‘লোকে কী বলবে’-র বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রতি সোমবারের মতো এ বারও ছিলেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।
দীপাবলির রোশনাইয়ে ভরে উঠেছে চারপাশ। আলোকিত প্রতিটি কোণ। আলোর উৎসবের এই আবহে ‘লোকে কী বলবে’-র বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রতি সোমবারের মতো এ বারও ছিলেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে কোনও সমস্যার জট খুলতে নয়। দীপাবলির আড্ডা দিতে। আড্ডা তো আর একা একা হয় না। ‘লোকে কী বলবে’-র বিশেষ পর্ব ‘উৎসারিত আলো’-এ অনুত্তমার সঙ্গী ছিলেন লেখক সৌভিক গুহসরকার এবং নৃত্যশিল্পী ও লেখিকা মধুবনী চট্টোপাধ্যায়।
জীবনের প্রতিটি বাঁকে সব সময়ে আলোর দেখা মেলে না। অন্ধকারও দাঁড়িয়ে। সেই আঁধারেও ডুব দিতে হয় কখনও। সেই নিকষ কালো সময়ে আলোর অন্বেষণ কী ভাবে চলে? আড্ডার শুরুতে মধুবনীর কাছে প্রশ্ন রাখলেন অনুত্তমা। মধুবনীর কথায়, ‘‘আমার ভীষণ ভাবে মনে হয় অন্ধকার না থাকলে আলোর প্রকাশ নেই। দিনের আলোয় আতসবাজির রং চোখে ধরা পড়ে না। তার জন্য চাই অন্ধকারের প্রেক্ষাপট। আর জীবন তো অন্ধকারের চাদর বিছিয়ে রাখবেই। এটাই তার ধর্ম। আর আমরা সেই অন্ধকারের গায়ে আলো বুনে চলি। আমি অন্ধকারও ভালবাসি। আঁধার না থাকলে আলোই বা কেমন করে থাকবে? খুব বেশি আলোয় সব কিছু যেন প্রকট হয়ে ওঠে। আলো-আঁধারের বড় প্রয়োজন হয়। ধূসরতা কিন্তু এড়িয়ে চলার জিনিস নয়। আমি সেই ধূসরতাটা খুঁজে বেড়াই। তাতে হয়তো আমাকে দুঃখবিলাসী মনে হতে পারে। সব দুঃখ আসলে বিষাদের গহ্বরে নিয়ে যায় না। কিছু দুঃখ আনন্দও দেয়। আঁধারের মাঝে আলো খুঁজে বেড়ানোটাই আসলে জীবন।’’
সৌভিকের কাছেও একই প্রশ্ন রাখলেন মনোবিদ অনুত্তমা। সৌভিকের কথায়,‘‘আমার খুব ভাল লাগে রাত্রির আকাশ। মহাকাশ আমাকে ছোটবেলা থেকেই টানত। নক্ষত্রপুঞ্জ, বিশাল, বিপুল ব্রহ্মাণ্ড দেখতে গিয়ে একটা জিনিস খুব চোখে পড়ে। মহাশূন্য পুরোটা কালো। অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যে নক্ষত্রপুঞ্জগুলি জ্বলে উঠছে। প্রতি বার আমার এটা দেখতে দেখতে মনে হয়েছে এটাই পৃথিবী। এখান থেকে আমরা এসেছি। অন্ধকার আর আলোর যে অনুপাত এখানে রয়েছে। আমাদের জীবনেও তা-ই। মহাশূন্যটা বড়। সেখানে কিছুটা অংশ জুড়ে নক্ষত্রের বাস। বেশির ভাগটাই তো অন্ধকারে ঢাকা। প্রাকৃতিক ভাবে অন্ধকারের পরিমাণ সব সময়ে বেশি। তবে আলো জ্বালানোর মধ্যে একটা পরিশ্রম রয়েছে। আলো এমনি জ্বলবে না। তাকে জ্বালাতে হবে।’’
একই সুর অনুত্তমার গলাতেও। তিনি বলেন, ‘‘অন্ধকার পছন্দ মানেই দুঃখবিলাসিতা নয়। বিষাদ আসে যখন, আমরা অনেক সময় দুঃখবিলাসী বলে দাগিয়ে দিই। সেই দাগিয়ে দেওয়া আমি বিশ্বাস করি না। মনের তো চলন আছে। সব সময়ে একই রকম আবহ ধারণ করবে তার কোনও মানে নেই। আলো জ্বালাতে সত্যিই একটা শ্রম লাগে। প্রাকৃতিক ভাবে তো একটা আঁধার থাকে। ওটা তো কোনও ভাবেই অস্বীকার করতে পারি না। আঁধারটাই সবচেয়ে কাছের। তার সঙ্গে দুঃখ কিংবা শোকের কোনও সম্পর্ক নেই।’’
চলার পথে কখনও অন্ধকার এসে হাত ধরবে। আবার সেই আঁধারের স্পর্শ থেকে মুক্ত করবে আলো। আলো-আঁধারির এই খেলা সারা জীবন ধরে চলতে থাকবে। আঁধারেও সুখ আছে। আনন্দ আছে। উচ্ছ্বাস আছে। আলো একমাত্র আনন্দ বয়ে আনে না। আঁধার কোণেও লুকিয়ে থাকে আলোর চাবিকাঠি। শোকের সমার্থক কখনও অন্ধকার হতে পারে না। জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে আলো এবং অন্ধকার হাত ধরাধরি করে চলে। একটি অন্যটির মুখাপেক্ষি। আলোর সঙ্গে আঁধারের সমানুপাতিক সম্পর্ক। আলোর উৎসবের এই আড্ডায় যেন এমন বার্তাই উঠে এল।