সুপারফুড কিনোয়া

শর্করা, প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজে ভরপুর কিনোয়া এক রকম হোল গ্রেন। কিন্তু কেন খাবেন কিনোয়া? জেনে নিন বিশদেকালে কালে অন্যান্য খাবারের আবির্ভাবে খাদ্যতালিকা থেকে হারাতে বসল কিনোয়া। পরে সত্তরের দশকের দোরগোড়ায় আবার আবির্ভাব ঘটল এই বহু গুণসম্পন্ন হোল গ্রেনের।

Advertisement

নবনীতা দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৯ ০৬:৩৯
Share:

রেস্তরাঁর মেনু কার্ডে নতুন অতিথি কিনোয়া। স্যালাড থেকে শুরু করে ডেজ়ার্টেও দেখা মিলছে কিনোয়ার। এই কিনোয়া আসলে কী? এর আবির্ভাবই বা কবে? এ খাবার কিন্তু নতুন নয়, বহু যুগ আগেই এর আগমন। ইনকা সভ্যতার সময়ে কিনোয়ার কথা পাওয়া যায়। গম, যব, বাজরার মতোই কিনোয়া ছিল সে সময়ের স্টেপ‌্‌ল ফুড। খাদ্যগুণের জন্য এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মাদার অফ অল গ্রেনস’। আর তাকে মনে করা হত অত্যন্ত পবিত্র। প্রতি বছর এই গাছের বীজ পুঁতে দিতেন রাজা নিজে। সোনার তৈরি সরঞ্জাম নিয়ে বীজ রোপণ উৎসব হত। আক্ষরিক অর্থেই তা সোনার ফসল ফলাত।

Advertisement

কিন্তু কালে কালে অন্যান্য খাবারের আবির্ভাবে খাদ্যতালিকা থেকে হারাতে বসল কিনোয়া। পরে সত্তরের দশকের দোরগোড়ায় আবার আবির্ভাব ঘটল এই বহু গুণসম্পন্ন হোল গ্রেনের। এর পুষ্টিগুণই কিনোয়াকে ফিরিয়ে নিয়ে এল আধুনিক ডায়েটে। কিন্তু এত খাবার থাকতে কিনোয়া কেন?

Advertisement

সব খাবারের সেরা কিনোয়া

এক ধরনের ফুলগাছের বীজ হল কিনোয়া। হোল গ্রেন কাউন্সিলের তথ্য অনুসারে, এটি হল গ্লুটেন ফ্রি হোল গ্রেন কার্বোহাইড্রেট। স্পষ্ট কথায় যাকে বলা যায় বন্ধু কার্বোহাইড্রেট। এতে যেমন কার্ব আছে, তেমনই প্রোটিনে ভরপুর। শস্য না হয়েও যেহেতু শস্যের মতোই কাজ করে, তাই অনেকেই একে সিউডো সিরিয়ালও বলে থাকেন। সাদা, লাল ও কালো— মূলত এই তিন ধরনের কিনোয়া পাওয়া যায়। সাদা কিনোয়া সহজপ্রাপ্য। স্যালাড জাতীয় খাবারের জন্য লাল কিনোয়া কিনতে পারেন। এটা রান্নার পরেও একই রকম দেখতে থাকে। লাল, সাদার তুলনায় কালো কিনোয়া বেশি মিষ্টি হয়। পাওয়া যায় কিনোয়া ফ্লেক্স ও কিনোয়া ফ্লাওয়ার।

ত্বক ও চুলের বন্ধু কিনোয়া

• ১/৪ কাপ কিনোয়া সয় মিল্কে সিদ্ধ করে নিন। এর মধ্যে ৩ টেবিল চামচ টক দই, ২টি ডিমের কুসুম ও দু’ফোঁটা মিমোসা এসেনশিয়াল অয়েল দিয়ে মিশিয়ে নিন। মুখে ও গলায় ২০ মিনিট লাগিয়ে ধুয়ে ফেলুন। কিনোয়ার প্রোটিন ত্বকের পুষ্টি জোগাবে। অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টে ভরপুর হওয়ায় বলিরেখা পড়তে দেবে না। সানট্যান দূর করে ত্বক হবে মোলায়েম ও উজ্জ্বল। ত্বকের পিগমেন্টেশনও কমিয়ে দিতে সক্ষম এই প্যাক
• কিনোয়া চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখে। ফলে খুসকি হয় না। চুলে প্রোটিন ট্রিটমেন্ট করতে অনেক সালঁয় কিনোয়া হেয়ার ট্রিটমেন্ট করা হয়। এর জন্য কিনোয়া পেস্ট চুলে মিনিট পনেরো লাগিয়ে রেখে চুল ধুয়ে ফেলা হয়

