প্রতীকী ছবি।
‘নিউমোনিয়া’ শব্দটার সঙ্গে কম-বেশি আমরা সকলেই পরিচিত। ‘নিউমো’, অর্থাৎ ফুসফুস সংক্রান্ত। তাই ফুসফুসের সংক্রমণ, প্রদাহ প্রভৃতি নানা অসুখের ক্ষেত্রেই তার নামের আগে ‘নিউমো’ শব্দটা জুড়ে দেওয়া হয়। আমাদের ফুসফুসে বাতাস-ভর্তি অনেক পাউচ বা আলভিয়োলাই থাকে। সংক্রমণের কারণে যখন সেই পাউচে পুঁজ বা ফ্লুয়িড জমা হয়, তখন তারা স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে না। ফলে শরীরের ভিতরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছয় না। একেই সাধারণ ভাবে নিউমোনাইটিস বা নিউমোনিয়া বলে। আগে চেস্ট এক্স-রে করে রোগনির্ণয় করা হত। অ্যান্টিবায়োটিক, ফ্লুয়িড থেরাপি প্রভৃতির মাধ্যমে চিকিৎসকেরা তাকে সামাল দেওয়ার চেষ্টাও করতেন। কিন্তু অতিমারি পরিস্থিতিতে এই চেনা রোগের নামটাই যেন আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে অবধারিত ভাবে চলে আসে আইসিইউ, বাইপ্যাপ সাপোর্ট, একমো, ভেন্টিলেশনের মতো রাশভারী শব্দগুলো।
কোভিড নিউমোনিয়ার সঙ্গে সাধারণ নিউমোনিয়ার পার্থক্য
নিউমোনিয়া নানা ভাবে হতে পারে। কখনও ব্যাকটিরিয়া-জনিত কারণে, কখনও ভাইরাসের কারণে, আবার কখনও ফাঙ্গাস-জনিত কারণেও। কোভিড ১৯ ভাইরাসের কারণে যে নিউমোনিয়া, সেটাই কোভিড নিউমোনিয়া। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অরুণাংশু তালুকদার জানাচ্ছেন, কোভিড ১৯ ভাইরাস আমাদের শরীরের প্রায় প্রত্যেকটা অঙ্গকেই আক্রমণ করতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে শ্বাসনালির। শ্বাসনালির উপরের অংশটি আক্রান্ত হলে সর্দি-কাশি, জ্বর হয়। আর নীচের অংশ অর্থাৎ ফুসফুস যদি কোভিড ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হয়, তবে তাকে কোভিড নিউমোনিয়া বলা হবে।
সাধারণ নিউমোনিয়ার সঙ্গে কোভিড নিউমোনিয়ার মূল তফাত হল, নিউমোনিয়া সাধারণত ফুসফুসের একটা অংশকে সংক্রমিত করে। ফলে সেই জায়গাটি সাদা হয়ে যায়। কিন্তু কোভিডের মতো যে কোনও ভাইরাল নিউমোনিয়ায় ফুসফুসের নানা জায়গায়, এমনকি একই সঙ্গে দু’টি ফুসফুসের একাধিক অংশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। আবার সাধারণ নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে আলভিয়োলাই বেশি আক্রান্ত হয়। কিন্তু কোভিড নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে আলভিয়োলাই এবং রক্তনালির মাঝখানে যে পর্দা থাকে, সেই জায়গাটি আক্রান্ত হয়। সাধারণ নিউমোনিয়ায় বুকে কফ জমে। কাশির সঙ্গে সেই কফ বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু কোভিডে কফ প্রায় থাকে না বললেই চলে। এতে শুকনো কাশি দেখা যায়।
রোগলক্ষণ দেখে পার্থক্য
রোগী সাধারণ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত, না কোভিড নিউমোনিয়ায়— তা স্থির করবেন চিকিৎসকেরাই। তবে সাধারণ কিছু রোগলক্ষণও আছে। সাধারণ নিউমোনিয়ায় বেশি জ্বর এবং কাশির সঙ্গে কফ থাকবেই। বুকের যেখানে নিউমোনিয়া সংক্রমণ হয়েছে, সেখানে ব্যথা হতে পারে। কোভিড নিউমোনিয়ায় জ্বর হাল্কা থাকে অথবা না-ও থাকতে পারে। শুকনো কাশি থাকে। কিন্তু শ্বাসকষ্ট এবং অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা যায় দ্রুত। এর পর এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, রক্তপরীক্ষার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসেন চিকিৎসকেরা।
চিকিৎসা
ডা. তালুকদার জানাচ্ছেন, সাধারণ নিউমোনিয়ায় যেহেতু পুরো ফুসফুস আক্রান্ত হয় না, তাই অক্সিজেন চলাচলে খুব সমস্যা হয় না। কিন্তু কোভিড নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে ফুসফুসের নানা জায়গায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। যত বেশি জায়গা সংক্রমিত হবে, তত অক্সিজেন চলাচলে অসুবিধে হবে। ফলে অক্সিজেন থেরাপির প্রয়োজন পড়ে।
