবুত রাখুন। ওর প্রয়োজনের সময়ে সংবেদনশীল ভাবে পাশে থাকুন।
বাচ্চার শখ বা ভাল লাগার বিষয়ে আগ্রহ রাখুন। ওর সঙ্গে কথোপকথনের সুযোগ বাড়বে। বাড়ির কাজে বাচ্চাকেও শামিল করে নিন। এ ভাবে নিজেদের কাজের ফাঁকে সন্তানকে সঙ্গ দেওয়ার নানা উপায় খুঁজে নিতে হবে।
দরকারে সহায়তা চেয়ে নিন
জীবনটা একটু গুছিয়ে রাখুন। সন্তানের কখন কী প্রয়োজন— সব মাথায় রাখার বদলে নিজের কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের অর্গানাইজ়ারে লিখে, রিমাইন্ডার দিয়ে রাখুন। ভুলভ্রান্তি কম হবে। টু-ডু লিস্টের তো অ্যাপও মেলে। সেগুলি ডাউনলোড করা যায়।
অফিস, বাড়ি, সম্পর্ক, সর্বোপরি মাতৃত্ব সব একা সামলাতে গেলে কষ্ট হবে। হয়তো, অনেক সময়েই ত্রুটি থেকে যাবে। কিন্তু সব কাজেই কমবেশি ভুল-ত্রুটি তো থাকে। তাই তা মাথায় রাখবেন না। প্রয়োজনে মা-বাবা দু’জনে সন্তানের দায়িত্ব ভাগ করে নিন। কুণ্ঠা সরিয়ে, সহমর্মী মানুষদের কাছে সাহায্য চান। ঠাকুমা-দিদিমা থাকলে তাঁদেরও কিছু দায়িত্ব দিতে পারেন। তবে সন্তানপালনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে আপনাকে জুড়ে থাকতে হবে।
নিখুঁত বা আদর্শ মা বলে তো কিছু হয় না। ভাল মা হওয়া, সন্তানকে জীবনপথে ঠিক দিশা দেখিয়ে দেওয়াটাই লক্ষ্য। সমীক্ষা বলে, প্রকৃতপক্ষে কর্মরত মায়ের ইতিবাচক প্রভাব পড়ে সন্তানের জীবনে। ছোট থেকেই সে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ও চাহিদা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকে। স্বনির্ভর এবং আত্মবিশ্বাসী হয়। অতএব ‘সুপারমম’ হওয়ার দায়ভার সরিয়ে রাখুন। মাঝেমধ্যে গোটা দিন সন্তানকে দিন, আবার একটা দিন রাখুন নিজের বিলাসিতার জন্য। স্বাস্থ্যবিধি মেনে একটু ঘুরতে নিয়ে যান। ২৪ ঘণ্টা দেওয়ার বদলে সানন্দ সাহচর্যটুকু দিতে পারলেই ওরা বেশি খুশি ও উপকৃত হবে।
মডেল: সায়ন্তনী গুহঠাকুরতা
মেকআপ: সুমন গঙ্গোপাধ্যা