পুষ্টিতেই তুষ্টি

প্রোটিন, ভিটামিন বি ও ফাইবারে ভরপুর কিনোয়া ডায়েটে রাখা মানে এক বলে ছয় মারা। একই সঙ্গে পুষ্টি বজায় থাকবে, ওজনও কমবে, হাড়ের গঠন মজবুত হবে, বাওয়েল মুভমেন্ট নিয়মিত হবে, গ্যাসট্রো-ইনটেস্টিনাল স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকবে এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করায় হৃদযন্ত্রও সুস্থ থাকবে। আনাজ দেওয়া খিচুড়ির মতোই কিনোয়া স্টেপ্‌ল ফুড অর্থাৎ স্বয়ংসম্পূর্ণ আহার। দিনে এক বাটি কিনোয়া খাওয়া মানে শরীরকে একই সঙ্গে শর্করা, প্রোটিনের জোগান দেওয়া। তার সঙ্গে আরও থাকছে আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, ভিটামিন ই ও অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট। এখানেই শেষ নয়। এতে পাওয়া যায় ন’ধরনের এসেনশিয়াল অ্যামিনো অ্যাসিড, যা খুব কম খাবারেই পাওয়া যায়। যার মধ্যে লাইসিন ও আইসোলিউসিন আছে, যা অন্য গ্রেনের মধ্যে প্রায় থাকেই না। এই অ্যামিনো অ্যাসিড প্রয়োজন হাড়ের গঠন সুদৃঢ় রাখার জন্য। অন্য দিকে কিনোয়ার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়ায় ডায়াবেটিক ডায়েটেও কিনোয়া রাখা যেতে পারে। ক্যানসার প্রতিরোধেও কিনোয়াকে ফলদায়ী মনে করছেন চিকিৎসকেরা। ফলে পুষ্টিগুণ বিচার করে দেখলে কিনোয়া কিন্তু সুপারফুড।

ভাতের বদলে কিনোয়া?

খাওয়াই যায়। ডায়েটিশিয়ান সুবর্ণা রায়চৌধুরী জানালেন, ‘‘এক কাপ কিনোয়ায় পাওয়া যায় ২২২ ক্যালরি ও ২২ গ্রাম কার্বস। অন্য দিকে ১ কাপ চালে কার্ব থাকে প্রায় ৭৮ গ্রাম। এ দিকে ফাইবার এবং প্রোটিনও ভাতের তুলনায় কিনোয়াতেই বেশি। ফলে ভাতের পরিবর্ত হিসেবে কিনোয়া ব্যবহার করলে বরং সুফল পাবেন। বিশেষত যাঁরা ওজন কমানোর ডায়েট করছেন, তাঁরা স্বচ্ছন্দে ভাতের বদলে কিনোয়া খেতে পারেন।’’ কিনোয়ার রন্ধনপ্রণালীও খুব জটিল বা সময়সাপেক্ষ নয়। ভাতের মতোই ফুটিয়ে খুব সহজে তা রান্না করা যায়। মিনিট পনেরো সময় লাগে কিনোয়া রাঁধতে। অন্য দিকে কিনোয়া ফ্লেক্স খেলে রান্নারও প্রয়োজন পড়ে না। গরম দুধে দিয়ে খেতেও সুস্বাদু। ভাতের চেয়ে ফাইবার, আয়রন ও প্রোটিনও বেশি। সব দিক দিয়েই কিনোয়া অনেক বেশি উপকারী। তবে সব ধরনের মুদির দোকান বা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কিনোয়া পাওয়া যায় না। তার জন্য মলের স্টোর বা অনলাইন বাজারেই আপাতত ভরসা রাখতে হবে।

