জ্বর নেই, কিন্তু হাঁচি-কাশি হচ্ছে। কয়েকদিন পর রিপোর্ট পজিটিভ এমন রোগীও পাচ্ছেন চিকিৎসকরা। ফাইল ছবি।
ইদানিং জ্বর মানেই একটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে আমাদের মনে। করোনা উপসর্গের অন্যতম হিসাবে ধরে নেওয়া হচ্ছে জ্বরকেই। বহু জায়গায় থার্মাল গানের মাধ্যমে তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে। জ্বর নেই মানে করোনাও নেই, অনেক ক্ষেত্রেই ধরে নেওয়া হচ্ছে এমন। কিন্তু আদৌ কি তাই? দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সের একটি রিপোর্ট ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। সেই রিপোর্ট কিন্তু বলছে অন্য কথা। সেখানে বলা হয়েছে, ৪৪ শতাংশ করোনা আক্রান্তই জ্বরের উপসর্গহীন। ৩৪.৭ শতাংশের ক্ষেত্রে সর্দি-কাশি-কফের সমস্যা রয়েছে। মাত্র ১৭.৪ শতাংশের ক্ষেত্রে জ্বর ছিল করোনা আক্রান্তের। এ বিষয়ে শহরের চিকিৎসকরা কী বলছেন? কারা আক্রান্ত হচ্ছেন? কেমন রোগী আসছেন তাঁদের কাছে?
আরও পড়ুন: দ্বিতীয় বার করোনা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কতটা? রোগ ফেরার ভয় কাদের বেশি?
কলকাতা সহ গোটা রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর মঙ্গলবার যে বুলেটিন প্রকাশ করেছে, সেখানে বলা হয়েছে আগের ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তের সংখ্যা ২,১৩৪। প্রথম থেকেই জ্বরের সঙ্গে করোনার সম্পর্কের উপরই জোর দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু জ্বর দেখেই কি করোনা বলা যায়? শহরের চিকিৎসকদের কাছে যে সমস্ত রোগী আসছেন, যাঁরা করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই কি জ্বর ছিল? তাপমাত্রা মেপে জ্বর না থাকলে নিরাপত্তা সংক্রান্ত একটা আত্মবিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে। আর এখানেই সাবধান করছেন চিকিৎসকরা।
আরও পড়ুন: কোন কোন ধরনের টেস্ট করা হয় কোভিডে, কারা করাবেন?
জ্বর নেই, কিন্তু শুধুমাত্র কনজাংটিভাইটিস রয়েছে, শরীরে ক্লান্তি— এমন উপসর্গের রোগীরও করোনা পজিটিভ এসেছে, জানালেন মেডিসিনের চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস। তিনি বলেন, “জ্বর নেই, কিন্তু করোনা পজিটিভ এমন অনেক রোগীই আসছেন। এঁদের অনেকের মাধ্যমেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। এমনও হতে পারে, কারও দু’এক দিন গা হাত-পা ব্যথা ছিল, তিনি করোনা পজিটিভ। নিজে থেকেই সেরে গিয়েছে।” আর এই বিষয়টাই আরও বেশি করে ভাবাচ্ছে চিকিৎসকদের।
আরও পড়ুন: প্রায় উপসর্গহীন বা সামান্য উপসর্গের করোনা আক্রান্তরা কী করবেন?
“প্রায় উপসর্গহীন যাঁরা আসছেন, কিন্তু কোথাও যেন শরীর দুর্বল লাগছে, তাঁদের ক্ষেত্রে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করা হচ্ছে। তবে জ্বর থাকছে না অনেকেরই। কারও হয়ত সামান্য সর্দি-কাশি বা গলায় ব্যথা ছিল। কারও ক্ষেত্রে হয়তো ঝিমুনি ভাব। এগুলিকে আটিপিক্যাল উপসর্গ বলা যেতে পারে, কিন্তু অবহেলা করা ঠিক হবে না”, এমনটাই মত মেডিসিনের চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের।
প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হবে। কোনও উপসর্গ অবহেলা নয়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
জ্বর, সর্দি, কাশি নিয়ে বর্ষাকালে অনেকেই ভোগেন। ফ্লু এই সময় অনেকেরই হয়। এটা ছাড়াও অনেক রোগীই এসেছেন, যাঁরা বেশ কয়েক দিন কোনও গন্ধ পাচ্ছিলেন না। এমনিতে সুস্থই রয়েছেন। কিন্তু করোনা পরীক্ষার ফলে পজিটিভ এসেছে। তাই জ্বরকেই একমাত্র উপসর্গ হিসাবে ধরে নেওয়া হচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে মেডিসিনের চিকিৎসক কল্লোল সেনগুপ্ত বলেন, “দুর্বলতা বোধ করা একটা অন্যতম উপসর্গ হিসেবে দেখা গিয়েছে কিছু ক্ষেত্রে। এঁদের কিন্তু জ্বর ছিল না। খিদে কমে গিয়েছে বা সামান্য পেটে ব্যথা নিয়ে এসেছেন। কারও বেশ কয়েক দিন ধরে মাথা যন্ত্রণা ছিল। তবে শরীরের তাপমাত্রা ঠিকই ছিল। এ রকম কয়েকটা ক্ষেত্রেও করোনা পজিটিভ এসেছে।”
রাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে কেন
রাজ্যে করোনা পরীক্ষার সংখ্যা বেড়েছে। তাই বেড়েছে আক্রান্তের সংখ্যাও। হাসপাতালে যে কোনও রোগী ভর্তি হলেই প্রথমে পরীক্ষা করে নেওয়া হচ্ছে তিনি করোনা আক্রান্ত কি না। এ রকম অনেক রোগীই আছেন, যাঁরা নির্দিষ্ট কোনও রোগের জন্য চিকিৎসকের কাছে এসেছিলেন। কিন্তু জ্বর বা সে রকম কোনও উপসর্গই ছিল না। তাঁদের করোনা পজিটিভ এসেছে। তাঁদের আলাদা করে রাখা হচ্ছে। কিন্তু ১৪ দিনেও তাঁদের কারও জ্বর আসেনি বা সেই অর্থে কোনও বাড়াবাড়ি হয়নি। সুস্থ হয়ে ফিরে গিয়েছেন। অ্যাসিম্পটোম্যাটিক, প্রি-সিম্পটোম্যাটিক, মাইল্ড সিম্পটোম্যাটিক, সিভিয়ার সিম্পটোম্যাটিক এই চার ধরনের রোগীই রয়েছেন। সামান্য সর্দি-কাশি হয়েছে, জ্বরে নেই, গলা খুসখুস করছে বা শুধুমাত্র ডায়ারিয়া নিয়ে এসেছেন এমন ব্যক্তিদেরও করোনা পজিটিভ এসেছে— এমনটাই জানালেন জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী।
ডায়ারিয়াতে কেন করোনা পজিটিভ?
এই ভাইরাস শ্বাসনালী থেকে পেটেও যেতে পারে। গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টিনাল ট্র্যাক্টেও কিছু ক্ষেত্রে হানা দিচ্ছে এটি। কারণ শ্বাসনালী বা জিআই ট্র্যাক্ট দুই ক্ষেত্রেই অ্যাঞ্জিওটেনসিন টাইপ ২ রিসেপটর রয়েছে।
থার্মাল স্ক্রিনিংয়ে তাপমাত্রা নেই মানেই যে করোনামুক্ত এমনটা আর নেই, এমনটাই বলেন সুবর্ণ বাবু। মেডিসিনের চিকিৎসক অরিন্দম বাবুও সহমত পোষণ করে বলেন, “অনেকের ক্ষেত্রেই তাপমাত্রা থাকছে না। প্রকট ভাবে কোনও জ্বর নেই। কিন্তু আচমকা শ্বাসকষ্ট শুরু হচ্ছে। এ জাতীয় কোনও লক্ষণ থাকলেও করোনা পরীক্ষা করতে হবে। জ্বর বেশি দিন থাকলে এই মুহূর্তে ফেলে রাখা যাবে না। জ্বর না থাকলে বিষয়টাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না অনেকে। তাই জ্বরকে প্রাথমিক ফোকাস করা হয়েছে। জ্বর হলে করোনা ছাড়াও ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড বা অন্য রোগও হতে পারে। রক্তপরীক্ষা করিয়ে নিতেই হবে।”
সামান্য ঠান্ডা লাগাকেও হালকা ভাবে নেওয়া ঠিক নয়। ফাইল ছবি।
উপসর্গহীন আক্রান্ত কথাটা কি আদৌ ঠিক?
সংক্রামক ব্যাধি চিকিৎসক অমিতাভ নন্দীর মতে, “উপসর্গহীন আক্রান্ত বলে আসলে কিছু হয় না। উপসর্গহীন বাহক বলা যেতে পারে, যাঁদের জ্বর ছিল না, হয়তো সামান্য সর্দি ছিল বা মাথা ব্যথা। সেরেও গিয়েছেন। কিন্তু অজান্তেই সংক্রামিত করেছেন অপরকে।”
অরিন্দমবাবু এই প্রসঙ্গে বলেন, “উপসর্গহীন ঠিক বলা যায় না। আসলে এক বার হাঁচি-কাশি হলে আতঙ্কের কিছু নেই। কিন্তু দিনে বেশ কয়েক বার হাঁচি-কাশি হল, ভাইরাল লোড কম বলে কোনওরকম শারীরিক অসুবিধা হল না। কিন্তু ভাইরাস নাকের কাছে বা গলার কাছে থাকলে তার থেকে ছড়িয়ে গেল অন্যত্র।”
দিল্লিতে অ্যান্টিবডি টেস্ট করে দেখা গিয়েছে, জনসংখ্যার ২৩ শতাংশের করোনা পজিটিভ এসেছে। তবে সবার ক্ষেত্রে জ্বর ছিল এমনটা কিন্তু নয়। এমনটাই জানালেন আইআইএসইআর, মোহালির জীববিজ্ঞানী ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও শহরের ভিত্তিতে আক্রান্তের সংখ্যা, সংক্রমণের অবস্থান, উপসর্গ বদলে যাচ্ছে বলে জানালেন অরিন্দমবাবু।
গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু, আরও বেশি সতর্কতা?
সামান্য গলা ব্যথা, হাঁচি, কাশি এর মধ্যে সবকটি বা যে কোনও দুটো উপসর্গ রয়েছে, করোনা ধরা পড়েছে এমন রোগীর ক্ষেত্রেও। কিন্তু এই মুহূর্তে জ্বরটাই প্রাথমিক ফোকাস নয়। বুকে চাপ লাগছে। ডায়ারিয়া কিংবা বারবার ঘুম পাওয়া, এই উপসর্গও রয়েছে আক্রান্তদের মধ্যে, এমনটাই বলেন বেলেঘাটা আইডি-র চিকিৎসক যোগীরাজ রায়। সামান্য ঠান্ডা লাগাকেও তাই এখন হালকা ভাবে নেওয়া ঠিক নয়। তাই শরীরে কোনওরকম অসুবিধা হলেই রক্তপরীক্ষা করতেই হবে, জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা।
আরও পড়ুন: আসল এন৯৫ চিনবেন কী করে? সংশয় হলে কী করবেন?
জ্বরকেও অনেকে হালকাভাবে নেন, সঠিক ভাবে তাপমাত্রা মাপেন না। এখন রাজ্যের যা পরিস্থিতি তাই প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন যোগীরাজ বাবু।
কোন ক্ষেত্রে বেশি সতর্ক হতে হবে?
জ্বর নেই। কিন্তু গলা ব্যথা রয়েছে
সর্দি-কাশি রয়েছে
কন্টেনমেন্ট জোনের আশপাশে বাড়ি এবং উপরের উপসর্গগুলি বেশ কয়েক দিন ধরেই ভোগাচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থতিতে কী করতে হবে?
এই প্রসঙ্গে সরকারকেই দায়িত্ব নেওয়ার কথা বললেন সংক্রামক ব্যাধির চিকিৎসক অমিতাভবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘আক্রান্তের সংখ্যা ও সংক্রমণ কমাতে সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। মানুষকেও সচেতন হতে হবে। উপসর্গহীন বাহকদের বাদ রাখা যাবে না। এলাকা এবং পেশাভিত্তিতে পরীক্ষা করতে হবে। জ্বর না হলেও সামান্যতম উপসর্গ থাকলেও অবহেলা করা যাবে না।’’
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)