ফুলঝুড়ি, তুবড়ি সবই কি সবুজ বাজি? ছবি: সংগৃহীত।
প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে কালীপুজোর। সেজে উঠেছে কলকাতা-সহ রাজ্যের সব বাজি বাজার। আলোর উৎসবে ছাড়পত্র শুধুই সবুজ বাজিতে।
কিন্তু কী এই সবুজ বাজি? আদৌ পরিবেশবান্ধব কি? কেউ মনে করেন, এই বাজি থেকে সবুজ ধোঁয়া বার হয়। কেউ ভাবেন, এই বাজির বাক্সটি বুঝি সবুজ। আসলে তাই কি!
সবুজ বাজি
কেন্দ্রের ‘ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ (নিরি)-র ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সবুজ বাজি দূষণের মাত্রা ৩০ শতাংশ হ্রাস করতে পারে। এ এক এমন বাজি, যেখানে ক্ষতিকর রাসায়নিকের মাত্রা কম থাকে। বাদ যায় দূষণ সৃষ্টিকারী বেরিয়াম নামক যৌগটি।
নিরি বলছে, সবুজ বাজির লক্ষ্য, তা থেকে নির্গত দূষণ সৃষ্টিকারী সালফার ডাই-অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের মতো বিভিন্ন উপাদানের মাত্রা হ্রাস করা। সে কারণেই বাজি তৈরির উপকরণে এবং মাত্রাতেও বদল আনা হয়েছে।
কলকাতা ময়দানের বাজি বাজারে রকমারি বাজি। বিক্রেতাদের দাবি, সবই সবুজ বাজি। —নিজস্ব চিত্র।
বাজি মানে আলোর খেলা। কোনওটি আবার শব্দ, আলো দুই-ই উৎপাদনে সক্ষম। বাজি দেখতে যতই ভাল লাগুক না কেন, তা থেকে যে ধোঁয়া, গ্যাস উৎপন্ন হয়, তা শুধু পরিবেশ নয় স্বাস্থ্যের পক্ষেও ক্ষতিকর।
সেই ক্ষতির পরিমাণ কমাতেই বেরিয়াম নামক যৌগটি বাদ পড়েছে সবুজ বাজি থেকে। সাধারণ বাজিতে ব্যবহৃত বেরিয়াম মোনোক্লোরাইড, বেরিয়াম নাইট্রেট ও বেরিয়াম ক্লোরেট আদতে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ আর বায়ুদূষণের কারণ হয়। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সবুজ বাজি থেকে অ্যালুমিনিয়ামের মাত্রাও কমিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে।
বাজিতে রকমারি
তিন ধরনের সবুজ বাজি রয়েছে—
সোয়াস (সেফ ওয়াটার রিলিজার): এই ধরনের বাজি থেকে নির্গত জলীয় বাষ্প বাতাসে দূষণসৃষ্টিকারী সালফার এবং নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা হ্রাসে সাহায্য করে।
স্টার (সেফ থার্মাইট ক্র্যাকার): এই ধরনের বাজি থেকে বাদ পড়ে পটাশিয়াম নাইট্রেট এবং সালফার। শুধু দূষণসৃষ্টিকারী উপদান হ্রাসেই নয়, শব্দের তীব্রতাও এতে কমে।
সফল (সেফ মিনিমাল অ্যালুমিনিয়াম): বেশ কিছু বাজিতে শব্দের মাত্রা কমাতে অ্যালুমিনিয়াম কমিয়ে ম্যাগেনেশিয়ামের মাত্রা বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেগুলিকেই এই তালিকায় ফেলা হচ্ছে।
সত্যি কি পরিবেশবান্ধব?
সবুজ বাজিকে বলা হচ্ছে পরিবেশবান্ধব। কিন্তু প্রকৃত পক্ষেই কি তা পরিবেশের বন্ধু হয়ে উঠছে? দূষণ নিয়ে কাজ করা পরিবেশকর্মীদের সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’। এই মঞ্চ পরিবেশ দূষণ রুখতে দীর্ঘদিন ধরে বাজি বন্ধ করার পক্ষে লড়াই করে আসছে। ‘সবুজ মঞ্চ’-এর সাধারণ সম্পাদক নব দত্ত বলছেন, ‘‘সবুজ বাজি তো পুরোপুরি দূষণমুক্ত নয়। তা দূষণের মাত্রা ৩০ শতাংশ কমাতে পারে মাত্র। বাকি ৭০ শতাংশ দূষণ কি কম? এই যে এত বাজি ফাটছে, তাতে পরিবেশ শুধু নয়, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হচ্ছে।’’
তবে পরিবেশবিদেরা বাজি বন্ধের কথা বললেও, কালীপুজোর সঙ্গে তার যোগ দীর্ঘদিনের। পরিবেশের কথা মাথায় রেখেই সুপ্রিম কোর্ট এবং পরিবেশ আদালত সবুজ বাজিকে ছাড়পত্র দিয়েছে। কিন্তু কোনটি সবুজ বাজি, কোনটি নয়, তা বুঝবেন কী করে?