কিনোয়ার রুটি

রন্ধনপ্রণালী

এ বার প্রশ্ন হল কী ভাবে রাঁধবেন এই হোল গ্রেন? তা খেতে কেমন? কিনোয়া অনেকটা চাল, গম, যবের মতোই। ফলে রন্ধনপ্রণালীও সে রকমই। কিনোয়া দিয়ে স্যালাড থেকে শুরু করে বিরিয়ানি, রুটি, পিৎজ়া পর্যন্ত তৈরি করা যায়। তা যেমন সুস্বাদু, তেমনই স্বাস্থ্যকর। তবে কিনোয়া ভাতের চেয়ে তাড়াতাড়ি সিদ্ধ হয়। আবার কিনোয়ার রুটি করতে চাইলে কিনোয়া ফ্লাওয়ার কিনে নিতে পারেন। আটা মাখার মতোই কিনোয়া মেখে নিতে হবে। অবশ্যই তা গরম জল দিয়ে। সুবিধের জন্য কিনোয়ার কিছু রেসিপি দেওয়া হল।

কিনোয়া বিরিয়ানি

উপকরণ: ছোট এঁচোড় ১টি, টক দই আধ কাপ, আদা-রসুন বাটা ১ চা চামচ, পেঁয়াজ ১ টি, বেরেস্তা ২ টেবিল চামচ, ঘি ২ টেবিল চামচ, ধনে গুঁড়ো ১ চা চামচ, গরম মশলা গুঁড়ো ১ চা চামচ, কেশর ৭-৮টি, কেওড়া জল আন্দাজ মতো, ধনে পাতা ও পুদিনা পাতা প্রয়োজন মতো, নুন স্বাদ মতো।

প্রণালী: প্রথমে কিনোয়া ধুয়ে জলে ভিজিয়ে রাখুন। অন্য দিকে এঁচোড় ধুয়ে পরিষ্কার করে ডুমো ডুমো করে কেটে নিতে হবে। এ বার কড়াইয়ে ঘি গরম করে তাতে একে একে পেঁয়াজ কুচি, আদা-রসুন বাটা দিয়ে কষতে থাকুন। একটি বাটিতে টক দই, ধনে গুঁড়ো, গরম মশলা গুঁড়ো ও নুন মিশিয়ে রাখুন। পেঁয়াজ নরম হয়ে এলে কড়াইয়ে এই বাটির মিশ্রণ ঢেলে দিন। মশলা কিছুটা কষে এঁচোড় দিন। এঁচোড় অর্ধেক সিদ্ধ হয়ে এলে একটি ছোট হাঁড়িতে বিরিয়ানির মতো একটা কিনোয়ার স্তর, কিছুটা এঁচোড়ের স্তর, আবার কিনোয়ার স্তর দিয়ে সাজিয়ে নিন। উপর থেকে ছড়িয়ে দিন কেওড়া জল, কেশর, ধনে পাতা ও পুদিনা পাতা। এ বার হাঁড়ির মুখে ঢাকা দিয়ে দম দিন। মিনিট পনেরো-কুড়ি রান্না করলেই তৈরি হয়ে যাবে এঁচোড় দিয়ে কিনোয়া বিরিয়ানি।

নাটি কিনোয়া স্যালাড

উপকরণ: কিনোয়া ১ কাপ, লেটুস পাতা ৩টি, অলিভ অয়েল ৩-৪ চা চামচ, কাসুন্দি ১ চা চামচ, সরষের তেল ১ চা চামচ, রোস্টেড আমন্ড ১ টেবিল চামচ, রোস্টেড আখরোট ১ টেবিল চামচ, বেদানা ৩ টেবিল চামচ, তাল পাটালি স্বাদ মতো, নুন পরিমাণ মতো।

প্রণালী: প্রথমেই কিনোয়া নুন জলে সিদ্ধ করে নিতে হবে। এর মধ্যে একে একে আমন্ড, আখরোট, বেদানা, কাসুন্দি, সরষের তেল, নুন ও তাল পাটালি মিশিয়ে নিতে হবে। এ বার প্লেটের উপরে লেটুস সাজিয়ে তার উপরে এই স্যালাড রাখুন।

উপর থেকে অলিভ অয়েল ছড়িয়ে দিন। তৈরি নাটি কিনোয়া স্যালাড।

মডেল: ডিম্পল আচার্য, ছবি: বিপ্রদীপ চক্রবর্তী, মেকআপ: উজ্জ্বল দত্ত, পোশাক ও গয়না: ফ্যাবইন্ডিয়া, লাউডন স্ট্রিট, লোকেশন ও খাবার: ফ্যাব ক্যাফে, ফ্যাব এক্সপিরিয়েন্স সেন্টার, লাউডন স্ট্রিট, খাবারের ছবি: তন্ময় সেন

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement