প্রাথমিক পর্যায়ে ডেঙ্গির জ্বর আর সাধারণ জ্বরের মধ্যে পার্থক্য করা মুশকিল। —ফাইল চিত্র।
চিন্তায় ফেলেছে ডেঙ্গি। এই রোগের প্রকোপ ক্রমশ বাড়ছে। ডেঙ্গিতে মারাও গিয়েছেন কয়েকজন। সেই তালিকায় আছে ছোটরাও। উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা। প্রশাসন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে ঠিকই। কিন্তু পাশাপাশি জেনে নেওয়া প্রয়োজন কী ভাবে মোকাবিলা করতে হবে ডেঙ্গির সঙ্গে।
সাধারণ জ্বরের সঙ্গে পার্থক্য
ডেঙ্গির জ্বর আর সাধারণ জ্বরের মধ্যে পার্থক্য করা মুশকিল, অন্তত প্রাথমিক পর্যায়ে। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর হওয়া বা ভাইরাল ফিভার হামেশাই হয়। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না অনেকেই। ধরে নেওয়া হয়, তিন চারদিনেই জ্বর সেরে যাবে। এখানেই ভুল হয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই ডেঙ্গি ধরা পড়ার পরে অসুস্থ মানুষটিকে (নাবালক হোক বা প্রাপ্তবয়স্ক) যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন অনেকটাই দেরি হয়ে যাচ্ছে। মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গি হয় ভাইরাসের কারণে। সাধারণ ভাইরাল ফিভারের লক্ষণের সঙ্গে এর পার্থক্য কম। এই ব্যাপারে আলোকপাত করলেন শিশু রোগবিশেষজ্ঞ ডা. দিব্যেন্দু রায়চৌধুরী, ‘‘ডেঙ্গি হলে জ্বরের সঙ্গে মাথাব্যথা, বমি, পেটব্যথা, স্বাভাবিকের চেয়ে কম ইউরিন পাস এই লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। গায়ে র্যাশ বেরতে পারে। সাধারণ ভাইরাল জ্বরেও মাথাব্যথা, বমি হয়। সচেতন হবেন, যদি বাচ্চা দীর্ঘক্ষণ ইউরিন পাস না করে। এই সময়ের ডেঙ্গির প্রকোপ বেড়েছে তাই যে কোনও জ্বরেই সাবধান। তৎপরতার সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে বা রক্ত পরীক্ষা এনএস-১ এলাইজা টেস্ট করাতে পারেন। বাড়িতে রেখে ‘আরও দু-তিনদিন দেখি’ এটা এখন না করাই ভাল। কারণ যদি ডেঙ্গি হয়, ফেলে রাখলে পরিণতি খারাপ হতে পারে। যত তাড়াতাড়ি ডেঙ্গি নির্ধারণ করা যাবে তত তাড়াতাড়ি আক্রান্তকে সারিয়ে তোলা সম্ভব।’’
অনেকেরই ধারণা ডেঙ্গি হলে শরীরে তাপমাত্রা বেশ বেড়ে যায়, তা সবসময় হয় না। আরও একটি ধারণা, ডেঙ্গি হলেই প্লেটলেট কমে যায়। ‘‘না সবসময়েই তা নয়। প্লেটলেট যদি ১০ হাজারের নীচে নেমে যায় বা হেমারেজিক ডেঙ্গির জন্য রক্তক্ষরণ হয় তবেই প্লেটলেট দেওয়া হয়,’’ বললেন ডা. রায়চৌধুরী। প্রাপ্তবয়স্করা তাঁদের সমস্যা যতটা প্রকাশ করতে পারেন ছোটরা পারে না। ‘‘বাচ্চার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে কিনা, সে ঝিমিয়ে পড়ছে কিনা বা অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে কিনা, খেয়াল রাখতে হবে। ডেঙ্গি হলে রক্তচাপ কমে যেতে পারে, যা যথেষ্ট চিন্তার,’’ সর্তক করলেন ডা. রায়চৌধুরী।
হাতের কাছে ডাক্তার না পেলে