ডা. সুবীর মণ্ডলের মতে, রোগের তীব্রতা অনুযায়ী কোভিড নিউমোনিয়াকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়— মাইল্ড, মডারেট এবং সিভিয়ার। সিটিএসএস স্কোর দেখে চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেন, তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে, নাকি বাড়িতেই চিকিৎসা করা যাবে। ডা. মণ্ডল জানালেন, কোভিড যে হেতু ভাইরাস সংক্রমণে হয়, তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শুরুতেই অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না। ফলে রোগলক্ষণ দেখা দেওয়ার পর থেকে প্রথম পাঁচ দিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই পাঁচ দিনের ভিতরেই অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ দেওয়া প্রয়োজন। নয়তো পরে সেগুলির বেশির ভাগই আর কাজ করে না। সমস্যা হল, সেই সময়টা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। হালকা সর্দি, জ্বর প্রথম দিকে কেউ গুরুত্ব দেন না, অনেক সময়ে টেস্টও করান না। যখন চিকিৎসকের কাছে আসেন, তখন অ্যান্টি ভাইরাল দিয়েও লাভ হয় না। কিন্তু ব্যাকটিরিয়া-জনিত কারণে নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকে কাজ হয়।
তবে কোভিড নিউমোনিয়াতেও চিকিৎসকেরা অ্যান্টিবায়োটিক দেন। কারণ, কোভিড নিউমোনিয়ার ছ’ থেকে দশ দিনের মাথায় শরীরে ইনফ্ল্যামেটরি রিঅ্যাকশন শুরু হয়। ক্ষতিটাও সেই সময়েই হয়ে যায়। এ সময় শরীরে কিছু কেমিক্যাল তৈরি হতে থাকে। কোভিডের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হচ্ছে আরও একটা অন্য জায়গায়। অনেক ক্ষেত্রে এতে ফুসফুসের মধ্যে যে অতি সূক্ষ্ম রক্তবাহী ক্যাপিলারিগুলো থাকে, সেখানে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। এবং রোগের তীব্রতাও বেড়ে যায় অনেক গুণ। এই সময়ে সিটি স্ক্যান করলে বোঝা যায়, ক্ষতি কতটা জায়গা জুড়ে হয়েছে। তা দেখে পরবর্তী ধাপ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সেই সময়ে রোগীকে স্টেরয়েড দেওয়া হয় প্রদাহ কমানোর জন্য এবং ব্লাড থিনার দেওয়া হয়, যাতে রক্ত ক্যাপিলারিতে জমাট না বাঁধে। সুতরাং রোগ ধরা পড়লে প্রথমেই সিটি স্ক্যান করা বা স্টেরয়েড চালু করে দেওয়া কাম্য নয় বলেই ডা. মণ্ডল মনে করেন। পাঁচ-ছ’ দিন অপেক্ষা করার পরে অবস্থা বুঝে চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেবেন। নয়তো এতে উল্টো বিপত্তি হতে পারে।
প্রথমেই স্টেরয়েড নয় কেন
ডা. মণ্ডল জানাচ্ছেন, স্টেরয়েড শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। প্রথমেই স্টেরয়েড নিয়ে রোগ প্রতিরোধ কমিয়ে দিলে ভাইরাস শরীরে ঢোকার পরই অবাধে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে যায়। এতে ভাইরাসের রেপ্লিকেশন ফেজ় (প্রতিরূপ গঠন পর্ব অর্থাৎ একটা থেকে অনেক তৈরি হয়ে যাওয়া) দীর্ঘস্থায়ী হয়। তাই রোগীর অবস্থা বুঝে ছ’দিন পর থেকে চিকিৎসকেরা স্টেরয়েড প্রয়োগ করতে শুরু করলে ভাল ফল মেলে। এই সময় থেকেই অ্যান্টিবায়োটিকও শুরু করা উচিত, যাতে স্টেরয়েডের কারণে কমে যাওয়া রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সুযোগে অন্য কোনও জীবাণু ক্ষতি করতে না পারে।
ফ্লুয়িড থেরাপি
যে কোনও নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রেই ফ্লুয়িড থেরাপি চিকিৎসা পদ্ধতির অন্যতম অস্ত্র। ভাস্কুলার লাইনিং শুকিয়ে গেলে ক্ষতি আরও বাড়ে। তবে ফ্লুয়িডের একটা মাত্রা আছে। অতিরিক্ত ফ্লুয়িড শরীরে প্রবেশ করলে, তা ফুসফুসে জমে যেতে পারে। ফলে বিশেষ ধরনের ইকো করে দেখে নেওয়া হয় কতটা ফ্লুয়িড প্রয়োজন। সেই অনুযায়ী ঠিক করা হয় ফ্লুয়িডের মাত্রা।
কোমর্বিডিটির ক্ষেত্রে
ডা. তালুকদারের মতে, সাধারণ নিউমোনিয়া যে কোনও ব্যক্তির হতে পারে। তবে ডায়াবেটিক, কিডনির সমস্যায় ভুগছেন, ক্যানসার রোগী, প্রবীণদের মধ্যে নিউমোনিয়ায় ভোগার ভয় অনেক বেশি। কোভিডের ক্ষেত্রে কোমর্বিডিটি আছে, এমন রোগীদের অসুখ অনেক সময়েই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়। ডা. মণ্ডল জানালেন, অনিয়ন্ত্রিত ব্লাড সুগার থাকলে আরবিসি (রেড ব্লাড সেল) চটচটে হয়ে যায়। পুঁজও জমে তাড়াতাড়ি। যাঁদের সিওপিডি আছে, তাঁদের শরীরে এমনিতেই অক্সিজেন কম পৌঁছয়। কোভিড আক্রান্ত হলে তাঁদের অক্সিজেন মাত্রা আরও কমে যেতে পারে। আর ক্যানসার থাকলে যে ধরনের ওষুধ খেতে হয়, তাতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে চট করে কোভিড আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
তাই কোমর্বিডিটি আছে, এমন রোগীদের ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা শুরু করতে হবে। সাধারণ নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রেও, কোভিড নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রেও। নয়তো অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে বাঁচানো খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
মডেল: ঊষসী রায়
ছবি: শুভদীপ সামন্ত
মেকআপ: সুবীর মণ্ডল
লোকেশন: ক্লাব ভর্দে ভিস্তা