অতিমারির মাঝে বাড়িতে বন্দি হয়ে অনেকেই আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরছেন মোবাইল। মানসিক অবসাদ কাটাতে অনলাইন চ্যাট, ভিডিয়ো গেমস বা ওয়েবসিরিজ়ের মধ্যে নিজেদের ব্যস্ত রাখছেন। আবার যাঁরা চাকরি করছেন বা বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত, কনফারেন্স কল, অডিয়ো-ভিডিয়ো কল তাঁদের এখন সব সময়ের সঙ্গী। ব্যবসা ধরে রাখতেও অনেকেই ভরসা রাখছেন ভার্চুয়াল জগতে। নিউ নর্মাল লাইফে কানের কাজ বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।
বছর সাতেকের শিশুটির সঙ্গেও জড়িয়ে গিয়েছে মোবাইল-ল্যাপটপ। পড়ুয়াদের অনলাইন ক্লাসেই শিখতে হচ্ছে নতুন জীবনে চলার ছন্দ।
এত বেশি ফোনের ব্যবহার বাড়িয়ে তুলছে কানের সমস্যা। নতুন অভ্যেসে অনেকেই কানে ভাল করে শুনতে পাচ্ছেন না বা কম শুনছেন। কারও আবার খুব কাছের শব্দকে দূরের মনে হচ্ছে। কেউ কানের পাশে কেমন একটা ভোঁ ভোঁ বা শোঁ শোঁ শব্দ শুনছেন কখনও। কান ব্যথাও করছে অনেকের। সাবধান হওয়ার সময় এসে গিয়েছে। দীর্ঘ সময় হেডফোন কানে গুঁজে রেখে, ল্যাপটপ, মোবাইল ব্যবহারের ফল মারাত্মক হতে পারে, জানালেন ইএনটি বিশেষজ্ঞ ডা. দীপঙ্কর দত্ত। তাঁর মতে, ‘‘কান নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। অতিরিক্ত কথা বললে মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রেডিয়েশনের প্রভাবে কম বয়সেই হ্রাস পেতে পারে শ্রবণশক্তি। চলে আসতে পারে সাময়িক বধিরতা, যা স্থায়ীও হতে পারে। মস্তিষ্কের নানা সমস্যাও দেখা দিতে পারে। খিটখিটে মেজাজ, ঘুমের ব্যাঘাত বা শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পিছনেও দায়ী কানের নানা সমস্যা।’’
এ ছাড়াও মোবাইল ব্যবহারের সময়ে শব্দ যেহেতু মাইক্রোওয়েভের মাধ্যমে কানে পৌঁঁঁছয়, তাই তা সরাসরি আঘাত করতে পারে মস্তিষ্কের কোষে। ফলে তার থেকেও মাথা যন্ত্রণা ও অন্যান্য সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু মোবাইলের কুফল থাকলেও, তাকে ছাড়া এখন জীবন অচল। তাই কী ভাবে মোবাইলকে সঙ্গে নিয়ে চলবেন? জানতে হবে ঠিক ব্যবহার বিধি। ডা. দত্তের মতে, ‘‘সতর্ক ভাবে মোবাইল ব্যবহারের পরেও কানের সমস্যা রয়ে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’’
ব্যবহারবিধি
• বেশি সময় ধরে কথা বললে, গোপনীয়তা বজায় রাখার প্রয়োজন না হলে লাউডস্পিকারে কথা বলুন। অডিয়োর চেয়ে ভিডিয়ো কলে লাউডস্পিকারে কথা বলুন। সরাসরি কানের সঙ্গে যোগ থাকবে না। পড়ুয়াদের জন্য এই সর্তকতা জরুরি।
• বড় ইয়ারপ্যাডযুক্ত হেডফোন (রেকর্ডিং) ব্যবহার করতে হবে। ইয়ারপ্লাগ নয়। খুব ভাল মানের হেডফোনে শব্দদূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে বলে, এটি ব্যবহারে শ্রবণশক্তি হ্রাসের আশঙ্কা কমে।
• বেশির ভাগ হেডফোন এয়ার টাইট অর্থাৎ কানে বাতাস প্রবেশ করতে পারে না। ফলে ঝুঁকি থেকেই যায়। বাতাস চলাচল করতে পারে, এমন হেডফোন ব্যবহার করুন।
• এক মিটারের দূরত্ব থেকে হেডফোনের কথাবার্তা শুনতে পাওয়া যায়, সেই হেডফোন ব্যবহার করবেন না। আবার বাইরের আওয়াজ না ঢোকে হেডফোনে, সেটাও দেখতে হবে।
• হেডফোন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেয়ার না করাই ভাল। এতে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
• অল্প আলোয় অনেক দিন ধরে পড়লে যেমন চোখের ক্ষতি হয়, ঠিক তেমনই মোবাইলে কথা ভাল শোনা না গেলে বা কাটাকাটা কথা শোনা গেলেও কানের স্নায়ুর উপরে চাপ পড়ে। কথা বলতে বলতে কল ড্রপ হলে, কথা ভাল শোনা না গেলে অপরপক্ষকে জানিয়ে তখনই ফোন কেটে দিন। ফোন রিস্টার্ট করে আবার কল করে কথা শুরু করুন।
• এক কানে ফোন বেশিক্ষণ না রেখে, অদলবদল করুন।
• মোবাইলের চার্জ শেষের দিকে গেলে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি। মোবাইল বা ল্যাপটপে চার্জ চলাকালীন কথা বলা এড়িয়ে চলুন।
• কন-কল বা অনলাইন ক্লাস শুরুর আগে সম্পূর্ণ চার্জ দিন ডিভাইসে।
• দীর্ঘক্ষণ ফোনে কথা বলার সময়ে আমাদের মাথা-কানের অংশটা গরম হয়ে যায়। তাই একটি ক্লাসের পর বা সিরিজ় দেখার সময়ে ও কন-কলের মাঝে অবশ্যই ব্রেক নিন।
সমস্যা যখন জটিল
ব্যবহার বিধি মেনে চলার পরেও যদি মনে হয় কানে শুনতে সমস্যা হচ্ছে, তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডা. দত্ত বলছেন, ‘‘সমস্যা জটিল আকার নিলে, একদিকের কানে শ্রবণশক্তি চলে যাওয়ার লক্ষণ কানের স্ট্রোক। এমন হলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ট্রিটমেন্ট শুরু না করলে সারাজীবনের জন্য শ্রবণশক্তি হারানোর ভয়ও রয়েছে।’’
যে কোনও অসুখের ক্ষেত্রেই ঠিক সময়ে যেমন চিকিৎসা দরকার, কানেরও তাই। দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলোকে অবহেলা করবেন না। সতর্ক হয়ে, চিকিৎসা করে মোবাইলকে সঙ্গে নিয়েই খুঁজে নিন নতুন জীবনের দিশা।