গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
আবার একটা নতুন বঙ্গাব্দের শুরু। নতুন বছরের আবাহনে ব্যস্ত বাঙালি। সকলেই নিজেদের মতো করে আনন্দে করছেন। বাড়িতে বাংলা ক্যালেন্ডার রাখার চল উঠে গেলেও, বাঙালি নববর্ষের উদ্যাপন মনপ্রাণ ঢেলেই করে। উদ্যাপনে কোনও খামতি থাকে না। কিন্তু পয়লা বৈশাখের ঐতিহ্য যে শুধু উৎসবের মোড়কে সাজিয়ে রাখার বিষয় নয়, সেটা আজকাল অনেকের মনে থাকে না। নতুন বাংলা বছরের প্রথম দিনটিতে যে ভাবে বাঙালিয়ানা প্রকট হয়ে ওঠে, বছরের অন্য সময়ে নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি যদি এর খানিকটা সচেতনতাও জারি থাকত, তা হলে অনেক কিছুই হারিয়ে যেত না হয়তো। পরিবর্তন কালের নিয়ম। আর এই অমোঘ নিয়মের জাঁতাকলে পড়ে দ্রুত বদলে যাচ্ছে আমাদের চারপাশ। হারিয়ে যাচ্ছে সংস্কৃতি, মূল্যবোধের চেনা চেহারা। পড়ে আছে শুধু উদ্যাপনের আনন্দ আর হুজুগ।
একুশে ফেব্রুয়ারি আর পয়লা বৈশাখ, দুটোই বাঙালির জাতিসত্তার নির্মাণে মিশে আছে। পয়লা বৈশাখের মতো ভাষা দিবসের উদ্যাপনও দুই বাংলার মানুষ প্রাণ ঢেলে করেন। অথচ সন্তানের পড়াশোনার জন্য অভিভাবকেরা ভরসা রাখেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। বাংলা না শিখলেও চলবে, ইংরেজিতে তুখোড় হওয়া চাই। বাংলা ছোটগল্প কিংবা কিশোর উপন্যাসের বদলে ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দেন ইংরেজি সাহিত্যের বই। বাঙালির কাছেই বাংলা ভাষা পিছিয়ে পড়ে। এগিয়ে যায় ইংরেজি। মুখের বুলিতেও ইংরেজি ভাষা। বাংলা অক্ষর, শব্দের যে সৌন্দর্য, নতুন প্রজন্ম তার খোঁজ পায় না শুধু পরীক্ষায় কাঁড়ি কাঁড়ি নম্বর তোলার চাপে। উদ্যাপন, আনন্দ আর হইহুল্লোড়ের ভিড়ে আমাদের এই খামতিগুলি আরও বেশি করে প্রকট হয়ে ওঠে।
ঢাকার নববর্ষ। ছবি: সংগৃহীত।
আমি নিজে উদ্যাপন বিরোধী নই। নববর্ষের দিন হুল্লোড় করতাম আমরাও। বেশ মজা হত। পাবনার কামারহাট গ্রামে ছিল আমাদের বাড়ি। বাবা-মা আর আট ভাইবোনের সংসার ছিল। ফলে আনন্দ, হইহুল্লোড় করার জন্য আলাদা করে উৎসবের দরকার হত না। আমাদের তখন রোজই উৎসব। তবে আমার মনে আছে, পয়লা বৈশাখের দিন বাবার হাত ধরে যেতাম পরিচিত কিছু দোকানে। হালখাতার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। জিলিপি খেতাম, মিষ্টি খেতাম। মিষ্টিমুখ করে নতুন বছরের সূচনা হত। পয়লা বৈশাখ নিয়ে আমার সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি ওটাই। বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনটি নিয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু আর মনে করতে পারি না। মনে রাখার মতো মুহূর্ত তৈরিও হয়নি। কারণ, এটা শুধুমাত্র উৎসব হিসাবে আমরা দেখতাম না। নববর্ষ যে বাঙালির আবেগ, ঐতিহ্য সেটা মনে রেখেই নতুন একটা দিন শুরু করতাম। এখনও তাই করি। সাড়ম্বরে নববর্ষ পালনের ভাবনা ছিল না। শুধু আবেগকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ ছিল।
এখন অবশ্য পয়লা বৈশাখ অনেক বড় করে পালন করা হয়। অনেকেই নতুন পোশাক পরেন। নতুন বছর এসেছে বলে নতুন জামা হবে, আমি এমন কিছু কল্পনা করেছিলাম বলেও মনে পড়ে না। ছোটবেলায় আমরা নতুন জামার গন্ধ পেতাম দুর্গাপুজোয়। মা আসতেন, আর আমাদের পরনে উঠত পাটভাঙা পোশাক। নববর্ষে নতুন জামা কখনও পরিনি। তবে পয়লা বৈশাখ বলে কি আলাদা কিছু হত না? নিশ্চয়ই হত। মা একটু ভালমন্দ রাঁধতেন। মাছ কিংবা মাংস। আমরা একসঙ্গে সবাই মিলে তৃপ্তি করে খেতাম। মায়েরা যা রাঁধেন, মুখে দিলে তা-ই যেন অমৃত।
চঞ্চল চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত।
তা ছাড়া, আমি বিশ্বাস করি, খাওয়াদাওয়ার ভালমন্দ নির্ভর করে সামর্থ্যের উপর। সামর্থ্য যখন থাকে না, তখন উৎসবের সময়ে ডালভাতই ভূরিভোজ। আবার সময় বদলায়, সামর্থ্য বদলায়, তখন ভোজের সংজ্ঞা বদলে যায়। এখন পয়লা বৈশাখে কোনও বছর বাইরে খেতে যাই। আবার কোনও বছর হয়তো আমার স্ত্রী আমাদের পছন্দের কিছু খাবার তৈরি করেন বাড়িতে। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে আমি একেবারেই ছাপোষা। ডাল, ডিমভাজি, আলু কিংবা বেগুন ভর্তা— এগুলিই হচ্ছে আমার পছন্দের খাবার। বছরের যে কোনও দিন আমাকে এগুলি খেতে দিলে মন ভরে, প্রাণ ভরে খাব। কাছের মানুষদের সঙ্গে পাত পেড়ে বসে খাওয়ার যে শান্তি, তা আর কিছুতে নেই। বিশেষ করে উৎসবের দিনে আমার প্রিয়জনদের সঙ্গে কাটাতে ইচ্ছা করে। যেখানেই থাকি, যত দূরেই থাকি পরিবার আমার সঙ্গে থাকলে কোনও দুঃখ থাকে না। উৎসবের দিনে বেঁধে বেঁধে থাকার এই মন্ত্র অবশ্য আমি পেয়েছি আমার ফেলে আসা দিনের কাছ থেকে। যখন উৎসব ছিল বিভেদহীন।
এটা ডিজিটালের যুগ। আমাদের বেড়ে ওঠার সময়টা এখনকার থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। কালের নিয়মে চোখের সামনে পাল্টে গিয়েছে অনেক কিছু। আমরা যখন হাফপ্যান্ট, দেখতাম সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন করতেন। ধর্মনিরপেক্ষের উৎসব। বাঙালিয়ানার এক অন্য উদ্যাপনের সাক্ষী থেকেছি। মনে হত যেন সকলেই একটা পরিবার। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকেন। উৎসবের সময়ে সকলে এক হয়েছেন। বনেদি বাড়িগুলিতে যেমন হয় আর কী। এই মাঝবয়সে এসে সে সব কেমন যেন নিমেষে পাল্টে গেল। বৃত্তটা কেমন যেন ছোট হয়ে এল। এখন যার যেটুকু, তার সেটুকু। বিনিময় নেই, আদানপ্রদান নেই, একে-অপরকে জড়িয়ে নেওয়া নেই। এক দিনের উদ্যাপন, জাঁকজমক, উৎসবের আতিশয্য কি গ্রাস করে নিচ্ছে বাঙালিয়ানার আসল চেহারাকে? উত্তর কার কাছে, জানি না।
ছেলের সঙ্গে অভিনেতা। ছবি: সংগৃহীত।
রোদ্দুর শৈশব শুদ্ধ। আমার ছেলে। একমাত্র সন্তান। ১৫ বছরে পা দিয়েছে। আমার প্রজন্মের সঙ্গে ওর প্রজন্মে মেলে না। পয়লা বৈশাখ নিয়ে ওর কী ভাবনা, সেটাও আমি জানি না। শুধু এটুকু জানি, পয়লা বৈশাখ নিয়ে ওর নিজের মতো করে কিছু ভাবনাচিন্তা আছে। আমাদের বাপ-ব্যাটায় একসঙ্গে বসে তা নিয়ে কখনও কথা হয়নি। ওর কাছে জানতে চাইলে হয়তো ও নিজের ভাবনা বলবে। অথচ নিয়মকানুন, রীতিনীতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের ধারণা সব আসলে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জিনিস। গুরুজনেরা আমাদের শিখিয়েছেন। নিজস্ব সংস্কৃতিকে চিনতে শিখিয়েছেন। ঐতিহ্য সংরক্ষণের পরামর্শ দিয়েছেন। বিশেষ এই দিনগুলি হারিয়ে যেতে দিতে বারণ করেছেন। অথচ আমরা কি আমাদের পরের প্রজন্মকে সে পাঠ দিই? পয়লা বৈশাখ যে বাঙালির অন্যতম উৎসব, সে কথা কি বলি সন্তানকে? অথচ বাংলা সংস্কৃতির বীজ আগামী প্রজন্মের মনে রোপণ করে দেওয়া আমাদেরই দায়িত্ব। আমরাও তো বড়দের থেকেই এ সব শিখেছি, জেনেছি। আমাদের আগের প্রজন্মই তো বাঙালি সংস্কৃতিকে ভালবাসতে শিখিয়েছেন। কিন্তু এখনকার ছবিটা সম্পূর্ণ আলাদা।
জন্মসূত্রে বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির সঙ্গে নতুন প্রজন্মের সম্পর্ক গড়ে উঠলেও, নাড়ির টান গড়ে উঠছে না। সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর যে আত্মশ্লাঘা দেখি অভিভাবকদের মধ্যে, তা সত্যিই চিন্তার কারণ। কলকাতায় কী হয় অবশ্য জানি না। তবে খুব আলাদা যে কিছু হয় না, সেটুকু নিশ্চিত। এক দিনের উৎসব, উদ্যাপন, প্রস্তুতি, আড়ম্বর গুরুত্ব হারাবে যদি বাংলা সংস্কৃতিতে সারা বছর বুকের ভিতর জড়িয়ে না রাখি। এই উৎসবের সঙ্গে আসলে বাঙালিয়ানা বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে, সেটা ভুলে গেলে চলবে না। নতুন বছর সকলের ভাল কাটুক। আনন্দে কাটুক। পয়লা বৈশাখের উদ্যাপন এক দিনের হলেও, বাঙালিয়ানা সকলের মনেপ্রাণে সারা বছর বেঁচে থাকুক।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখন: রিচা রায়)