পরিস্থিতি এমন হতেই পারে যে বাচ্চার জ্বর হয়েছে কিন্তু চিকিৎসকের কাছে তখনই পৌঁছনো যাচ্ছে না বা বাড়ির কাছে হাসপাতাল নেই। কী করণীয়? ‘‘প্রচুর পরিমাণে জল খাওয়াতে থাকবেন। শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে হবে। শুধু জল নয়, ওআরএস, ফলের রস ইত্যাদি দেবেন। প্রয়োজনে জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল দিন। কিন্তু কখনও আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ দেবেন না,’’ পরামর্শ দিলেন ডা. রায়চৌধুরী। এই পরিস্থিতিতে প্যানিক না করে জ্বরের ওঠানামা এবং জ্বরের সঙ্গে অন্যান্য লক্ষণগুলি এক জায়গায় লিখে রাখুন।ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে তথ্যগুলি পেলে চিকিৎসা করতে সুবিধে হবে।
পথ্য
পথ্যে রাখতে হবে প্রচুর পরিমাণে জল, ফলের রস, ওআরএস, নানা ধরনের ফল, প্রোটিন জাতীয় খাবার। এই সময় শরীর দুর্বল থাকে, হজম ক্ষমতাও দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই রান্না হবে কম তেল-মশলা দিয়ে। যাতে পেটের সমস্যা না হয়। বারে বারে জল বাচ্চারা খেতে চাইবে না, তাই নানা ধরনের ফলের রস করে খাওয়াতে হবে। ‘‘আমরা বলি মা হলেন প্রথম ডাক্তার। তিনি সবচেয়ে ভাল জানেন তাঁর বাচ্চা কখন, কী, কতটা পরিমাণে খাবে। কতটা সে হজম করতে পারবে। তাই মাকে বুঝে সন্তানকে খাওয়াতে হবে। অন্যের বাচ্চা ডেঙ্গিতে কী খেল, কখন খেল, সেটা অনুকরণ করতে যাবেন না। প্রত্যেক বাচ্চার খাওয়া ও হজম করার ক্ষমতা আলাদা। অল্প অল্প করে খাওয়ান। একবারে ঠেসে ধরে খাওয়াবে না, এতে বমি হয়ে যেতে পারে। বারে বারে জল খাওয়াবেন,’’ বললেন ডা. রায়চৌধুরী।
জ্বরমুক্ত হলেই স্কুলে নয়
‘স্কুলে যাওয়া মিস করা যাবে না, পরীক্ষা দিতেই হবে, ঠিক সময়ে প্রজেক্ট জমা দেওয়া না হলে নম্বর কমে যাবে, সন্তান পিছিয়ে পড়বে!’ এই মানসিকতার আশু বদল প্রয়োজন। জ্বরমুক্ত হলেই তড়িঘড়ি বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানোর আগে একটু ভাবুন। ডেঙ্গি থেকে সেরে উঠলেই কি বাচ্চা শারীরিক ভাবে সক্ষম? ‘‘সন্তান যখন অসুস্থ হওয়ার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে তখনই তাকে স্কুলে পাঠান। তার আগে নয়। ধরুন, ডেঙ্গি নয়, সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে। তিন চারদিনে জ্বর কমতেই তাকে পাঠানো হল স্কুলে। সে তখনও বেশ দুর্বল, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়েছে। এই সময় আবার সংক্রামিত হওয়ার ভয় থাকে। তখনই আর ইনফ্লুয়েঞ্জা হবে না ঠিকই, দেখা গেল অ্যাডিনো ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গেল বা সহজেই ডেঙ্গি দ্বারা আক্রান্ত হল। পরপর অসুখে পড়লে শরীর ক্রমশ দুর্বল হবে এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমবে। তাছাড়া ডেঙ্গির জ্বর কমে যাওয়ার পরও চার-পাঁচ দিন কিন্তু বিপদের সম্ভাবনা থাকে,’’ উত্তরে বললেন ডা. রায়চৌধুরী।
ডেঙ্গি থেকে বাঁচতে
ডেঙ্গি মানেই মৃত্যুর ডঙ্কা নয়। অযথা প্যানিক করে বাচ্চাদের ঘরে আটকে রাখবেন না। তাদের বাইরে পাঠানোর আগে ফুলহাতা জামা-প্যান্ট পরান। মসকিউটো রেপেল্যান্ট রোল বা মশানাশক ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার করতে পারেন। বাচ্চাকে এমন জায়গায় পাঠাবেন না, যেখানে মশার কামড় খাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ভীত হবেন না, সচেতন হন। সচেতনতাই হারিয়ে দেবে ডেঙ্গিকে।