Ventricular septal defect (VSD)

ভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাল ডিফেক্ট মানেই অনিশ্চিত জীবন নয়

সদ্যোজাত শিশুর শ্বাস নিতে কষ্ট হলে, অল্পেই ঝিমিয়ে পড়লে, খাওয়ায় অনীহা দেখা দিলে সতর্ক হন। শীঘ্র চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

Advertisement

ঊর্মি নাথ 

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০২৩ ০৭:২৯
Share:

—প্রতীকী ছবি।

হৃৎপিন্ডের সমস্যার রোগী মানেই বয়স্ক ব্যক্তি, এমন ভাবনার দিন গিয়েছে। ৩০-৪০-এর কোঠায় এসে হৃদযন্ত্রের সমস্যায় কাবু অনেকেই। এখানেই থেমে নেই। ভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাল ডিফেক্ট (ভিএসডি) অর্থাৎ হৃদযন্ত্রে ছিদ্র বা চলতি ভাষায় হৃদযন্ত্রের নীচের অংশের দুটো প্রকোষ্ঠ (নিলয়) বিভাজনকারী পর্দায় ছিদ্র নিয়ে জন্মায় বহু শিশু। এই সমস্যা সঙ্গে সঙ্গে ধরা না পড়লেও জন্মের কিছুদিন পরে তা ধরা পড়ে। শিশুর আচরণেও প্রতিফলিত হয় সমস্যা। আর তখনই প্রবল দুশ্চিন্তায় পড়েন অভিভাবকরা।

Advertisement

সমস্যাটি আসলে কী?

সমস্যাটি বিরল নয়, কারণ পৃথিবীতে বহু শিশু ভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাল ডিফেক্ট (ভিএসডি) নিয়ে জন্মায়। ভিএসডি হল এক রকমের কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ় বা হৃদযন্ত্রের জন্মগত ত্রুটিজনিত অসুখ। কনজেনিটাল হার্ট ডিজ়িজ় সাধারণত দু’রকম হয়। সায়ানটিক এবং অ্যাসায়ানটিক। সায়ানটিক কনজেনিটাল হার্টের অসুখে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমের জন্য শরীরের কোনও কোনও অংশ নীলচে হয়। অ্যাসায়ানটিকে অক্সিজেনের সমস্যা থাকে না, হার্ট পাম্পিংয়ের সমস্যা হয়, শ্বাসপ্রশ্বাস প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক ছন্দে হয় না। সায়ানটিকে শরীরে নীলচে রঙের জন্য সমস্যা দ্রুত ধরে ফেলা যায়। কিন্তু অ্যাসায়ানটিকে ধরা যায় কিছুটা পরে। ভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাল ডিফেক্ট হল অ্যাসায়ানটিক কনজেনিটাল হার্টের অসুখ। ‘‘সাধারণত জন্মের ছ’ থেকে দশ সপ্তাহের মধ্যে ভিএসডি ধরা পড়ে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে, যেমন প্রিম্যাচিয়োর শিশুদের ক্ষেত্রে আরও একটু আগে। এটা জন্মগত ত্রুটি। এক ধরনের স্ট্রাকচারাল ডিফেক্ট বা গঠনগত সমস্যা। এতে হৃদযন্ত্রের নীচের অংশের দু’টি প্রকোষ্ঠ (নিলয়) বিভাজনকারী পর্দায় ছিদ্র দেখা যায়,’’ বললেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দিব্যেন্দু রায়চৌধুরী।

Advertisement

লক্ষণ

কোনও শিশুর ভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাল ডিফেক্ট থাকলে আর পাঁচটা শিশুর আচরণের চেয়ে তার আচরণ কিছুটা আলাদা হবেই। প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে দেখা যাবে শিশুটি দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, খাওয়ায় অনীহা, অল্পতেই ঝিমিয়ে পড়া ইত্যাদি। ‘‘বুকে স্টেথোস্কোপ লাগালে হার্টে মার্মার বা হুশিং শব্দ শোনা যাবে। অনিয়মিত হৃদস্পন্দন হতে পারে। শিশুটি অল্প খেলেই হাঁপিয়ে যাবে। ভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাল ডিফেক্ট হলে বারবার ফুসফুসে সংক্রমণ হয়। কখনও হার্ট ফেলিয়োর হয়। এই অসুখে ফুসফুসে রক্তের চাপ বৃদ্ধি হতে পারে, যাকে পালমোনারি হাইপারটেনশন বলা হয়, যা সঙ্কটজনক অবস্থায় পৌঁছতে পারে,’’ বললেন ডা. রায়চৌধুরী।
এই লক্ষণগুলো দেখলেই অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। চিকিৎসকের কাছে গিয়ে বলতে হবে শিশুর সমস্যার কথা। চিকিৎসকের সন্দেহ হলে চিকিৎসা শুরু করার আগে তাঁরা চেস্ট এক্সরে এবং ইকোকার্ডিয়োগ্রাফি এই দু’টি পরীক্ষা করে দেখে নেন ছিদ্র আছে কিনা, ছিদ্রের আয়তন এবং ছিদ্রের সংখ্যা।

