অ্যাজ়মা বা হাঁপানিতে আক্রান্ত মানুষের কষ্ট বাড়ছে আরও বেশি
সদ্য শেষ হয়েছে দীপাবলি, ছট পুজোর আতশবাজির খেলা। বাতাস খানিক গরম থাকলেও সন্ধের দিকে গা ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছে অনেকেরই। তার উপরে রাত বাড়লে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ছাতিমের গন্ধও। আর এই মরসুমেই শ্বাস নেওয়াটা যেন কষ্টকর হয়ে ওঠে। বাড়তে থাকে টান। সঙ্গে কাশি, বুকে ব্যথা আর বিনিদ্র রাত্রিযাপন। কলকাতায় বাড়তে থাকা দূষণে অনেকেই শ্বাসকষ্টের সম্মুখীন হচ্ছেন। অ্যাজ়মা বা হাঁপানিতে আক্রান্ত মানুষের কষ্ট বাড়ছে আরও বেশি। কী ভাবে সুস্থ থাকবেন?
হাঁপানির সূত্রপাত
অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসকেরা বলেন যে, হাঁপানি জিনগত। পরিবারের কারও সমস্যা থাকলে, অ্যাজ়মা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায় অনেকখানি। কিন্তু ইদানীং কালের দূষিত পৃথিবীতে প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে অ্যাজ়মা আক্রান্তের সংখ্যা। সাধারণ ভাবে অ্যাজ়মা বাড়ে শ্বাসনালীর ইনফ্ল্যামেশনের ফলে। ফুসফুসে বাতাস ঢোকার পথগুলি এই রোগে সরু হয় ও ফুলে ওঠে। পাশাপাশি জমতে থাকে মিউকাস। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সাধারণ শ্বাসকষ্টই পরে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
লক্ষণ
প্রত্যেকটি মানুষের উপরে আলাদা আলাদা নির্ভর করে অ্যাজ়মা অ্যাটাক কখন হবে বা কতক্ষণ পরপর হবে। পালমোনোলজিস্ট ডা. রাজা ধর বলছেন, ‘‘অল্পেই হাঁপ ধরে যাওয়া, বুকে ব্যথা বা চাপ চাপ ভাব, শ্বাসকষ্টের জেরে রাতে না ঘুমোতে পারা, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাশি হওয়া, শ্বাস নেওয়া ও ছাড়ার সময়ে সাঁ সাঁ আওয়াজ হওয়া... এ সবই অ্যাজ়মার লক্ষণ।’’ কেউ অনবরত হাঁচতে থাকেন। কারও চোখ জ্বালা করে, জল পড়ে। হাঁপানির সমস্যায় কখনও আগে টান ওঠে, পরে অন্যান্য লক্ষণ দেখা দেয়। আবার ঠিক এর উল্টোটাও হতে পারে।
হাঁপানি বাড়ার কারণ
কোনও একটি কারণে হাঁপানি হয় না বা বাড়ে না। তার রয়েছে একাধিক কারণ। ফ্লু, নিউমোনিয়া জাতীয় শ্বাসযন্ত্রের কোনও রোগের ইতিহাস থাকলে হাঁপানি হতে পারে। আবার
কেমিক্যাল, ধোঁয়া, স্মোক, স্মগ, বিশেষ গন্ধ সহ্য করতে পারেন না অনেকেই। তা থেকেও হতে পারে শ্বাসকষ্ট। অনেককে পেশাগত কারণে কেমিক্যাল, ধুলো, ধোঁয়া, গ্যাসের মধ্যে থাকতে হয় সারা দিন। সে ক্ষেত্রে হাঁপানি হলে তাকে অকুপেশনাল অ্যাজ়মা বলে। অ্যালার্জি থেকে বা অ্যালার্জি ইনডিউসড অ্যাজ়মায় আক্রান্ত হন বহু মানুষ। বাতাসে থাকা পোলেন, ফুলের রেণু, পোকামাকড়, খাবারদাবার, ধুলো, পোষ্যের লোম ও স্যালাইভা, কোল্ড ড্রিঙ্ক... অ্যালার্জি হতে পারে নানা কিছু থেকে। প্রাথমিক ভাবে বোঝাও সম্ভব নয় হয়তো। কিন্তু অ্যালার্জির সমস্যা থেকেই টান, শ্বাসকষ্ট বাড়তে পারে। ফলে কার কীসে অ্যালার্জি, সেটা নির্ণয় করা প্রয়োজন। সেখান থেকেই শুরু হয় চিকিৎসা।
চিকিৎসা
হাঁপানি ধরে গেলে তার চিকিৎসা সাধারণত তিনটি ধাপে হয়— ব্রিদিং এক্সারসাইজ়, রেসকিউ বা ফার্স্ট এড ট্রিটমেন্ট এবং লং টার্ম অ্যাজ়মা কন্ট্রোল মেডিকেশন। চিকিৎসক সাধারণত ব্যক্তির বয়স, অ্যাটাকের ইতিহাস, অ্যালার্জির লক্ষণ ইত্যাদি জেনে, প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা করে, শুরু করেন চিকিৎসা।
ব্রিদিং এক্সারসাইজ়:
প্রত্যেক দিন অল্প সময় বার করে ব্রিদিং এক্সারসাইজ় করা জরুরি। এই ধরনের ব্যায়াম নিয়মিত অভ্যেস করলে ফুসফুসে বাতাস ঢোকা এবং বার করার পরিমাণ বাড়ে। ফলে ফুসফুস বা লাংসের ক্যাপাসিটি বাড়ে, অ্যাজ়মার আশঙ্কা কমে।