সবুজ বাজি চেনার উপায়
কোনও বাজি সবুজ কি না, তার স্বীকৃতি দিতে পারে একমাত্র কেন্দ্রীয় সংস্থা নিরি। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, প্রতিটি বাজির উপর কেন্দ্রীয় সংস্থা সিএসআইআর-নিরির লোগো এবং কিউআর কোড থাকা বাধ্যতামূলক। বাজির প্যাকেটে থাকা কিউআর কোড নিরির অ্যাপ-স্ক্যানারের সাহায্যে স্ক্যান করলেই দেখতে পাওয়ার কথা বাজি সংক্রান্ত নিরির ছাড়পত্র। বাজিটি কোন উপাদানে তৈরি, সেটিও সেখানে থাকার কথা।
কিউ আর কােড স্ক্যান করলে এমনটাই দেখা যাওয়ার কথা। ছবি: সংগৃহীত।
কিউআর কোড স্ক্যান করে যদি যথাযথ সার্টিফিকেট না মেলে, তা হলে কী করণীয়? সবুজ মঞ্চের নব দত্ত বলছেন, ‘‘সবুজ বাজি নিয়ে সন্দেহ হলে পুলিশের কাছে বা রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদে অভিযোগ করতে পারেন।’’
সবুজ বাজি মিলবে কোথায়?
কলকাতা–সহ রাজ্য জুড়েই প্রতি বছর বাজির অসংখ্য বাজার বসে। সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান বাবলা রায় জানাচ্ছেন, এ বছর রাজ্য জুড়ে ১০২টি অনুমোদনপ্রাপ্ত বাজি বাজার বসেছে। তার মধ্যে কলকাতায় রয়েছে চারটি কালীকাপুর, টালা, বেহালা এবং ময়দানে।
এখানে সব বাজি কি সবুজ বাজি? বাবলা জানাচ্ছেন, নিরির নির্দেশিকা মেনেই বাজির বাক্সে লোগো, স্ক্যানার থাকছে। সেখানেই স্ক্যান করে যে কেউ বাজি যাচাই করে নিতে পারবেন। এ বছর ১৮ হাজার বাজি বিক্রেতা লাইসেন্স পেয়েছেন। সকাল ১০টা থেকে রাত ১০ পর্যন্ত খোলা থাকছে বাজি বাজার।
ময়দানের বাজি বাজারে এসেছে নতুন ধরনের আলোর বাজি। —ছবি সংগৃহীত
কলকাতার অন্যতম বড় পাইকারি এবং খুচরো বাজি বাজারটি বসে ময়দানে। কালীপুজোর তিন দিন আগে সেখানে গিয়ে দেখা গেল শহিদ মিনারের কাছে মাঠ ঘিরে পরপর স্টল। সব ক’টি যে ভীষণ সেজে উঠেছে তা নয়, তবে কেনাবেচা শুরু হয়েছে।
ফুলঝু়ড়ি, চড়কা, তুবড়ি-সহ হরেক বাজি রয়েছে তবে তাদের খোলনোলচে বদলে গিয়েছে। রকমারি নাম, ঝাঁ চকচকে ছবি, দেখতেও আলাদা। এসেছে নতুন অনেক বাজি। ‘ডাইনোসোর’, ‘বাবল’, ‘ডাক’ রকমারি তার নামকরণ। প্রায় প্রতিটি বাক্সের উপরেই চোখে পড়ে নিরির লোগো এবং কিউ আর কোড। মোবাইলের গুগ্ল প্লে স্টোর থেকে একটি স্ক্যানার অ্যাপ ডাউনলোড করে তা দিয়ে একটি বাজি স্ক্যান করতেই পাওয়া গেল নিরির সার্টিফিকেট। আরও একটি দোকানে নতুন ধরনের একটি বাজির বাক্সে কিউআর কোড স্ক্যান করেও সার্টিফিকেট মিলল। নিরির নাম থাকলেও, অবশ্য দু’টি সার্টিফিকেট দেখতে ছিল আলাদা।
সবুজ বাজি নিয়ে প্রশ্ন করায় এক ব্যবসায়ী সুদীপ আগরওয়াল জানালেন, শিবকাশী থেকে তাঁরা বাজি এনেছেন। তাঁর দোকানের সব বাজি সবুজ বাজি। তবে অন্য দোকানের আর এক বাজি বিক্রেতা সুদীপ্ত পাল বললেন, ‘‘আমরা অন্য জায়গা থেকে কিনে বাজি বিক্রি করি। শিবকাশী থেকেই মালপত্র আসে। নিরির নির্দেশিকাও জানি। কিন্তু কোনও বাজির বাক্স স্ক্যান করে যদি উপযুক্ত সার্টিফিকেট না মেলে, তা হলে আমরাই বা কী করব? আমরা তো বাজি বানাচ্ছি না। তবে যাঁদের থেকে কিনছি, তাঁদের এ বিষয়ে সতর্ক করছি।’’
রকমারি আতশবাজি ময়দানের বাজারে। —নিজস্ব চিত্র।
সবুজ ছাড়া অন্য বাজি বিক্রির ছাড়পত্র নেই। কিন্তু সবুজ বাজির জন্য দাম কি বেড়েছে? বাবলা সরকার বলছেন, ‘‘রাসায়নিকের বদল, বাজি তৈরির ক্ষেত্রে যে ধরনের উপকরণ ব্যবহার হচ্ছে, তাতে ২-৩ শতাংশ দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।’’ তবে বিক্রেতারা তেমন কিছু বললেন না। তাঁদের কথায়, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, বাজির নয় কেন? তবে সেই ভাবে এক ধাক্কায় অনেকটা দাম বাড়েনি বলেই জানাচ্ছেন তাঁরা।
এই বছর বাজি বাজার কেমন? ডেনার দাপটে বাজার কিছুটা মার খেয়েছে মানছেন সকল বাজি বিক্রেতাই। মাঠে জল থাকায়, দোকান বসাতেই সময় লেগে গিয়েছে। তবে ধীরে ধীরে লোকজন আসছেন। ব্যবসা নিয়ে আশাবাদী তাঁরা।