বিবি রাসেল। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
তিনি ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্টের আন্তর্জাতিক আইকন। বাঙালির নিত্য ব্যবহারের গামছাকে বিশ্বের দরবারে তিনি স্টাইল স্টেটমেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিয়াত্তরে পা দিয়েছেন বিবি রাসেল। এক নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে কলকাতায় এসেছিলেন তিনি। তার মাঝেই এক রবিবার বিকেলে কফির কাপ হাতে কথায় কথায় উঠে এল বিবির আগামীর পরিকল্পনা-সহ নানা খুঁটিনাটি।
বাংলাদেশের ভূমিকন্যা বিবির সঙ্গে কলকাতার প্রাণের টান। গামছা দিয়ে পোশাক বানিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন তিনি অনেক কাল আগে। কথার শুরুতে হেসে বললেন, “গামছা এখনও আমার বেস্ট সেলার। মানুষ যাতে নতুনত্বের স্বাদ পায় তাই প্রতি তিন মাস অন্তর গামছার রং, ডিজ়াইন, চেকস পরিবর্তন করি। স্পেনের রানি আমাকে বলে দিয়েছেন, পরের বার গামছার কালেকশন সঙ্গে নিয়ে যেতে।” কিন্তু তাঁর এই গামছাপ্রীতি তৈরি হল কী করে? “আমি বড় হয়েছি পুরনো ঢাকায়। সেখানে আমাদের মাছওয়ালা, সবজিওয়ালাদের কাঁধে রংবেরঙের গামছা ঝুলত। সেই থেকে গামছা ও তাঁতিদের প্রতি আমার আগ্রহ। বিদেশে গেলেও সব সময়ে দেশের তাঁতশিল্পের খোঁজ রাখতাম। তাঁদের সঙ্গে, তাঁদের জন্যে কাজ করতে চাইতাম।”
ফ্যাশন সবার জন্য
বিবির কাছে ফ্যাশনের অর্থ কী? তাঁর কথায়, “আমি মনে করি ফ্যাশন কোনও শ্রেণির জন্য নয়, বরং সবার জন্য। ফ্যাশন একজন মানুষের পরিচয়ের মতো। আমি বাঙালি নাকি ব্রিটিশ নাকি ফ্রেঞ্চ তার প্রমাণ দেয় আমার ল্যাঙ্গুয়েজ। কিন্তু পোশাক দিয়ে আমি নিজেকে যেমন ইচ্ছে সে ভাবে প্রকাশ করতে পারি। এর সঙ্গে সমাজের অর্থনীতিও জড়িত। তাই আমি বলি ‘উন্নয়নের জন্য ফ্যাশন’।” এখন সময়টা ‘ফাস্ট ফ্যাশন’-এর। মানুষ অনলাইনে কেনাকাটা করে। ডিজিটাল মিডিয়ার সঙ্গে এখনকার প্রজন্মের ঘনিষ্ঠ সংযোগ। ফলে বিশ্বের ফ্যাশন এখন হাতের মুঠোয়। সহমত বিবিও। “আমারও অনলাইন স্টোর। এর ফলে বিশ্বের যে কোনও প্রান্তের জিনিস অন্য প্রান্তের মানুষের হাতে পৌছয়। আর তাই আমি এখন এমন কিছু তৈরি করতে চাই, যা কমবয়সিদের মন কাড়বে, রোজকার ব্যবহারের উপযোগী হবে।”
পরিবেশ বান্ধব ফ্যাশন
ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্টের পর বিবি ‘রিসাইক্লিং ম্যাটার’ বা ফেলনা উপকরণ দিয়ে তৈরি হস্তশিল্পকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। খবরের কাগজ, চকলেট, চিপসের ফেলে দেওয়া প্যাকেট ইত্যাদি দিয়ে তিনি ব্যাগ, স্যান্ডল, চুড়ি, বাক্সসহ নানা রকম শোপিস তৈরি করেন। ইউরোপের দেশগুলোতে এর বিরাট চাহিদা রয়েছে। “আমার বাড়িতে পর্দার কাপড় হিসেবে গামছা ব্যবহার করি। পুরনো শাড়ির পাড়, একটার সঙ্গে অন্যটা জুড়ে বেডশিট বানাই। পরিবর্তিত জলবায়ুর যুগে এই রিসাইক্লিং যে কতটা জরুরি তা ইউরোপ ইতিমধ্যে বুঝেছে। আমাদেরও বুঝতে হবে।” পাশাপাশি বাংলাদেশে রিকশার পিছনে যে আর্ট থাকে, চুড়ি, গয়না, জুতো, ব্যাগ, টেবিল, চশমার ফ্রেম, জলের গ্লাসে সেই শিল্পকেও তুলে এনেছেন বিবি। সে দেশের ঐতিহ্যবাহী জামদানি, মসলিন পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি ভারতের রাজস্থানের প্রাচীন কোটা শাড়ি পুনরুদ্ধারেরও চেষ্টা করছেন তিনি।
আগামীর পরিকল্পনা
গামছা ও রিকশার পর এ বার তাঁর লক্ষ্য বাংলার ধনেখালি শাড়ি। “প্রথমে ভেবেছিলাম নদিয়া, ফুলিয়ার তাঁত নিয়ে কাজ করব। পরে দেখলাম ওরা বড্ড বেশি কমার্শিয়াল। তা ছাড়া ফুলিয়াতে এখন বেশির ভাগই পাওয়ারলুম হয়ে গিয়েছে। চেষ্টা করছি সেখানে যাতে তাঁত পুনরুজ্জীবিত হতে পারে, তাঁতিরা যাতে হাতে তাঁত চালাতে পারেন। তবে আমার মূল নজর এখন ধনেখালির দিকে। গামছার মতোই আমি ধনেখালিকেও বিশ্বের বাজারে তুলে ধরতে চাই, মানুষকে তাক লাগিয়ে দিতে চাই।” (চশমার আড়ালে বিবির চোখে তখন স্বপ্নের ঝলক) বললেন, “দশ বছর বয়সে বাবা প্রথম একটা সেলাই মেশিন কিনে দিয়েছিল। সেই থেকে শুরু করেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ আমার ফ্যাশন আইকন। ফ্যাশন নিয়ে দেখা আমার স্বপ্ন পূরণ করতে যাঁরা সাহায্য করেছেন, আমি যেন তাঁদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারি। সেটাই আমার আগামী দিনের পরিকল্পনা।”