রেসকিউ বা ফার্স্ট এড ট্রিটমেন্ট:
অ্যাজ়মার টান ওঠার পরে বা কষ্ট বাড়লে এমন কিছু ওষুধ নেওয়ার প্রয়োজন হয়, যা সাময়িক ভাবে স্বস্তি দেয় রোগীকে। তখন হাঁপের টান কমে, আরাম লাগে। রেসকিউ ইনহেলার ও নেবুলাইজ়ারের মাধ্যমে ওষুধ সরাসরি ফুসফুসে প্রবেশ করে। ব্রঙ্কোডিলেটর আবার ফুসফুসের মাসল রিল্যাক্স করিয়ে কষ্ট কমাতে সাহায্য করে। কিছু অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধের মাধ্যমে ফুসফুসের ইনফ্ল্যামেশন কমানোর চেষ্টা করা হয়। এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই শ্বাস নিতে কষ্ট কম হয়।
লং টার্ম অ্যাজ়মা কন্ট্রোল মেডিকেশন:
এ ক্ষেত্রে সারা বছর বা বেশ কিছুটা সময় ধরে ইনহেলার ও নেবুলাইজ়ার চলতে থাকে।
ইনহেলারের ধরন
কখনও গুঁড়ো, কখনও আবার এরোসল... ইনহেলারের ওষুধ নানা রকমের হয়। প্রত্যেক ওষুধের কাজ আলাদা। ডা. ধর বলছেন, ‘‘রিলিভার ইনহেলার সাধারণত নীল রঙের হয়। বুকে সাঁ সাঁ শব্দ বা কাশি আরম্ভ হলেই এগুলো নিতে হয়। প্রিভেন্টার ইনহেলার বাদামি, লাল, কমলা... নানা রঙের হয়। এগুলো সাধারণত সকাল-সন্ধেয় নিতে হয়। শ্বাসকষ্টের সমস্যা না থাকলেও এগুলো নেওয়া জরুরি।’’ তবে কার কোন ইনহেলার দরকার, তা ঠিক করে দেবেন চিকিৎসক।
ইনহেলারে স্টেরয়েড থাকে?
প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টের মধ্যে ইনহেলারের কয়েকটি পাফ নিলে তাৎক্ষণিক আরাম মেলে। কিন্তু অনেকেরই ধারণা আছে, স্টেরয়েড থাকার কারণে ইনহেলার শরীরের ক্ষতি করে। পালমোনোলজিস্ট ডা. পার্থসারথি ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘ইনহেলারে অবশ্যই স্টেরয়েড থাকে। কিন্তু যে পরিমাণে স্টেরয়েড শরীরে ঢোকে ও ঢুকে শরীরের মধ্যে কিছুটা নষ্ট হয়ে অবশিষ্ট যা কাজে লাগে, তার পরিমাণ অত্যন্ত অল্প।’’
অবশ্যই মনে রাখা জরুরি
হাঁপানি সারানো যায় না। কিন্তু চেষ্টা করলেই তা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আর তার জন্য দরকার সচেতনতা।
• হাঁপানি থাকলে ঋতুবদলের সময়ে সচেতন হোন। পশুর লোমে অ্যালার্জি থাকলে, যত প্রিয় পোষ্যই হোক, তার কাছে না ঘেঁষা ভাল।
• যে খাবারে অ্যালার্জি আছে, তা বন্ধ করে দেওয়া উচিত অবিলম্বে। হয়তো একদিন চিংড়ি খেয়ে কোনও অসুস্থতার লক্ষণ দেখা গেল না, ফলে দ্বিতীয় বার চিংড়ি খেতেই পারেন— এ ধারণা একেবারে ভুল। আবার হয়তো ১২ বছর বয়সে চিংড়িতে অ্যালার্জি ছিল, ২১ বছরে এসে তাতে অ্যালার্জি না-ই থাকতে পারে। তখন মুসুর ডালে অ্যালার্জি হতে পারে। তাই প্রয়োজনে বারবার অ্যালার্জি টেস্ট করাতে হতে পারে।
• ঠান্ডা লাগার ধাত থাকলে গরম পোশাক, সোয়েটার, স্কার্ফ সঙ্গে রাখা দরকার। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে চাদর জড়িয়ে কাজ করলে ভাল। রাতে শোয়ার সময়ে কান, মাথা স্কার্ফে ঢেকে শোয়া দরকার।
• হঠাৎ গরম, হঠাৎ ঠান্ডা... এ রকম আবহাওয়ায় কষ্ট বাড়বেই। তবে স্কার্ফ জড়িয়ে রাখতে গিয়ে খেয়াল রাখবেন, যেন ঘাম না হয়। এতে হিতে বিপরীত হবে।
• হাঁপানি আক্রান্তরা সব সময়ে ব্যাগে ইনহেলার রাখুন।
• মাঝরাতে শ্বাসের টান বাড়লে অনেকে কফি বা চা খেতে পছন্দ করেন। এতে অল্প হলেও টান কমে। কিন্তু কারও কফি বা চায়ে সমস্যা থাকলে ঈষদুষ্ণ জলে সামান্য নুন ফেলে, সেটি পান করতে পারেন।
• অল্প সরষের তেল হাতের তালুতে নিয়ে কাউকে বুকে মাসাজ করতে বলতে পারেন।
শ্বাসকষ্টে সচেতন থাকা ছাড়া উপায় নেই। তাই শত অসুবিধে সত্ত্বেও নিজের খেয়াল রাখুন। তবেই সুস্থ থাকবেন। জব্দ হবে হাঁপানিও।
(মডেল: ডিম্পল আচার্য; ছবি: জয়দীপ মণ্ডল; মেকআপ: প্রিয়া গুপ্ত; পোশাক: আনোখি, ফোরাম লোকেশন: জিন্নি’স ক্যাফে, পাটুলি)