চিকিৎসা

একে নবজাতক, তার উপরে হৃদযন্ত্রে ছিদ্র। সাধারণত বাবা-মা মানসিক ভাবে বেশ ভেঙে পড়েন। সন্তানের সুস্থ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিরাশ হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে ডা. রায়চৌধুরী বললেন, ‘‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জন্মের সময় যতটা ছিদ্র থাকে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে ধীরে ধীরে ছিদ্র পূরণ হতে থাকে, ফলে ছিদ্র পরিমাপে ছোট হতে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসার প্রয়োজনও পড়ে না। অবশ্য ছ’মাস পর পর ফলোআপ করাতে হয়।’’ কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ভিএসডি থেকে মুক্তি পেতে অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে। বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সুনীলবরণ রায় বললেন, ‘‘মোটামুটি পাঁচ মিলিমিটার বা তার চেয়ে ছোট ভিএসডি বা ছিদ্র হলে স্বাভাবিক ভাবে ছিদ্র বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তার চেয়ে বড় হলে বারবার ফুসফুসে সংক্রমণ হবে, ঘনঘন সর্দিকাশি হবে। এতে শিশুটির বৃদ্ধি ঠিক মতো হবে না। তখন কিন্তু অপারেশন করাতে হবে। যদিও এখন অপারেশন পদ্ধতি অনেক উন্নত। ট্রান্সক্যাথেটার ক্লোজার পদ্ধতিতে ডিভাইজের মাধ্যমে অপারেশন করা হয়।’’ অপারেশনের আগে বা স্বাভাবিক ভাবে ভিএসডি থেকে আরোগ্য লাভের আগে সন্তানকে খুব বেশি খেলাধুলো বা শারীরিক পরিশ্রম করতে না দেওয়াই ভাল। এতে শ্বাসকষ্ট হবে, অল্পেতেই তারা হাঁপিয়ে যাবে। একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে তার শারীরিক পরিস্থিতি।

সুস্থ হওয়ার পরে

স্বাভাবিক ভাবে হোক বা অপারেশনের মাধ্যেমে, সুস্থ হওয়ার পরে অভিভাবকদের চিন্তা থাকে তাঁদের সন্তানের হয়তো আজীবন জীবনের ঝুঁকি থাকবে। ফলে ভিএসডি থেকে সেরে ওঠার পরেও তাদের খেলাধুলো থেকে বা শারীরিক পরিশ্রম থেকে শত হস্ত দূরে রাখেন বাবা-মা। শৈশবে ছেলে বা মেয়েটির ভিএসডি ছিল জানার পরে অনেকেই তাঁদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চান না। এই ধরনের চিন্তা করা কি আদৌ ঠিক? উত্তরে ডা. রায় বললেন, ‘‘এমন চিন্তার কোনও যুক্তি নেই। যদি ফুসফুসের প্রেসার স্বাভাবিক থাকে তা হলে ভিএসডি নিরাময়ের পরে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়। নিরাময়ের পরে শিশুর বাড়বৃদ্ধির কোনও সমস্যা হয় না।’’ সহমত ডা. রায়চৌধুরীও।

ভিএসডি নিয়ে পৃথিবীর বহু শিশু জন্মায় এবং ভবিষ্যতে জন্মাবেও। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে তারা সুস্থ হয়ে ওঠে। পরবর্তী কালে তারা হেসেখেলে দিব্য স্বাভাবিক জীবন যাপন করে। সুতরাং সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরে শিশুটিকে অকারণে কড়া নিয়মের বেড়াজালে আটকে রাখবেন না। এতে তার মানসিক ও শারীরিক বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। যা ভবিষ্যতে অন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement